
এখন এ দৃশ্যের দেখা মেলে কদাচিৎ
ভরা বর্ষায়ও এবার বৃষ্টি নিরুদ্দেশ। ক্রমেই বাড়ছে তাপ। বৃষ্টি নিয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসও মিলছে না। প্রকৃতির এমন হেঁয়ালি আচরণে শুকিয়ে গেছে খাল-বিল। উধাও দেশি ছোট মাছ। বাজারে যে মাছের দেখা মিলছে সেগুলোর চড়া দাম। এ সবের জন্য জেলেরা দায়ী করছেন টানা গরম ও খরাকে।
অবশ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়ার বিরূপ চরিত্র ফুটে উঠছে। এটি কয়েক বছরের চিত্র। মানবসৃষ্ট কারণেও খাল-বিল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে দেশি মাছ। বছরের পর বছর দখল-দূষণে মুমূর্ষু জলাশয়। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে পড়ার আশঙ্কা তাদের।
মৎস্য অধিদপ্তর বলছে, জলবায়ুর প্রভাব, কারেন্ট জালের অবৈধ ব্যবহার, ফসলের জমিতে অপরিকল্পিত কীটনাশক ব্যবহার, জলাশয় দূষণ, বাঁধ নির্মাণ, খাল ও বিলের গভীরতা কমে যাওয়া, ডোবা ও জলাশয় ভরাট হওয়া, মা মাছের আবাসস্থলের অভাব, মা মাছের ডিম ছাড়ার আগেই ধরে ফেলা, খাল-বিলে বিষ প্রয়োগ করে ছেঁকে মাছ ধরা, বিদেশি রাক্ষুসে মাছের চাষ, মাছের প্রজননে ব্যাঘাত ঘটানো ও খালে-বিলে বিষাক্ত বর্জ্য ফেলার কারণে দেশি মাছ এখন হুমকিতে।
বর্ষায়ও খাল-বিলে নেই দেশি মাছ
বর্ষা মৌসুমে স্থানীয় মাছের জোগান থাকে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এ বছর পরিস্থিতি অনেকটাই আলাদা। আষাঢ়-শ্রাবণ পেরিয়ে গেলেও নেই বৃষ্টির দেখা। খাল-বিল প্রায় শুকিয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত যেটুকু মাছ সরবরাহ হচ্ছে, তা আসছে নদী ও পুকুর থেকে।
মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, কম বৃষ্টির কারণে খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়ায় অর্ধেকেরও বেশি মাছের জোগান বন্ধ হয়ে গেছে। ভয়ের কারণ আছে আরও। বৃষ্টি না হলে পুকুরেও সঠিক সময়ের মধ্যে মাছের পোনা ছাড়া যাবে না। আর সেটা না হলে বছরে তিনবার মাছ চাষ করা যাবে না।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের মাছের আড়তদার আব্দুর রহমান বললেন, স্থানীয় মাছের আমদানি প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। আগে দিনে পাঁচশ কেজি স্থানীয় মাছ বেচাকেনা করলে এখন সেটা দাঁড়িয়েছে আড়াইশ কেজি। কারণ স্থানীয় মাছের সরবরাহ নেই।
মানবসৃষ্ট হুমকি
জেলে ও চাষিদের ছোট ছোট উদ্যোগে দেশে বছরে ১৬ লাখ টন মাছ উৎপাদিত হয়। উন্মুক্ত জলাশয় থেকে আহরণ করা এসব মাছের বেশির ভাগই দেশি প্রজাতির। এদের পুষ্টিমানও বেশি। কিন্তু ধারাবাহিক দূষণ ও অতিরিক্ত আহরণসহ নানা কারণে দেশি মাছের অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
