
প্রতীকী ছবি
বাংলাদেশে সেবা খাতসমূহে নিয়োজিত সেবকদের অর্থাৎ সরকারি কর্মচারীদের ব্যক্তিগত স্বার্থে অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। এ দেশে এখন কোনো সেবা নিতে চাইলে বাড়তি টাকা মানে ঘুষ দিতে হবে। না দিলে নানামুখী হয়রানির শিকার হতে হয়।
সব খাতে সমান না হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অবস্থা এমন, যেন ঘুষ নেই তো সেবাও নেই! সরকারি চাকরিজীবী তথা জনগণের সেবক হয়েও তাদের সম্পদ বা অর্থ আত্মসাৎ, প্রতারণা, দায়িত্বে অবহেলা, স্বজনপ্রীতি অথবা সেবা প্রদানে অযৌক্তিক সময়ক্ষেপণসহ বিভিন্ন ধরনের হয়রানি যেন স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ‘সেবা খাতে দুর্নীতি : জাতীয় খানা জরিপ ২০২১’ শীর্ষক প্রতিবেদনে যেসব তথ্য উঠে এসেছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সেবা খাত হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। আর সার্বিকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত ও ঘুষে শীর্ষ তিন খাত হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, পাসপোর্ট ও বিআরটিএ।
টিআইবি সেবা খাতে দুর্নীতির ধরন ও মাত্রা নির্ণয়ে ১৯৯৭ সাল থেকে দুর্নীতি বিষয়ক জাতীয় খানা জরিপ পরিচালনা করে আসছে। এ পর্যন্ত ২ থেকে ৩ বছর অন্তর ৯টি খানা জরিপ পরিচালনা করেছে। সর্বশেষ জরিপটিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৭০ দশমিক ৯ শতাংশ খানা বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি খাত বা প্রতিষ্ঠানের সেবা নিতে গিয়ে কোনো না কোনো খাতে দুর্নীতির শিকার হয়েছে। আর সেগুলোর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এর পরেই রয়েছে পাসপোর্ট ৭০.৫ শতাংশ, বিআরটিএ ৬৮.৩ শতাংশ, বিচারিক সেবা ৫৬.৮ শতাংশ, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা ৪৮.৭ শতাংশ, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ৪৬.৬ শতাংশ এবং ভূমি সেবা ৪৬.৩ শতাংশ।
বাংলাদেশের জনগণ দুর্নীতির শিকার হচ্ছেন আর্থ-সামাজিক অবস্থানভেদেও। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী, স্বল্প শিক্ষিত ও দরিদ্ররা দুর্নীতির শিকার বেশি হচ্ছেন। শহরের যেখানে সেবা খাতে দুর্নীতির প্রকোপ ৬৫ শতাংশ, গ্রামে সেই চিত্র ৬৮.৪ শতাংশ। তাছাড়া খানা প্রধান নিরক্ষর ও কেবল স্বাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন হওয়ার কারণেও দুর্নীতির শিকার বেশি হচ্ছেন। আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হলো, বাংলাদেশে চাকরিজীবী, পেশাজীবী ও ব্যবসায়ীদের তুলনায় সাধারণ পেশার জনগণ যেমন কৃষি, মৎস্যজীবী, চাষি, জেলে, পরিবহন শ্রমিক ইত্যাদি দুর্নীতির শিকার বেশি হন। উচ্চ আয়ের তুলনায় নিম্ন আয়ের খানার উপর দুর্নীতির বোঝা অপেক্ষাকৃত বেশি। অর্থাৎ দুর্নীতির বোঝা নিম্ন আয়ের মানুষকেই বেশি বহন করতে হয়।
কেন এমন দুর্নীতিতে নিমজ্জিত সেবা খাতের সেবকরা? বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এর জন্য ৯০ ভাগ দায়ী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। তাদের নোংরা রাজনীতি, ব্যক্তিগত স্বার্থ, লোভ, রাতারাতি ধনী হওয়ার আকাক্সক্ষাই দুর্নীতির অন্যতম কারণ। তারা বলেন, দুর্নীতি থেকে উত্তরণের একটি সুচিন্তিত পথ হলো, দলবাজি, স্বজনপ্রীতি ও মধ্যস্বত্বভোগীদের ঠেকিয়ে আয় বৈষম্য কমিয়ে আনা। বাংলাদেশকে ঘুষ ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসেবে গড়তে হলে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও আমলাদের সদিচ্ছা শুধু কাগজে-কলমে থাকলে হবে না, বাস্তবে থাকতে হবে। কারণ সকল সচেতন দায়িত্বশীল নাগরিকদের সদিচ্ছা ছাড়া কখনো দুর্নীতি দমন সম্ভব হবে না, কোনো দেশেই হয়নি, আমাদের দেশেও হবে না।
অন্যদিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের মতে, দেশের দুর্নীতির সম্ভাব্য কারণগুলো হলো- দুর্নীতির বিরুদ্ধে অঙ্গীকার এবং এর বাস্তবায়নে মিল না থাকা; উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও আমলাদের দুর্নীতি চিহ্নিত না করা; সরকার ও রাজনৈতিক দলসহ উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে না পারা; আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতে ঋণ খেলাপি ও জালিয়াতি বৃদ্ধি পাওয়া; ভূমি-নদী-খালবিল দখল, টেন্ডার ও নিয়োগে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ না কমা; অবৈধ অর্থের লেনদেন বন্ধ না হওয়া; দুর্বল জবাবদিহিতা; দুদকের কার্যকারিতা ও স্বাধীনতার অভাব; দায়মুক্তি ও দুর্বল আইনের শাসন। অর্থাৎ দুর্নীতিকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং এই অপরাধে সবার জন্য আইন সমান, সেই ধারণা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া এবং গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের ক্ষেত্র সংকুচিত করা।
গত কয়েক বছরে দুর্নীতি কতটা বেড়েছে বা কোন খাতে কিছুটা কমেছে তা জানতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের অতীতের প্রতিবেদনগুলোর তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করতে হবে। এর আগেও দেশজুড়ে টিআইবি যেসব খানা জরিপ পরিচালনা করেছিল, তাতেও সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট প্রশ্নের ভিত্তিতে জনগণের মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২১ সালে সেবা খাতে দুর্নীতির শিকার খানার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। যেখানে ২০১৭ সালে ছিল ৬৬.৫ শতাংশ এবং ২০২১ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৭০.৮ শতাংশ। ২০১৭ সালের জরিপের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশে দুর্নীতিগ্রস্ত শীর্ষ খাত ছিল এবারের মতোই আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। তবে ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২১ সালে ঘুষের শিকার খানার হার হ্রাস পেয়েছে। যেখানে ২০১৭ সালে ছিল ৪৯ দশমিক ৮ শতাংশ, সেটা ২০২১ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৪০ দশমিক ১ শতাংশ।
