Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

উন্নয়ন অবকাঠামোর বলি রাজধানীর জলাশয়

Icon

কেএম ওবায়দুল্লাহ

প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১:৫২

উন্নয়ন অবকাঠামোর বলি রাজধানীর জলাশয়

প্রতীকী ছবি

রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের বাসিন্দা আলী আকবর। আশির দশকে আশপাশের জমিতে ধান চাষ করেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। বর্তমান ইউজিসি ভবন, শেরেবাংলা গার্লস স্কুল যেখানে গড়ে উঠেছে সেখানে থাকা জলাশয়েই গোসল করতেন, সময়ে সময়ে নৌকাও চালাতেন। আজ যেন তার কাছে সব নিকট অতীত। মাঝেমধ্যে স্বপ্নও মনে হয়।

একে একে বড় সাতটি জলাশয় ভরাট করে সেখানে তৈরি করা হয়েছে পাসপোর্ট অফিস, এলজিইডি ভবন, আইডিবি ভবন, বেতার ভবনের নতুন বিল্ডিং, ইউজিসি নতুন ভবন, শেরেবাংলা বয়েজ স্কুল, লায়ন্স হাসপাতাল, ফিল্মআর্কাইভ ভবন, পরিবেশ অধিদপ্তর ভবন, মমতা বহুমুখী মার্কেট, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, জিটিসিএল কার্যালয়, কিডনি হাসপাতাল, নাক-কান গলা হাসপাতালসহ সরকারি অনেক অফিস।

ঢাকা গবেষকরা জানান, স্বাধীনতার আগেই শেরেবাংলা নগরকে নিয়ে মাস্টার প্ল্যান করেছিলেন আইয়ুব খান। স্থপতি লুই আই কান প্রণীত মহাপরিকল্পনায় তখনকার ম্যাপ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- মোহাম্মদপুর, শ্যামলী ও মিরপুরের মধ্যবর্তী এলাকাটিই বর্তমান শেরেবাংলা নগর। বাংলাদেশ সরকারও পরে রাজধানীর সীমা বাড়াতে এটিকে নিয়ে পরিকল্পনা করে। সরকারি অফিস-আদালত নির্মাণের জন্য আশির দশকে শুরু হয় ভূমি অধিগ্রহণ। তবে ওই এলাকার রূপ পাল্টাতে থাকে সংসদ ভবনকে ঘিরে। তখন শেরেবাংলা নগরে সংসদ ভবন ও এমপি হোস্টেল স্টাফ কোয়ার্টারই ছিল কেবল পাকা ভবন। বাকি বৃহৎ এলাকাজুড়ে ছিল টিনের ঘরবাড়ি, নিচু ভূমি আর জলাশয়। ২০০০ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত বেশ কিছু অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়, সে কাজ হয়েছে অবশ্য বেশ ধীর গতিতেই। ২০১০ সালের পর রাতারাতি ওই এলাকায় দাঁড়িয়ে যায় বড় বড় সব বিল্ডিং। যাত্রা শুরু হয় সুরম্য অট্টালিকার। এসব অবকাঠামো নির্মাণ করতে গিয়ে জলাশয় বা জলাধার সংরক্ষণের বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি একেবারেই।  

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এক সময় শেরেবাংলা নগরে ছোট-বড় অন্তত ১০টি জলাশয় ছিল। এর মধ্যে আইডিবি ভবন থেকে লায়ন্স হাসাপাতাল পর্যন্ত একটি; সংগীত কলেজের চারপাশে নিচু ভূমি ও জলাশয়; ইউজিসি ভবনের পাশে একটি; শেরেবাংলা বয়েজ স্কুল, এলজিইডি ভবন ও পাসপোর্ট অফিস এলাকাজুড়ে আরো একটি; জিটিসিএল, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, শ্যামলী এক নম্বর রোডের শেষ মাথা পর্যন্ত বিশাল ডোবা; বেতার ভবনের পেছনে একটি এবং শেরেবাংলা গার্লস স্কুলের পেছনে একটি বড় জলাশয় ছিল। বড় সাতটির আজ কোনো অস্তিত্বই নেই; কেবল ইউজিসি ভবন, বেতার ভবন ও শেরেবাংলা বয়েজ স্কুলের তিনটি জলাশয় আংশিক টিকে আছে। তবে অবকাঠামো উন্নয়নে সেগুলোও ভরাটের পরিকল্পনা চলছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। 

