কোটি টাকার আলিশান বাড়ি বানিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে স্বাস্থ্য বিভাগের অফিস সহকারী

এস. কে সাহেদ, লালমনিরহাট
প্রকাশ: ১১ আগস্ট ২০২২, ০০:২০
মাহবুব আলম লিকু ও তার বিলাসবহুল বাড়ি। ছবি- লালমনিরহাট প্রতিনিধি
লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কেরানি পদে কর্মরত মাহবুব আলম লিকুর আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৫তলা বিলাসবহুল বাড়ি নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। চাকরি জীবনে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি করে তিনি এই সম্পত্তি গড়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো লালমনিরহাট জেলা সদর হাসপাতালে প্রধান অফিস সহকারী (কেরানী) পদে যোগদান করেন মাহবুব আলম লিকু। বন্ধুসুলভ ও চাটুকারি আচরণে খুব অল্প সময়ের মধ্যে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিদের মন জয় করে নেন তিনি। হয়ে যান তাদের পছন্দের মানুষ। সেই সাথে শুরু করেন হাসপাতালের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি।
অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালের ঔষধ চুরি সিন্ডিকেট তার হাত ধরেই তৈরি হয়। এছাড়া তিনি প্রতিবছর হাসপাতালের এমএসআর টেন্ডার ও রোগীর খাবারের টেন্ডারে তদবির বাণিজ্য, অর্থের বিনিময়ে রোগীর সার্টিফিকেট প্রদানসহ নানা দুর্নীতিতে জড়িত থাকেন।
সেখানে চাকরি অবস্থায় তিনি গত ২০১৪-১৫ অর্থ বছরের ভুয়া বিল ভাউচার প্রস্তুত করে হাসপাতালের ১৪ লাখ ৯৯ হাজার ৬৫৬ টাকা আত্মসাৎ করে। পরে সিভিল অডিট আপত্তির প্রেক্ষিতে গত ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই তদন্ত কমিটি গঠন করেন তৎকালীন সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. নুরুজ্জামান আহমেদ।
তদন্ত কমিটি টাকা আত্মসাতের সত্যতা পাওয়ায় আত্মসাৎকৃত টাকা ট্রেজারি চালানমূলে ফেরত দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। কয়েক দফায় সময় নিয়ে পৈত্রিক জমিসহ বসবাসের একমাত্র বাড়িটিও বিক্রি করে ওই টাকা ফেরত দিয়ে সে যাত্রা শেষ রক্ষা পান মাহবুব আলম লিকু। এছাড়া তাকে শাস্তিমূলক দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলিসহ দীর্ঘদিন সাময়িক বরখাস্ত করে রাখে স্বাস্থ্য বিভাগ।
এদিকে কৌশলী কেরানী মাহবুব আলম লিকু সখ্যতা গড়ে তোলেন পাশের উপজেলার মন্ত্রী পরিবারের সাথে।
অবশেষে ক্ষমতার জোরে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্তা ব্যক্তিদের ম্যানেজ করে বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহারসহ মন্ত্রীর নিজ এলাকা কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলি হয়ে আসেন মাহবুব আলম লিকু। কিন্তু সেখানেও বিদ্যুৎ বিলসহ নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন তিনি। অবশেষে সেখান থেকে লিকুর নিজ এলাকা আদিতমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বদলি করা হয়।
সেখানে যোগদানের পর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. তৌফিক আহমেদের সঙ্গে বেশ সখ্যতা গড়ে তোলেন কৌশলী প্রধান অফিস সহকারী মাহবুব আলম লিকু। আর শুরু করেন নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি। হাসপাতালের বড় কর্তাকে ম্যানেজ করে নিজ ইচ্ছেমতো পরিচালনা করতে থাকেন পুরো হাসপাতাল। এসব অনিয়ম বা হয়রানির প্রতিবাদ করলে বড় কর্তাকে দিয়ে কর্মচারীদেরকে শোকজ বা উল্টো হয়রানি শুরু করেন।
