অনলাইনে চটকদার বিজ্ঞাপন, লোভনীয় অফারে নারীদের শ্লীলতাহানি

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২২, ১৯:০৮

র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার আমির হামজা, ছবি : সংগৃহীত
প্রতিবাদ করলে নেমে আসতো মানসিক নির্যাতন, প্রশাসনের ভয়, জরিমানা। এমনকি ক্ষতিপূরণের ভয়ও দেখানো হতো। শুধু তাই নয়, নারী সিকিউরিটি গার্ডদের সাথে খারাপ ব্যবহার, মানসিক নির্যাতন, জোর করে আটকে রাখা এবং তাদের দিয়ে অতিরিক্ত ডিউটি করাতো রাজধানীর খিলক্ষেতে রিয়েল ফোর্স সিকিউরিটি অ্যান্ড লজিস্টিক সার্ভিসেস প্রাইভেট লি. নামক প্রতিষ্ঠান।
প্রতারণা করে
বিপুল সংখ্যক চাকরিপ্রত্যাশীর অর্থ আত্মসাৎ এবং নারী চাকরিপ্রার্থীদের শ্লীলতাহানির
চেষ্টার অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির এমডি আমির হামজাকে রাজধানীর খিলক্ষেত থেকে গ্রেপ্তারের
পর এতথ্য জানিয়েছে র্যাব-১।
আজ মঙ্গলবার
(১২ জুলাই) বিকেল সোয়া চারটায় রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত
এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাব-১ এর অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল আব্দুল্লাহ
আল মোমেন।
তিনি বলেন,
রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় কয়েকটি সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্র দীর্ঘদিন ধরে
ডিজিটাল প্লাটফর্ম ব্যবহার করে চাকরি দেয়ার নামে ভুয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আসছিল।
এই ধরনের আকর্ষণীয় অনলাইন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে একটি চক্র প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ
মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে আসছে বলে জানা যায়।
তারা পরস্পর
যোগসাজসে দীর্ঘদিন বিভিন্ন ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিক সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগ
করে এবং সে অনুযায়ী মাসিক বিল কালেকশন করে। পরে ২০২০ সালে কোম্পানিটি লিমিটেড কোম্পানিতে
পরিণত হয় এবং এসিআই লজিস্টিক এর স্বপ্ন শোরুমে সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগের একটি বড়
চুক্তির মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে। তারা মূলত সমাজের বেকার, অল্পশিক্ষিত, দরিদ্র পরিবারগুলোকে
চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নিয়ে প্রতারণা করে আসছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
এসব অভিযোগের
পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রতারক চক্রটিকে আইনের আওতায় আনতে র্যাব-১ ছায়াতদন্ত ও গোয়েন্দা
নজরদারি বাড়ায়। মঙ্গলবার ভোরে র্যাব-১ এর একটি দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ডিএমপি ঢাকার
খিলক্ষেত থানাধীন বনরূপা আবাসিক এলাকার রিয়েল ফোর্স সিকিউরিটি অ্যান্ড লজিস্টিক সার্ভিসেস
প্রাইভেট লিমিটেডের অফিসে অভিযান পরিচালনা করে চক্রের প্রধান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক
মো. আমির হামজা ওরফে সিরাজীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এসময় তার কাছ
থেকে ৪টি ওয়াকিটকি সেট, ৩টি ওয়াকিটকি চার্জার, ১৬টি বিভিন্ন কালারের সিকিউরিটি গার্ড
ইউনিফর্মের ব্যবহার্য প্যান্ট, ২টি ক্যাপ (রিয়েন্স ফোর্স), ১টি মেটাল ডিটেকটর, ১টি
সিগন্যাল লাইট, ৬টি বেল্ট, ২টি মোবাইল, ৩ জোড়া বুট এবং নগদ ৪ হাজার টাকা উদ্ধার করা
হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে
আমির হামজার দেয়া তথ্যের বরাতে র্যাব-১ সিও বলেন, তিনি (আমির হামজা) ১৯৯৮ সালে ঢাকায়
একটি সিকিউরিটি এজেন্সিতে চাকরি শুরু করেন। পরে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন স্বনামধন্য সিকিউরিটি