মৎস্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশ, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট ও মৎস্য অধিদপ্তরের পৃথক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দেশি প্রজাতির ৯১টি মাছ বিলুপ্তির ঝুঁকিতে। এসব গবেষণায় প্রাকৃতিক উৎসের মাছের বেশ কিছু ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়েছে। মাছের বিচরণ এলাকা নদী, হাওর-বাঁওড় ও বিল দূষিত হয়ে যাচ্ছে। এতে বলা হয়েছে, রাজধানীর চারপাশের নদী- বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, বালু, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ এবং চট্টগ্রামের কর্ণফুলী প্রায় মাছশূন্য। এছাড়া দেশে এ পর্যন্ত ৩০টি আগ্রাসী প্রজাতির বিদেশি মাছ ঢুকে পড়েছে, যা দেশি ছোট মাছগুলো খেয়ে সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে। দেশের কৃষিকাজে প্রতিবছর প্রায় এক লাখ টন রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহৃত হয়, যা মাটি চুইয়ে জলাভূমিতে যায়। এর কারণে মাছের উৎপাদন কমছে। এছাড়া ধারাবাহিক দূষণ ও দখলের কারণে খাল-বিল ভরাট হওয়ায় মাছের বিচরণ কমে আসছে।
আইইউসিএনের ২০১৫ সালের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী কয়েকটি শ্রেণিতে মোট ৬৪ প্রজাতির মাছকে রেড লিস্ট বা লাল তালিকাভুক্ত করেছে, এর মানে হচ্ছে এসব প্রজাতির মাছ হয় প্রায় বিলুপ্ত, মহাবিপন্ন ও বিপন্ন অবস্থায় আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কানিজ ফাতেমা বলছেন, মাছের প্রজাতি হারিয়ে যাওয়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে তিনি প্রথমেই জলাশয় কমে যাওয়াকে দায়ী করেন। শহর ও গ্রাম দুইখানেই নদী-খালসহ সব ধরনের জলাশয়ের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এ কমার সঙ্গে দিনে দিনে কমছে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত মাছের পরিমাণও। কেবল দেশি জাত ও স্বাদের মাছই নয়, এর সঙ্গে কচ্ছপসহ নানা ধরনের জলজ প্রাণী ও সরীসৃপের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে রয়েছে জমিতে সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি, যা বৃষ্টিতে ধুয়ে খাল বিলসহ জলাশয়গুলোতে পড়ে। এর ফলে মাছের মৃত্যু ও প্রজনন হার মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। কলকারখানার বর্জ্য নিকটস্থ জলাশয়ে ফেলা হয়, তার ফলেও মাছ মরে যায়।
এর সঙ্গে অপরিকল্পিত মৎস্য আহরণ, প্রজনন মৌসুমে প্রজনন-সক্ষম মাছ ও পোনা ধরা, কারেন্ট জালের ব্যবহার এবং মাছের আবাসস্থল ধ্বংস করাকেও কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে বাংলাদেশ মৎস্য জাদুঘরের পরিচালক অধ্যাপক হোসেন জানান, বিদেশি মাছ চাষের কারণেও দেশি প্রজাতির মাছ কমে গেছে। এখানে তেলাপিয়া, কার্পজাতীয় মাছ আনা হয়েছে। আবার এক সময় আফ্রিকান মাগুর আনা হয়েছিল। কয়েক বছর আগে আনা হলো পিরানহা- এগুলো দেশি মাছের খাবার ও বাসস্থল দখল করত। এখন নতুন করে হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে সাকার ফিশ। অ্যাকুরিয়ামের এ মাছ জলাশয়ের সব ছোট মাছ ধ্বংস করে দিচ্ছে। বিদেশি প্রজাতির মাছগুলো দেশি প্রজাতির মাছ খেয়ে ফেলছে। তিনি বলেন, আফ্রিকান মাগুরের চাষ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও বিদেশি মাছের প্রজাতির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় কুলিয়ে উঠতে না পেরে অনেক দেশি মাছ কমে গেছে।