একপর্যায়ে গত অর্থ বছরের শেষ দিকে ওই উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. তৌফিক আহমেদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে মাহবুব আলম লিকুর। অনিয়মের কারণে আর্থিক দায়িত্ব থেকে তাকে সরিয়ে দিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন ডা. তৌফিক আহমেদ। পরে নিজেকে বাঁচাতে প্রভাব খাটিয়ে হাসপাতালে কর্মরতদের একাংশ নিয়ে শুরু করেন গ্রুপিং।
একসময় প্রকাশ্যে দুইটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যায় হাসপাতালে কর্মরতরা। একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দেয় প্রধান অফিস সহকারী মাহবুব আলম লিকু ও অপর গ্রুপের নেতৃত্ব দেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. তৌফিক আহমেদ। এক পর্যায়ে কর্মকর্তা ডা. তৌফিক আহমেদের অপসারণ দাবী করেন এবং হাসপাতালে কর্মরত ৭জনকে নিয়ে একসাথে লালমনিরহাট সিভিল সার্জন বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দেন।
এছাড়া স্থানীয় লোকদের উস্কে দিয়ে কর্মকর্তা ডা. তৌফিক আহমেদের অপসারণের দাবিতে মানববন্ধনের আয়োজন করেন।
এদিকে এসব অনিয়ম দুর্নীতি করে সে অল্প সময়ের মধ্যে বনে যান ‘আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ’। বর্তমানে দুর্নীতিবাজ মাহবুব আলম লিকু কোটি কোটি টাকার মালিক। শহরের টেলিফোন ভবন সংলগ্ন টিএন্ডটি এলাকায় গড়ে তুলেছেন দৃষ্টিনন্দন ৫তলা বিশিষ্ট বিলাসবহুল বাড়ি। জেলা শহরে যে ক’টি দৃষ্টিনন্দন আলিশান বাড়ি রয়েছে তার মধ্যে এটি অন্যতম। এছাড়া রয়েছে নামে বেনামে ব্যাংক একাউন্ট।
লোকমুখে প্রশ্ন উঠেছে, হাসপাতালের অফিস সহকারী পদে (কেরানী) চাকরি করে কিভাবে এতো বড় বাড়ি নির্মাণ করলো! আড়াই কোটি টাকা মূল্যের বিলাসবহুল বাড়ি তৈরির টাকার উৎস কোথায়?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তার নিকট আত্মীয়স্বজনরা জানান, বাড়িটি নির্মাণের কয়েক বছর আগেও অর্থ কষ্টে ছিল মাহবুব। হঠাৎ বিশাল বাড়ি নির্মাণে আমরা অবাক। এতো টাকা কোথায় পেলেন? তিনি কি রূপকথার আলাউদ্দিনের চেরাগ পেয়েছেন? কেরানী পদে চাকরি করে সন্তানদের বড় প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ায় খরচ করেও এত বড় বাড়ি নির্মাণ দুর্নীতি ছাড়া অসম্ভব বলেও মন্তব্য করেন তারা।
কয়েকজন প্রতিবেশী জানান, আলিশান ওই বাড়িতে ভাড়া থাকেন উচ্চপদস্থ বিভিন্ন কর্মকর্তা। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন তদবির বাণিজ্যও করছেন তিনি। তাই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মানুষ আসে এ বাড়িতে। এজন্য তার বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করেন না।
এসকল বিষয়ে আলোচ্য বাড়িটির মালিক আদিতমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্রধান অফিস সহকারী (কেরানী) মাহবুব আলম লিকু বলেন, আমি অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে জড়িত নই। বাড়িটি হাউজিং ঋণে নির্মাণ করেছি। বিভিন্ন ব্যাংকেও ঋণ করেছি। বাড়ি নির্মাণ করে আমি এখন ঋণগ্রস্ত। তবে ব্যাংক কিভাবে এতো টাকা ঋণ দিলো এবং স্বল্প সময়ে অর্জিত অর্থের উৎস ও ঘন ঘন বদলির ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি কোন মন্তব্য না করে অন্য প্রসঙ্গে কথা বলা শুরু করেন।
এ বিষয়ে লালমনিরহাট সিভিল সার্জন ডা: নির্মলেন্দু বলেন, আদিতমারী উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ক্লার্ক পদে কর্মরত মাহবুব আলম লিকুর ৫তলা বিশিষ্ট বিলাসবহুল বাড়ির খবর জেনেছি। তবে তার বিরুদ্ধে লিখিত কোন অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেয়া হবে।