কোম্পানি এবং সুপার শপে বিভিন্ন পদে ইয়াং ফোর্স, এলিট ফোর্স, অরিয়ন সিকিউরিটিতে ২০১৬
সাল পর্যন্ত বিভিন্ন পদে চাকরি করেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে ২০১৭ সালের শুরুতে রিয়েল ফোর্স
নামে সিকিউরিটি কোম্পানি নামে যাত্রা শুরু করেন আমির হামজা।
এতে তাকে আর্থিকভাবে
সাহায্য করেন চট্টগ্রামের আলীকদমের ব্যবসায়ী ইউনুস মিয়া। তারা প্রথমে মূলত বিভিন্ন
ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিক সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগ করে এবং সে অনুযায়ী বকেয়া
বিল কালেকশন করে। ২০২০ সালে কোম্পানিটি লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হয় এবং এসিআই লজিস্টিকের
স্বপ্ন শোরুমে সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগের একটি বড় চুক্তি সম্পন্ন করে। তাদের 'রিয়েল
ফোর্স' এর মূল অফিস বারিধারা ডিওএইচএস এলাকায়। এছাড়া রাজধানীর খিলক্ষেত ও চট্টগ্রামের
হালিশহরে তাদের দুটি শাখা অফিস রয়েছে।
তারা মূলত বিভিন্ন
থার্ড পার্টির দালালের মাধ্যমে অনলাইনে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে লোক কালেকশন করে। প্রথমে
চাকরিপ্রত্যাশীরা দালালের সাথে দেখা করে এবং তাদেরকে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ৪ হাজার
টাকা জমা দিতে বলে। পরে দালালরা আমির হামজার সাথে যোগাযোগ করে তার বারিধারা অফিসে চাকরিপ্রত্যাশীদের
রিপোর্ট করতে বলে। এ পর্যায়ে ফরম ফিলাপ এবং ইউনিফর্ম বাবদ আরো ৪ হাজার টাকা নেয়া
হয়। পরে চাকরিপ্রত্যাশীদের সুপারভাইজার হিসেবে আট ঘণ্টা ডিউটি এবং মাসিক ১৪ হাজার
৫০০ টাকা বেতনের অফার দেয়া হয়।
লে. কর্নেল
আব্দুল্লাহ আল মোমেন বলেন, চাকরিপ্রত্যাশী ভুক্তভোগী ৬ জন নারী ও ১০ জন পুরুষ র্যাবের
কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন যে, তারা অনলাইনে কথাবার্তা বলার সময় কোনো ধরনের টাকা পয়সা
লাগবে না বলে জানতে পারে। লোভনীয় চাকরির অফারে তারা এই চক্রের খপ্পরে পড়ে। পরে চাকরিতে
যোগ দেয়ার পর তাদের ১২ ঘণ্টা সিকিউরিটি গার্ডের ডিউটি এবং ডে-নাইট হিসেবে একসাথে ডিউটি
করানো হলেও বেতন দেয়া হতো না।
এর প্রতিবাদ
করলে মানসিক নির্যাতন চালানো, প্রশাসনের ভয় দেখানো, জরিমানা এবং ক্ষতিপূরণের ভয় দেখানোসহ
অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হতো।
নারী ভুক্তভোগীরা
জানান, পারিবারিক কলহ এবং পরিবার থেকে বিভিন্ন সমস্যার কারণে অনলাইনে লোভনীয় চাকরির
বিজ্ঞাপন দেখে তারা ঢাকা শহরে চলে আসে। তারা চাকরিতে যোগ দেয়ার পর চক্রের এমডি আমির
হামজা মেয়েদের বিভিন্ন সময় কুপ্রস্তাব দেয়াসহ প্রায়ই শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে থাকে।
যারা তার প্রস্তাবে
রাজি হয় তাদের সে অফিসে ডিউটি দেয়া, বিয়ের প্রলোভন দেখানো এবং নিয়মিত বেতন দেয়।
যারা তার প্রস্তাবে রাজি হয় না সেসব মেয়েদের সাথে খারাপ ব্যবহার, মানসিক নির্যাতন,
জোর করে আটকে রাখা এবং তাদের দিয়ে অতিরিক্ত ডিউটি করানো হতো।
র্যাব জানায়,
রিয়েল ফোর্স সিকিউরিটিতে কর্মরত সদস্যদের সিকিউরিটি বাবদ যে ধরনের নিরাপত্তা সামগ্রী
সরবরাহ করা হয়েছে, তা বৈধ নয়। নিয়ম বিটিআরসি থেকে অনুমোদন নেয়া। যারা এসব নিরাপত্তা
সামগ্রী সরবরাহ করেছে তাদের সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়া হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা
নেয়া হবে।
আমির হামজার
বিরুদ্ধে ২০০৬ সালে চট্টগ্রাম হালি শহরে একটি চুরির মামলা রয়েছে। পাশাপাশি ২৩ ফেব্রুয়ারি
নারায়ণগঞ্জে এই কোম্পানির এক সিকিউরিটি গার্ড আনোয়ার হোসেনের মরদেহ পাওয়া যায়। সে সময়
আমির হামজা আত্মগোপনে ছিলেন। তার বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ প্রক্রিয়াধীন।