Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের নামে ওষুধের দোকান বন্ধ!

Icon

মনজুরুল হক

প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১:১০

বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের নামে ওষুধের দোকান বন্ধ!

প্রতীকী ছবি

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পরে দেশের সকল পণ্যমূল্য বেড়ে গেছে। তাতে নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের মানুষদের অবর্ণনীয় কষ্ট হচ্ছে। জ্বালানি তেলের অভাবে সবচেয়ে বেশি সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন। দিনে-রাতে কমপক্ষে ৫-৬ ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হচ্ছে। এই সংকটে সবচেয়ে আগে দরকার ব্যয় কমানো এবং এনার্জি ব্যবহারে কৃচ্ছ্রসাধন।

ইতোমধ্যে অফিস সময় পরিবর্তন করে বিদ্যুৎ ব্যবহার কমানোর আদেশ জারি হয়েছে। এটা ভালো উদ্যোগ, তবে চূড়ান্ত নয়, কারণ সরকারি দপ্তরগুলো এক একটা ‘শ্বেত হস্তী’। কিন্তু এই বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের নামে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র যে আদেশ জারি করেছেন সেটা বিদ্যুৎ ব্যবহারে মিতব্যয়িতা নয়। বরং মেয়রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ। খুব ছোট করে বললেও দেখা যাবে ঢাকা শহরে হাসপাতালগুলোর আশেপাশে এবং অন্যান্য লোকালয়ে সব মিলিয়ে একশটি ‘২৪ ঘণ্টা খোলা’ ওষুধের দোকান নেই। মেয়র গড়ে সকল ওষুধের দোকান রাত ১২টার পর বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।

মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, ‘হাসপাতাল সংযুক্ত ওষুধের দোকান ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার যৌক্তিকতা আমরা দেখি না।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের যেখানে রবিবার থেকে বৃহস্পতিবারে সুনির্দিষ্ট সময়ের পর, শুক্র-শনিবার ও রাতের বেলা চিকিৎসকই পাওয়া যায় না, সেখানে ওষুধের দোকান কেন খোলা রাখা হবে?’

তিনি কীভাবে ডাক্তার পাওয়া-না পাওয়াকে ওষুধের দোকানের খোলা থাকা মিলিয়ে বসলেন? ডাক্তার পাওয়া যাক বা না যাক, একজন রোগীর হাতে যে প্রেসক্রিপশন সেটা দেখিয়ে যদি তাকে রাত ৩টার সময় জীবনরক্ষাকারী ওষুধ কিনতে হয়, কী করে পারবেন? এখানে তো ডাক্তার পাওয়ার বিষয়টিই ওঠে না।

আসলেই কি রাতের বেলায় হাসপাতালে চিকিৎসক পাওয়া যায় না? স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলানের মতে ‘রাতে হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক থাকেন। এ বিষয়ে ডিএসসিসি মেয়র ভুল তথ্য দিয়েছেন। তার উচিত দুঃখ প্রকাশ করা।’ মেয়র যেটা বলেছেন, সেটা ভুল তথ্য। অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘অবশ্যই রাতে হাসপাতালে চিকিৎসক পাওয়া যায়। আমাদের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোতে ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসক থাকছেন। সারাদেশের হাসপাতালগুলোর জরুরি বিভাগে ২৪ ঘণ্টাই চিকিৎসক থাকছেন।’

শুধু যে চিকিৎসক থাকলেই ওষুধ লাগবে, এমন নয়। হাসপাতালে যে রোগী ভর্তি আছে, তার একটা প্রেসক্রিপশন করা হয়েছে। এখন রোগীর শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় রাতেও সেই প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ দরকার হতে পারে। আবার অনেকে হঠাৎ অসুস্থ হলে জরুরিভিত্তিতে তার ওষুধের দরকার হতে পারে। কারো হয়তো হার্টের রোগ আছে। চিকিৎসক তাকে বলেছেন বুকে ব্যথা অনুভব করলে কী ওষুধ খেতে হবে। রাতে যদি তার ব্যথা অনুভব হয়, তখন তিনি কী করবেন?’