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সচিব ড. ফেরদৌস জামান তার ২২ বছরের কর্মজীবনের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘বর্তমান যেখানে বিজ্ঞান জাদুঘর, ডিএমডি বাজার রয়েছে, এদিক থেকে আমার সহকর্মীরা ৫০ পয়সা নৌকা ভাড়া দিয়ে আসতেন বলে শুনেছি। তবে আমি আসার আগেই এদিকের অনেক জলাশয় ভরাট হয়ে যায়। ইউজিসি ভবনটিও হয়েছে আমরা কাজে যোগ দেওয়ার অনেক আগে। ১৯৮৮ সালে এর কাজ শুরু হয়। উদ্বোধন হয় ৯৪ সালে। আমাদের এখানে এখনো একটি পুকুর আছে। তবে দখল-দূষণে সেটিও আজ প্রায় বিপন্ন।’ 

রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজের পৈতৃক ভূমি ছিল শেরেবাংলা নগরে। বর্তমানে তিনি সাহাবুদ্দিন স্কুলের সামনে পৈতৃক ভিটাতেই থাকেন। অতীত হাতড়িয়ে বলেন, ‘এখানে আমাদের বিস্তৃত জমি ছিল। ধান চাষও হতো। সংগীত ভবনের চারপাশে ছিল নিচু জমি। পুরো এলাকায় বেশ বড় বড় খাল-জলাশয় ছিল। মানুষ নৌকা দিয়ে যাতায়াত করত। ২০১০ সাল পর্যন্ত নৌকা ও সাঁকোতে যাতায়াত করেছি আমরা। কিন্তু সব এখন ভরাট হয়ে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘অপরিকল্পিতভাবে জলাশয়গুলো ভরাটের ফলে প্রাণ বৈচিত্র্যের তো ক্ষতি হয়েছেই, পাশাপাশি এলাকার আবহাওয়ায়ও মারাত্মক পরিবর্তন হয়ে গেছে। তারপরও এখনো যেসব ভবন নির্মাণ হচ্ছে, আমাদের দাবি থাকবে- সেগুলোতে যেন জলাশয় ও জলাধার রাখা হয়।’ 

শেরেবাংলা নগরের মতোই রাজধানীর বাকি এলাকাগুলোর চিত্র। রাজধানীর পোস্তগোলার বাসিন্দা মো. মাসুদ। তিনি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরও। তার বাড়ির পাশেই ছিল পোস্তগোলা পুকুর। তার শৈশব কেটেছে পুকুরে সাঁতার কেটে, নৌকা বেয়ে। ছোটবেলার স্মৃতিমাখা সেই পুকুরটি ভরাট হয়ে গেছে বছর দশেক হলো। তিনি বলেন, শুধু সেটিই নয়। এ এলাকায় বেশ কয়েকটি পুকুর ছিল। এখন তুলাবাগিচা নামে যে এলাকাটি রয়েছে, তার পুরোটাই ছিল বিশাল পুকুর। হাবিব ম্যাচ ফ্যাক্টরির পেছনেও একটি পুকুর ছিল। তবে এগুলো ছিল ব্যক্তিমালিকানাধীন। ক্রমবর্ধমান নগরায়ণের ফলে ভরাট হয়ে গেছে পুকুরগুলো।

পোস্তগোলার পার্শ্ববর্তী মুরাদপুর এলাকায় ছিল দুটি ছোট পুকুর। পাশের এলাকা দোলাইরপাড়ে দুটি বড় ও গেণ্ডারিয়ায় অন্তত চারটি বড় পুকুর ছিল। এর মধ্যে মাত্র দুটি পুকুর এখনো টিকে আছে। বাকিগুলো হারিয়েছে নগরায়ণের চাপে। ২০২০ সালে রাজধানীর পুকুর নিয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি)। সংস্থাটির চেয়ারম্যান মোহাম্মাদ এজাজ জানান, ছোট-বড় মিলিয়ে ওই সময়ে ২৪১টি পুকুর পেয়েছিলাম। এর মধ্যে বেশির ভাগই ছিল ব্যক্তিমালিকানাধীন। গত দুই বছরে হয়তো অনেকগুলোই ভরাট হয়ে গেছে। দুঃখজনক ব্যাপার হলো এসব পুকুর সংরক্ষণের জন্য ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এখনো কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি নগরে পুকুর, দিঘি বা এ ধরনের জলাশয় বহু কারণে থাকা জরুরি। পুকুরে জলচর, স্থলচর, উভচর প্রাণীই বসবাস করতে পারে। পোষা ও বন্য প্রাণী খুব ভালোভাবে আবাসস্থল গড়ে তুলতে পারে। আর আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য সব ধরনের প্রাণীর সামঞ্জস্যপূর্ণ বসবাসের পরিবেশ থাকাটা খুবই দরকার। পুকুরের পানি অনেক ধরনের পরিবেশবান্ধব গাছপালা ও জীবজন্তুর জীবনপ্রণালিতে সহায়কের ভূমিকা পালন করে থাকে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা ছাড়াও অগ্নিকাণ্ডের সময় পানির সংস্থানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রেই পুকুর-দিঘির মতো জলাশয়ের একটা অনন্য ভূমিকা রয়েছে। একসময় এসব পুকুর ও দিঘি সুপেয় পানির উৎস হিসেবে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

