
বক্তব্য রাখছেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। ছবি: সংগৃহীত
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বর্তমানে বিশ্বের এমন কোনো দেশ অবশিষ্ট নেই যেখানে পুঁজিবাদের বিকাশে ‘লুণ্ঠন’ হচ্ছে না কিংবা হয়নি। তবে বাংলাদেশের অর্থনীতির ‘লুণ্ঠন’ আরো বেশি প্রকট। দেশের অর্থনীতিতে তিন ধরনের লুণ্ঠন হয়েছে। বাংলাদেশে প্রথমে আর্থিক খাতে লুণ্ঠন হয়েছে, পরে হয়েছে পুঁজিবাজারে। সর্বশেষ সরকারি প্রণোদনায় অতিমূল্যায়িত প্রকল্পের মাধ্যমে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠান লুণ্ঠন করছে।
তিনি আরো বলেন, যে বিষয়টি সবচেয়ে ভয়ানক সেটি হলো, অন্যান্য দেশে বিচার ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। যার ফলে জবাবদিহিতা ও পরিস্থিতি উত্তরণের একটা সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে লুণ্ঠনের পরে বিচার ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। এখানে প্রতিযোগিতার চেয়ে সংযোগকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ফলে জবাবদিহির জায়গা দুর্বল হয়ে গেছে। এর কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের রাজনৈতিক শক্তি।
গতকাল মঙ্গলবার (৩০ আগস্ট) রাজধানীর পুরানা পল্টনে ইআরএফ কার্যালয়ে অর্থনৈতিক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত ‘ইআরএফ সংলাপ’ অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
সংলাপে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সভাপতি শারমিন রিনভী এবং অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ইআরএফ সাধারণ সম্পাদক এসএম রাশিদুল ইসলাম।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, দেশের অর্থনীতিতে চার ধরনের বিচ্যুতি রয়েছে। বিচ্যুতিগুলো হলো- ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ আশানুরূপ বৃদ্ধি না পাওয়া, কর রাজস্ব আহরণে দুর্বলতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত বিনিয়োগ এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে বৈষম্য।
এসব বিচ্যুতি সঠিকভাবে মোকাবিলা করা না গেলে পরবর্তী উত্তরণ পর্যায়ে পৌঁছানো ও অর্জন করা সম্ভব হবে না বলে মন্তব্য করেছেন দেবপ্রিয়।
তিনি বলেন, সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি জটিল এবং সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশে ও বিশ্বে এরকম পরিস্থিতি হতে পারে, তা আগেই বলা হয়েছিল। পাশাপাশি এ ধরনের সংকট মোকাবিলায় স্থিতিকরণ কর্মসূচি জরুরি বলে উল্লেখ করা হয়েছিল, যে কারণে জিডিপির অভিলাষ সংযত করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আর্থিক ও বৈদেশিক লেনদেন নীতি গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন অনেকে। বৈদেশিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ, বিনিময়হার এবং মূল্যস্ফীতিতে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, দ্রুত তার অবসান হবে না।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের মূল সমস্যা বৈদেশিক লেনদেনে নয়, মূল সমস্যা আর্থিক খাতের দুর্বলতা ও প্রয়োজনীয় রাজস্ব সংগ্রহ না হওয়া। যে কারণে জ্বালানিতে ভর্তুকি ও দরিদ্রদের খাদ্য সহায়তা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বর্তমানে প্রবৃদ্ধি মূলত রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ দ্বারা ধাবিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগের যে ভূমিকা দরকার ছিল, তা চোখে পড়েনি। বহুদিন ধরেই জিডিপির ২৩-২৪ শতাংশে আটকে আছে। এর বিপরীতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ পাঁচ-ছয় শতাংশ থেকে বেড়ে সাত-আট শতাংশে উন্নীত হয়েছে। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগও (এফডিআই) বাড়েনি। এফডিআই জিডিপির এক শতাংশের নিচে, যা গতিশীল অর্থনীতির জন্য যথেষ্ট নয়।
তিনি আরো বলেন, রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বেশি হলে সেগুলোর সুবিধা নিয়ে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বাড়ে, কিন্তু বাংলাদেশে সেটা ঘটেনি। বাংলাদেশের অবস্থা এক ইঞ্জিনে চলা অ্যারোপ্লেনের মতো, যে বেশি দূর যেতে পারে না। কিছু দূর চলার পর রানওয়ে খুঁজতে থাকে।
দেবপ্রিয় বলেন, এক দশক ধরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হচ্ছে পাঁচ থেকে সাত শতাংশ হারে। এর অর্থ আয় বাড়ছে। তাহলে কর সংগ্রহ হচ্ছে না কেন? তাহলে কি সংগ্রহ করা হচ্ছে না? নাকি হিসেবের গড়মিল আছে। কর সংগ্রহ করতে না পারার কারণে এখন আমদানি করা যাচ্ছে না। খাদ্য সহায়তা বাড়ানো যাচ্ছে না। শুল্ক কমাতে পারছে না সরকার। পরোক্ষ কর থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করতে হচ্ছে বেশি, যা সাধারণ মানুষকে চাপে ফেলছে।
তিনি বলেন, সরকার ভৌত অবকাঠামোতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করছে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সেই বরাদ্দ থাকছে না। ২০টি মেগা প্রকল্পের জন্য জিডিপির দুই শতাংশ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। অথচ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ থাকছে জিডিপির এক শতাংশ। শিক্ষায়ও সমপরিমাণ। রাজনৈতিক শক্তির বৈধতার জন্য খুব দ্রুততার সাথে দৃশ্যমান ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন করা হচ্ছে। রাজনৈতিক ঘাটতি পূরণের চেষ্টা হচ্ছে। কারণ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের বিনিয়োগের ফলাফল আসতে দশকের বেশি সময় লাগে। রাজনৈতিক চক্রে এই সময় নেই।
তিনি আরো বলেন, সরকারের রাজনৈতিক দর্শনের কারণে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে বৈষম্য হচ্ছে। করোনার সময় সহায়তা বিতরণে বড় ধরনের বৈষম্য দেখা দিয়েছে। যার যা প্রাপ্য তা নথিভুক্ত হয়নি। ফলে প্রমাণিত হয়েছে সরকারের সেবা পাওয়ায় দুর্বল নাগরিকদের অভিগমন সহজ নয়।
দেবপ্রিয় বলেন, দেশে প্রতিযোগিতাপূর্ণ ব্যবসায়িক পরিবেশ তৈরি হচ্ছে না। বিশেষ জায়গা থেকে বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এতে মেধাভিত্তিক ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ব্যক্তি বিনিয়োগ বিকশিত হচ্ছে না। এর ফলে ক্ষতি হচ্ছে সরকার, মানুষ ও দেশের। বিদ্যুৎ জ্বালানিতে প্রতিযোগিতার সুযোগ তুলে নেয়া হয়েছে। বিচারের সুযোগও তুলে নেয়া হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের অর্জনও আছে, বিচ্যুতিও আছে। এই বিচ্যুতি অর্জনকে দুর্বল করে দিতে পারে। টেকসই অবস্থা কমিয়ে দিতে পারে। তবে বাংলাদেশ অনেক সমস্যা উত্তরণ করে এই অবস্থায় এসেছে।