বলা বাহুল্য; এই বিষয়গুলো মেয়রের বিবেচনায় নেই। এখন মেয়র যেহেতু বলেছেন রাতে চিকিৎসক থাকেন না, তাই তিনি ওষুধের দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন, তাহলে হাসপাতাল খোলা রেখে লাভ কী? তার মতে, রাতে চিকিৎসক নেই, তাহলে রাতে হাসপাতালও বন্ধ করে দেবে?

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারের আপত্তির পরও রাতে ওষুধের দোকান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত বদলায়নি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। সিটি করপোরেশনের এমন সিদ্ধান্তে বিব্রত খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও। দেশজুড়েও চলছে নানা সমালোচনা। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, রাত ১২টার পর ওষুধ বিক্রি বন্ধ বা হাসপাতালের সময়সীমা কমানো হয়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিংবা সরকার সিটি করপোরেশনকে এমন নির্দেশনা দেয়নি। ফার্মেসি ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এমন বক্তব্যেও কর্ণপাত করেনি ঢাকা দক্ষিণ সিটি।

মেয়র বলেন, ‘পাড়া-মহল্লার ওষুধের দোকানের জন্য আমরা রাত বারোটা পর্যন্ত সময় দিয়েছি এবং হাসপাতালের সঙ্গে যে ওষুধের দোকানগুলো রয়েছে- সেগুলোকে রাত দুইটা পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে যদি কোনো প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করতে চায়, তাহলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাছে লিখিতভাবে আবেদন করতে হবে। এখন থেকে ঢালাওভাবে কোনো সময়সূচি ছাড়া কেউ চলতে (কার্যক্রম পরিচালনা) পারবে না। সবাইকে একটা সময়সূচির মধ্যে আসতে হবে। তিনি বলেন, যে কোনো আইন বা নীতিমালা প্রয়োগ বা বাস্তবায়নে অবশ্যই কঠোর হতে হয়।’

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্য- স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, “এটা বিতর্কের বিষয় না। ওষুধের দোকান রাতেও খোলা রাখার বিষয়ে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে কথা বলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে। মেয়র সাহেবের সঙ্গে এ বিষয়ে আমার সরাসরি আলাপ হয়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করার কথা বলা হয়েছিল। তারা হয়তো সিটি করপোরেশনের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। স্বাস্থ্যসেবা ২৪ ঘণ্টার বিষয়। হাসপাতাল কখনো বন্ধ থাকে না। ছুটির দিনেও হাসপাতাল বন্ধ থাকে না। করোনা ভাইরাস মহামারির সময়ও তা বন্ধ থাকেনি। হাসপাতাল চালু থাকলে ওষুধও লাগবে। ওষুধ প্রয়োজন হলে কোত্থেকে নেবে? আমরা মনে করি ওষুধের দোকান খোলা রাখা প্রয়োজন।”

অবশেষে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পাশের তিন ওষুধের দোকানকে ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার অনুমতি দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। সার্বক্ষণিক দোকান খোলা রাখতে আবেদনের পর ওই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে ডিএসসিসি।

কার্যত দেখা যাবে ধীরে ধীরে সকল ওষুধের দোকান যারা ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখত জরুরি প্রয়োজন বিবেচনায়, তাদের সব দোকানই খোলা রাখার অনুমতি মিলবে, তবে তার জন্য বাড়তি আমলাতান্ত্রিক প্যাঁচ খুলতে হবে। মেয়র (বর্তমানে মন্ত্রী পদমর্যাদায়) বরাবর যথাযথ কারণদর্শিয়ে আবেদন করতে হবে। তারা আবেদন করার পর সদাশয় মন্ত্রী বিশেষ বিবেচনায় দোকান খোলা রাখার অনুমতি দেবেন! এই ‘বিশেষ বিবেচনা’ শব্দটি বাংলাদেশের ‘বজ্রআঁটুনি ফস্কা গেরো’ আমলাতন্ত্রের ‘অলঙ্কার’! এই অলঙ্কার আমলাতন্ত্রের বিশেষ পছন্দ। সেটা চালু করে এই সামান্য খোলা-বন্ধ বিষয়ে নিম্নস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি করার সুযোগ দেওয়া হলো।




Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