Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

আইসিজের রায়

রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে কী করবে বাংলাদেশ

Icon

মাসুদুর রহমান

প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৯:২৪

রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে কী করবে বাংলাদেশ

রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের ওপর পড়েছে। তাই এ নিয়ে বাংলাদেশকে কাজ করে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। 

তবে রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) অন্তর্বর্তী আদেশ দেওয়ার পর এ ব্যাপারে বাংলাদেশের দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে। 

যদিও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের এ আদালতে মামলাটি করেছে পশ্চিম আফ্রিকার ছোট মুসলিম রাষ্ট্র গাম্বিয়া। কিন্তু বাংলাদেশের সহায়তা ছাড়া মামলাটিতে চূড়ান্ত বিজয় লাভ করা মোটেই সম্ভব নয়। অন্তর্বর্তী আদেশ বাস্তবায়নও কঠিন। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে।

রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধে আইসিজেতে দ্রুত মামলা করা একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) এ মামলা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে গাম্বিয়া মামলা করতে আগ্রহী হয়। গাম্বিয়া তার দেশের মানবাধিকারের রেকর্ড ভালো করার লক্ষ্যে এ মামলা করেছে। পাশাপাশি দেশটির আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল আবুবকর তাম্বাদু আইসিজেতে আগেও বসনিয়া হার্জেগোভিনায় গণহত্যা মামলা পরিচালনায় যুক্ত ছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার কারণে গাম্বিয়া মামলা করে। 

তবে মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে মূল প্রমাণ সরবরাহ করেছে জাতিসংঘ গঠিত ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি। ২০১৯ সালের নভেম্বরে মামলা করার পর ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। দ্য হেগে পিস প্যালেসে অনুষ্ঠিত শুনানিতে মামলাটি আমলে নেয়া ও জরুরিভিত্তিতে কতিপয় পদক্ষেপ গ্রহণের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হয়। 

গাম্বিয়ার পক্ষ থেকে যেসব যুক্তি ও প্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলো মূলত জাতিসংঘ মানবাধিকার হাই কমিশনের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির মাঠপর্যায় থেকে তুলে আনা তথ্যসহ অপরাপর আলামত। ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটিকে মিয়ানমার তাদের দেশে কাজ করার অনুমতি দেয়নি। ফলে এই কমিটিকে বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মাঝে কাজ করতে হয়। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের মাঝে ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটিকে কাজ করার অনুমতি দিয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের লজিস্টিক সহায়তাও দিয়েছে। এতে করে অল্প সময়ের মধ্যেই রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার শুরু করা সম্ভব হয়েছে। 

আদালতে গণহত্যার মূল বিষয়গুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনার আগে জরুরিভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ নেয়ার জন্য অনুরোধ রেখেছিল গাম্বিয়া। কারণ আন্তর্জাতিক আদালত মনে করে, বিচার চলাকালে আরো নিষ্ঠুর ঘটনা ঘটবে, যার প্রতিকার জরুরি ভিত্তিতে হওয়া প্রয়োজন। ছয়টি অন্তর্বর্তী আদেশ চেয়েছিল গাম্বিয়া। আদালত চারটি আদেশ দিয়েছেন। দুটি আবেদন গ্রহণ করেননি। 

এ চারটি আদেশের মধ্যে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের ওপর শারীরিক, মানসিক কিংবা কোনো প্রকার নির্যাতন-নিপীড়ন চালানো যাবে না। দ্বিতীয় হলো, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী, অন্য কোনো বাহিনী, কোনো বেসামরিক গ্রুপ, কিংবা কেউ যেন রোহিঙ্গাদের ওপর কোনো প্রকার অত্যাচার না করতে পারে, তা নিশ্চিত করা। তৃতীয়ত, গণহত্যার কোনো আলামত বিনষ্ট করা যাবে না। চতুর্থত, আদালতের অন্তর্বর্তী আদেশ কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে, সেটা মিয়ানমারকে চার মাস পর জানাতে হবে। 

এসব অন্তর্বর্তী আদেশ বাস্তবায়ন করতে মিয়ানমার আইনগতভাবে বাধ্য। যদিও মূল বিচারে এসব অন্তর্বর্তী আদেশ মামলার মেরিটে কোনো প্রভাব ফেলবে না; তদুপরি এগুলো রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা পরিচালিত হওয়ার প্রাথমিক প্রমাণ। 