বাংলাদেশে দেশি অনেক প্রজাতির মাছের হার কমে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে গত দুই দশকে কৃত্রিম প্রজনন ও চাষের মাধ্যমে মাছের সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এখন দেশে প্রতিবছর সাড়ে ৪২ লাখ টনেরও বেশি মাছ উৎপাদন হচ্ছে। এর মধ্যে নদী, বিল ও হাওরসহ উন্মুক্ত জলাশয় থেকে ২৫ শতাংশ, পুকুর, ডোবার মতো বদ্ধ জলাশয় থেকে ৫৭ শতাংশ এবং বাকি অংশ সমুদ্র থেকে উৎপাদিত হচ্ছে। দেশে ৮ লাখ হেক্টর বদ্ধ জলাশয়ে মাছ চাষ হয়।
প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর রাকিবুল আমিন বলেন, দেশের একেকটি প্রজাতির মাছ মানে নিত্যনতুন প্রাণী বা খাদ্যতালিকার নতুন উপাদান নয়। প্রতিটি মাছ একেকটি জিনগত সম্পদ। হাজার বছরের পথপরিক্রমায় তারা একেকটি জলাশয়ে বসবাস করে। ফলে মাছের প্রজাতি রক্ষা করতে তাদের বসবাসের জলাশয়কে সুরক্ষা দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, মৎস্য সম্পদের বৈচিত্র্য জানতে জরিপ হওয়া উচিত। এতে জানা যাবে, কোন ধরনের মাছ এখানে বেশি আছে, কোন প্রজাতির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। কোন প্রজাতির মাছ আহরণ করা যাবে, কোনটা করা যাবে না, তাও নির্দিষ্ট করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, আমরা দেশের বেশির ভাগ মাছের জাত সংগ্রহ করে একটি জীবন্ত জিন ব্যাংক তৈরি করেছি। সেগুলো থেকে জনপ্রিয় জাতগুলোর চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন করে কৃষকের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছি। আশা করি, আগামী কয়েক বছরে দেশে মাছের উৎপাদন আরও বাড়ানো যাবে।
হাওরেও আসছে ইলিশের মতো নিষেধাজ্ঞা
অপরিকল্পিতভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের ফলে নদীর সঙ্গে হাওর ও বিলের সংযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। এতে মাছের স্বাভাবিক বিচরণ নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া শস্য উৎপাদনের জন্য মাত্রাতিরিক্ত সার ও কীটনাশক ব্যবহার, শিল্প কারখানা এবং নগরের দূষিত বর্জ্য নদী ও জলাশয়ে নিক্ষেপের ফলে ক্রমাগত পানি দূষিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে অতিমাত্রায় নির্বিচারে মৎস্য আহরণ, অবৈধ জাল দিয়ে মাছ আহরণসহ বিভিন্ন কারণে দেশি অনেক মাছ এখন বিলুপ্তির পথে। এ অবস্থায় হাওরের দেশি প্রজাতির মাছ রক্ষায় ইলিশের মতোই পদ্ধতি অবলম্বন করতে চায় সরকার। ইতোমধ্যে গবেষকরা বের করেছেন ছোট মাছের প্রজননকাল। প্রজনন মৌসুমে স্বল্প সময়ের জন্য মাছ ধরা নিষিদ্ধ রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। হাওরে দেশি মাছের উৎপাদন বাড়াতে একটি প্রকল্পও চালু করতে চায় সরকার।
হাওরের সন্তান পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, হাওরাঞ্চলের মাছ নিয়ে গবেষণা করা জরুরি। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন হাওরে আর রাস্তা নির্মাণ করা হবে না। পাখির যেমন চলাচলের রুট আছে, মাছেরও নিশ্চয়ই চলাচলের রুট আছে। সড়ক নির্মাণ করলে শুধু পানির জন্য নয়, মাছের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। হাওরের মাছ রক্ষায় কোনো প্রকল্পের প্রস্তাব এলে তিনি বিষয়টি বিবেচনা করবেন বলেও আশ্বাস দেন।