
ফাইল ছবি
অর্থনীতি পড়তে গিয়ে পড়তে হয়েছিল জনবিজ্ঞান। যতটুকু মনে পড়ে শ্রদ্ধেয় লেখক অধ্যাপক মনোতোষ চক্রবর্তী তার জনবিজ্ঞান বইয়ে জনসংখ্যা অভিক্ষেপ ধারণাটির বিশদ বর্ণনা দিয়েছিলেন। যার সারকথা হলো, বিশ্বে বাড়ছে জনসংখ্যা। তবে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে সে হারে বাড়ছে না উৎপাদন। ভবিষ্যতে বাড়তি জনসংখ্যার জন্য দেখা দিতে পারে জ্বালানি সংকট। সংকট মোকাবিলায় সমুদ্রে জ্বালানি খোঁজার জন্য তাগিদ দিয়েছিলেন তিনি।
তবে একথা তো সত্যি যে, পৃথিবীর কোনো দেশই সকল পণ্য উৎপাদনে স্বাধীন নয়। নয় সমান পারদর্শী বা সক্ষম। রয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদেও পার্থক্য, রয়েছে অপ্রতুলতা। বিশ্বের একেক দেশ একেক প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশই মূলধন যন্ত্রপাতির অভাবে প্রাকৃতিক সম্পদের অনুসন্ধান কার্যক্রম চালাতে পারে না। আবার সন্ধান পেলেও তা উত্তোলনের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও কারিগরি জ্ঞান সম্পন্ন দক্ষ জনশক্তির অভাব রয়েছে অনেক দেশেই। ফলে অভ্যন্তরীণ চাহিদার যোগান নিশ্চিত করতে নির্ভরশীল হতে হয় অন্যান্য দেশের। খাদ্যশস্য, জ্বালানিসহ বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী আমদানির মাধ্যমে পূরণ করতে হয় দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা। সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ডলারের বিনিময় মূল্যবৃদ্ধি বাধ সেধেছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে। খাদ্যপণ্যসহ জ্বালানি আমদানিতে দেশে দেশে পড়েছে যুদ্ধের বিরূপ প্রভাব। আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম। জ্বালানি সংকটে ভুগছে পশ্চিমা বিশ্বসহ অনেক দেশ।
আমেরিকার জ্বালানি বিভাগের বরাত দিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য বলছে, ওপেক সদস্যভুক্ত ১৩টি দেশের মধ্যে মজুদ রয়েছে বিশ্বের মোট মজুদের ৮০ শতাংশ। আর ওপেকের সদস্য না হয়েও তেলের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মজুদ রয়েছে রাশিয়া এবং আমেরিকায়। বিশ্বের ক্রুয়েড অয়েলের ৪০ শতাংশ এবং পেট্রোলিয়ামের ৬০ শতাংশ উৎপাদন করে থাকে ওপেক। ২০২০ সালে দৈনিক ভিত্তিতে আমেরিকা দৈনিক উৎপাদন করে বিশ্বের মোট চাহিদার ২০ শতাংশ। এরপরই সৌদি আরবের অবস্থান। দেশটির উৎপাদন মোট ১২ শতাংশ। রাশিয়ার অবস্থান তৃতীয়, যা বিশ্বের মোট ১১ শতাংশ। কানাডা বিশ্বের মোট চাহিদার ৬ শতাংশ, চীন ৫, ইরাক ৪, ইউএই ৪, ব্রাজিল ৪, ইরান ৩ শতাংশ এবং কুয়েত ৩ শতাংশ তেল উৎপাদন করে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্ববাজারে তেলের দাম যুদ্ধের শুরু থেকেই ঊর্ধ্বমুখী। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের রাশিয়ার তেলসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও সরবরাহ সঙ্কটে তেল ও খাদ্যশস্য রপ্তানি করতে পারছে না রাশিয়া ও ইউক্রেন।এছাড়া, অপর আরেকটি দেশ ইরানের ওপর আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে তো আগে থেকেই। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বের মোট চাহিদার রাশিয়ার ১১ শতাংশ ও ইরানের ৩ শতাংশ তেলের সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায় তেলের বাজারে উত্তাপ ছড়াচ্ছিল ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের শুরু থেকেই। সেই থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল জ্বালানির দাম বাড়তে পারে। তবে শুক্রবার রাত ১২টার পর থেকে জ্বালানি তেলের দাম একবারে লিটারে ৩৪ থেকে ৪৬ টাকা দাম বাড়ানোর এত বেশি চাপ দেশের অর্থনীতি নিতে পারবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, দাম কিছুটা বাড়ানো হবে, এই আশঙ্কা ছিলো। তবে সেটা সহনীয় পর্যায়ে রাখা যেতো। যতটা বাড়ানো হয়েছে, তা দেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সবদিকে প্রভাব ফেলবে।
ইকোনোমিক টাইমস এর খবর অনুযায়ী বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম কমেছে। বৃহস্পতিবার রাতে ব্রেন্ট ক্রুড প্রতি ব্যারেল ৯৩ দশমিক ৮১ ডলারে নেমে আসে, যা গত ২১ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক হামলার পর সর্বনিম্ন।
চাল, ডাল, আটা, নুন, ভোজ্যতেল, ওষুধসহ বেড়েছে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম। দাম বেড়েছে সারের। তার ওপর জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনে বাড়িয়ে দিবে ব্যয়।
ব্যয় বাড়িয়ে দিবে মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীদের। কৃষিকাজে ব্যবহৃত পাওয়ার টিলার ও ইঞ্জিন চালিত সেচ পাম্পসহ প্রভাব পড়বে দেশের গার্মেন্টস খাতে।