সরকারের সদিচ্ছা থাকলে অবকাঠামো নির্মাণের সময় ছোট পরিসরে হলেও জলাশয়গুলো সংরক্ষণ করা যেত বলে মনে করছেন নগর বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। উল্টো টিকে থাকা জলাশয়গুলোও হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা জেগেছে। এ প্রসঙ্গে নগরবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সামনে একটি খাল ছিল। যেটি ইউজিসি ভবন হয়ে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে গিয়ে পড়ে। কিন্তু উন্নয়নের নামে সেই খালটি মেরে ফেলা হয়েছে। একইভাবে কল্যাণপুর খালের বড় অংশ দখল হয়ে গেছে এরই মধ্যে। এভাবে জলাশয় ও খাল ধ্বংস করে অবকাঠামো নির্মাণ করায় যথাযথ কর্তৃপক্ষকে একদিন অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দেখেছি অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে পুরান ঢাকা আজ জলজটের নগরে পরিণত হয়েছে। একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে শেরেবাংলা নগরেও। এখানে পানিধারণের কোনো স্থান অবশিষ্ট নেই। শুধু তাই নয়, অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটলে পানি নেওয়ারও কোনো উৎস রাখা হয়নি। সংশ্লিষ্টদের অবশ্যই উন্মুক্ত জলাশয় নিশ্চিত করে অবকাঠামো উন্নয়নের দরকার ছিল।’  

ক্রমবর্ধমান নগরায়ণে প্রাণবৈচিত্র্য এবং জনজীবনের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানাধীন পুকুর ভরাটও আইনত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু সে আইনের কোনো প্রয়োগ না থাকায় ক্রমাগত ভরাট হচ্ছে ঢাকার পুকুরগুলো। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ এবং বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এ স্পষ্ট বলা আছে, ব্যক্তিমালিকানাধীন জলাশয় পুকুর ভরাট করা যাবে না। সম্প্রতি উচ্চ আদালতও এ সম্পর্কে একটি রায় দিয়েছেন। সেখানেও একই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেশে এখন এত পরিমাণে নদী-খাল ভরাট হচ্ছে যে আমাদের পুকুর ভরাট নিয়ে ভাবার সময় নেই। আমাদের দাবি হলো, অতি দ্রুত সরকার এ পুকুরগুলো চিহ্নিত করে দিক। সাইনবোর্ড টাঙিয়ে এগুলোকে সংরক্ষিত ঘোষণা করুক। প্রয়োজনে রাজধানীর পুকুরগুলো সরকার অধিভুক্ত করুক। পুরান ঢাকায় অনেক এলাকা পুকুরশূন্য। সেখানে আগুন লাগলে পানি পাওয়া যায় না। সুতরাং বিষয়টিকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।’ 

এদিকে পুকুর সংরক্ষণের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন বলেন, ‘আমরা পুকুর সংরক্ষণের জন্য কোনো ধরনের নির্দেশনা পাইনি। পেলে অবশ্যই সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।’ 

জানতে চাইলে স্থাপত্য অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক স্থপতি (জোন-২) আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘কোনো জলাধার বা জলাশয় ভরাট করে যেন অবকাঠামো নির্মাণ না হয় সে বিষয়ে আমরা সব সময়ই সচেতন। শেরেবাংলা নগরের অবকাঠামো উন্নয়নেও জলাশয় সংরক্ষণের বিষয়টি কঠোরভাবে নজরে রেখেছি। তবে সরকার যদি কোনো জলাধার ভরাটের প্রয়োজন মনে করে তাহলে উপরের মহলের পরামর্শে ও নানান সমীক্ষার আলোকেই নিশ্চয়ই করেছে। সে ব্যপারে আমাদের কিছু করার ছিল না, কিছু করারও নেই।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