আইসিজেতে মিয়ানমারের তরফে দাবি করা হয়, তারা বিষয়গুলো অভ্যন্তরীণভাবে তদন্ত করেছে। এসব তদন্তে যুদ্ধাপরাধ প্রমাণ হলেও গণহত্যা প্রমাণ হয়নি। এগুলো তাই আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার্য নয়। তাছাড়া আইসিজে দুই দেশের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তি করে। মামলাটি ওআইসির তরফে করা হয়েছে বলে মিয়ানমার দাবি করেছে। মিয়ানমার মামলাটি খারিজ করার আবেদন করেছিল। এসব যুক্তি আদালতের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তাই শুনানির এক মাসের মধ্যে বিচারকরা গোপনে বৈঠক করে সর্বসম্মত অন্তর্বর্তী আদেশ দিয়েছেন। 

আইসিজে ইতিপূর্বে বসনিয়া হর্জেগোভিনার মামলায়ও অন্তর্বর্তী আদেশ দিয়েছিল। অনেকটা একই ধাঁচের আদেশ এই মামলাতেও দেয়া হয়েছে। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠাকালে যে ছয়টি অঙ্গ সংস্থা গড়ে উঠেছিল; আইসিজে তার অন্যতম। আইসিজে ছাড়া জাতিসংঘের সব প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান অঙ্গের সদরদফতর নিউইয়র্কে অবস্থিত। আইসিজের সদর দফতর নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে অবস্থিত। জাতিসংঘের সদস্য দুই দেশের বিরোধ নিষ্পত্তি ও জাতিসংঘের কোনো অঙ্গ সংস্থা কোনো বিরোধপূর্ণ বিষয়ের আইনি ব্যাখ্যা চাইলে আইসিজে তার রায় দিয়ে থাকেন। এই আদালত সর্বোচ্চ ও কোনো প্রকার আপিল ছাড়াই তার রায় মানা বাধ্যতামূলক। 

যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের জন্য জাতিসংঘের আরেকটি আদালত রয়েছে। ওই আদালতের নাম ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি)। রোম সংবিধির মাধ্যমে ১৯৯৮ সালে ওই আদালত প্রতিষ্ঠিত হলেও এশিয়ার খুব কম দেশই এই সংবিধিতে সই করেছে। বাংলাদেশ রোম সংবিধিতে সই করেছে। মিয়ানমার সই করেনি। তাই রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার আইসিসিতে করা যাবে কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। 

আইসিজেতে কোনো ব্যক্তির বিচার হয় না। দুই রাষ্ট্রের বিরোধ নিষ্পত্তি করা হয়। আইসিসিতে গণহত্যায় অভিযুক্ত ব্যক্তিবর্গের বিচার করা হয়। সে হিসাবে রোহিঙ্গা গণহত্যায় যেসব সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ জড়িত, তাদের বিচার করার জন্য আইসিসিতে মামলা করা প্রয়োজন। যদিও মিয়ানমার রোম সংবিধিতে সই করেনি; তবে বাংলাদেশ সই করেছে। তাই বাংলাদেশ বিষয়টি নিয়ে আইসিসিতে যেতে পারে। গণহত্যায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার চাইতে পারে। 

আইসিজেতে প্রাথমিকভাবে গণহত্যার প্রমাণ পাওয়ায় আইসিসিতে মামলাটি নিয়ে যাওয়ার পথ সুগম হয়েছে। এখন বাংলাদেশের উচিত হবে আন্তর্জাতিক আইনের সকল বিষয় পর্যালোচনা করে আইসিসিতে কীভাবে অভিযুক্তদের বিচার করা যায়, তার ব্যবস্থা করা। 

দ্বিতীয়ত, আইসিজেতে মামলার চূড়ান্ত রায় যাতে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে সহায়ক হয় তার জন্য পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত, প্রমাণ, আলামত দিয়ে গাম্বিয়াকে সহায়তা করাও বাংলাদেশের দায়িত্ব। কারণ রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার করাই শুধু বাংলাদেশের স্বার্থ নয়; রোহিঙ্গা সংকট নিরসন করা বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ। 

রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর উপাদান আইসিজের অন্তর্বর্তী রায়ে রয়েছে। আইসিজের চেয়ারম্যান রায় পাঠ করার সময় ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনসহ অপরাপর ডক্যুমেন্ট পর্যালোচনা করে মন্তব্য করেছে যে, রোহিঙ্গারা সর্বদা মিয়ানমারের নাগরিক। ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধনীর মাধ্যমে তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে মিয়ানমার। এতে করে তারা রাষ্ট্রহীন মানুষে পরিণত হন। চূড়ান্ত রায়ে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিরাপদে পাঠানোর বিষয়টি অবশ্যই থাকতে হবে। 

তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক আদালতের রায় যাতে মিয়ানমার বাস্তবায়ন করে তার জন্যে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পদক্ষেপ গ্রহণে বাংলাদেশকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