আর পরোক্ষ প্রভাব গিয়ে পড়বে কৃষিজাত পণ্যসহ বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন খরচে। ফলে বাড়বে দাম। ব্যয় বাড়বে জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয়ে। ভোগ ব্যয়ের ধারণা অনুযায়ী আয় বেড়ে গেলে যেভাবে মানুষ তাদের ভোগ ব্যয় বাড়িয়ে দেয়, কোনো কারণে হঠাৎ আয় কমে গেলে ভোগব্যয় সেভাবে কমাতে পারে না। তখন ঋণ করে হলেও পূর্বের ভোগব্যয় বজায় রাখার চেষ্টা করে। একটু ঘুরিয়ে বলা যেতে পারে, যেহেতু আয় বাড়েনি স্থির ও নিম্ন আয়ের মানুষের। বেড়েছে জ্বালানিসহ নিত্যপণ্যের দাম, তাই পরিবারের ভোগ ব্যয় মিটাতে যে হিমসিম খাচ্ছেন বা খাবেন আর জীবনযাত্রার মানের ওপর যে বিরূপ প্রভাব পড়বে তা সহজেই অনুমেয়। যদিও বা খুব একটা প্রভাব পড়ে না ধনীদের জীবনে। কারণ মূল্যস্ফীতির সময় নিম্ন ও স্থির আয়ের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আয় বাড়ে ধনীদের। যেমন- পাম্পের মালিকরা পূর্বের দরে কেনা মজুদকৃত তেল নতুন দরেই বিক্রি করছেন ওই রাত থেকেই। অর্জন করছেন তারা বিপুল মুনাফা। এক্ষেত্রে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আল মারুফের উদ্যোগটি ছিল চোখে পড়ার মতো। জ্বালানির দাম বাড়ছে এমন সংবাদে পৌরশহরের তিনটি তেল পাম্পই সন্ধ্যার পর বন্ধ করে দিয়ে গা ঢাকা দিয়ে ছিলেন মালিকরা। ভোক্তাদের এমন অভিযোগে সহকারী কমিশনার (ভূমি) মাহমুদ আল হাসান ও পুলিশকে সাথে নিয়ে রাত বারটা পর্যন্ত পাম্পে দাঁড়িয়ে থেকে তেল নিতে সহায়তা করেছেন ভোক্তাদের। এমন উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারতো সারাদেশে। এতে কিছুটা হলেও উপকৃত হতেন সাধারণ মানুষ।
যুদ্ধজনিত কারণে জ্বালানির দামবৃদ্ধির বিষয়টি বাদ দিলেও শুধু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দাম বৃদ্ধি ঘটে তা নয়। দাম বৃদ্ধির পিছনে রয়েছে কিছু সংখ্যক অসাধু ব্যবসায়ীর হাত। যারা ভোক্তাদের স্বার্থ নয়, বরং নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণে সমাজ বিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত রয়েছে। মজুদদার, কালোবাজারি, মুনাফাখোর,
চোরাকারবারি অধিক লাভের আশায় দেশের অভ্যন্তরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর অবৈধভাবে মজুত করে বা বাজার থেকে সরিয়ে ফেলে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে তেল, চালসহ নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।আবার, যুদ্ধজনিত কারণে পণ্যের চাহিদা ও যোগানের মধ্যে ব্যবধান থাকায়ও মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে যোগান স্বাভাবিক থাকলেও অনেক সময় ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে যোগানে ঘাটতি দেখিয়ে মূল্যবৃদ্ধির মতো কাজটি করে থাকেন। এছাড়া রয়েছে সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনার অভাব। অবৈধ আয় উপার্জনকারীদের ক্রয় ক্ষমতা সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি যা প্রকারান্তরে দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। বাজার তদারকি ব্যবস্থায় ঘাটতিও মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে অনেকাংশে দায়ী।
জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পুরোপুরি আমদানি নির্ভর। এক্ষেত্রে বেশি দামে তেল কিনে কমদামে তেল বিক্রির সুযোগ খুব কম। তাই জ্বালানি তেলের দাম সহনীয় পর্যায়ে আনতে খুঁজতে হবে তেলের বিকল্প বাজার। বাড়াতে হবে সমুদ্রে গ্যাস, তেল অনুসন্ধান কার্যক্রম।
সে যাই হোক, সুযোগের সদ্ব্যবহার করে মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা যাতে জ্বালানি তেলের দামবৃদ্ধির অজুহাতে নিজেদের খেয়ালখুশি মতো অন্যান্য পণ্যের দাম নিয়ে সরকারের ভালো অর্জনগুলোকেও ফিকে করে দিতে না পারে সেদিকে নজরদারি জোরদার করা জরুরি। জ্বালানি তেলের দামবৃদ্ধির অজুহাতে পরিবহন ভাড়া যাতে লাগামহীন না বাড়ে কর্তৃপক্ষকে সেদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে।
পাশাপাশি চোরাচালানকারীরা যাতে পণ্য পাচার এবং মজুদদাররা যাতে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অধিক মুনাফা লুটতে না পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমলে সাথে সাথে তা সমন্বয় করা হবে সরকারের এমন ভাবনা অবশ্য ইতিবাচক। মূল্যবৃদ্ধির ধকল কাটিয়ে খেয়ে-পরে চিন্তাযুক্ত নয় বরং চিন্তামুক্তভাবে যাতে চলতে পারেন নিম্ন ও স্থির আয়ের মানুষ রাষ্ট্রের নিকট এতটুকুই প্রত্যাশা।