এ ছাড়া ঘুষ আদায়ের শিকার খানার হার কমেছে। যেমন- ২০১৭ সালে জরিপে অংশ নেওয়া ৮৯ শতাংশ মানুষ জানিয়েছিলেন, ঘুষ না দিলে দেশের সেবা খাতে থেকে কোনো সেবা পাওয়া যায় না। আর ২০২১ সালে সেখানে ৭২ দশমিক ১ শতাংশ সেটা উল্লেখ করেছেন। তবে ৫৯ দশমিক ২ শতাংশ খানা ঘুষ দেওয়ার আরেকটি অন্যতম কারণ হিসেবে হয়রানি বা ঝামেলা এড়ানোর কথা উল্লেখ করেছেন। যা ২০১৭ সালের ৪৭.১ শতাংশের তুলনায় বেশি। ২০১৫ সালের সঙ্গে ২০১৭ সালের তথ্যগুলো তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে বলা যায়, ২০১৭ সালে কোনো কোনো খাতে দুর্নীতি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছিল। সেগুলো হলো গ্যাস, কৃষি, বিচারিক সেবা খাত।
তবে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি খাতে দুর্নীতির পরিমাণ কমেছিল। সেগুলো হলো, শিক্ষা, পাসপোর্ট ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান। জরিপের ফল বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, ২০১৭ সালের তুলনায় ২০২১ সালে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, এনজিও, বীমা, ব্যাংকিং এবং স্বাস্থ্যসেবা খাতে দুর্নীতি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এদিকে দুর্নীতির শিকার হলেও অভিযোগ করেননি ৭৯ দশমিক ২২ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশ অভিযোগ করেননি ঝামেলা বা হয়রানির ভয়ে। সবখানেই দুর্নীতি- তাই অভিযোগ করার প্রয়োজনবোধ করেননি ৪৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। সাড়ে ১৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী দুর্নীতির অভিযোগ করেছেন। তবে ৭২ শতাংশ অভিযোগের ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে অভিযোগের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
সেবা খাতে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ অব্যাহত থাকা প্রসঙ্গে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বরাবরের মতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যা উদ্বেগজনক।’ তিনি আরও বলেন, ‘পৃথিবীর সকল দেশেই সেবা খাতে দুর্নীতি হয়। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতির প্রত্যাশিত মাত্রায় কার্যকর প্রয়োগ আমাদের দেশে দেখা যায় না। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার ঘোষণা থাকলেও তা বাস্তবায়নের দায়িত্বে যারা আছেন তারা সেটি করছেন না, বরং লঙ্ঘন করছেন। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য যে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা রয়েছে, তার কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি সাধারণ জনগণকেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। সারাদেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন জোরদার করতে পারলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।’
পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংস্থাগুলো দুর্নীতির শীর্ষে থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যাদের কাছে মানুষ সার্বক্ষণিক সেবা আশা করেন, জনগণ যাদের কাছে যান তারাই দুর্নীতিগ্রস্ত। তারা দুর্নীতির শীর্ষ খাত হিসেবে জরিপে উঠে এসেছে। যেসব সেবা মানুষের খুবই প্রয়োজন সেসব সেবা খাতও দুর্নীতির শীর্ষে।’
বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে এবার বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতের দুর্নীতির এই অবস্থার পার্থক্য কেমন সেদিকে নজর দেওয়া যাক। বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘টিআই’ ২০২১ সালে ‘বিশ্বজুড়ে দুর্নীতির ধারণাসূচক বা করাপশন পারসেপশনস ইনডেক্স প্রতিবেদন’ প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনে দুর্নীতির বিশ্বজনীন ধারণাসূচকে বাংলাদেশের অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে বলেই তথ্য উঠে এসেছে।
জানা যায়, মোট ১৮০টি দেশের তথ্য নিয়ে সংস্থাটি ‘সিপিআই’ প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ সর্বনিম্ন অবস্থানে এবং দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে একমাত্র আফগানিস্তানই বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত। এই হলো অবস্থা! ২০২১ সালে প্রকাশিত সিপিআই প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় নিচের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম। আর ২০১৯ সালে ছিল ১৪তম। সূচকে উচ্চক্রম অনুযায়ী, বাংলাদেশের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। এবারও বাংলাদেশ ১৪৬তম অবস্থানে রয়েছে। ১০০-এর মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর ২৬। ১২তম অবস্থানে আরও রয়েছে উজবেকিস্তান ও সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক।
চরম আক্ষেপের বিষয় হলো, ঘুষ অনিয়ম দুর্নীতির সংস্কৃতির সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের বসবাসের নিয়ম হয়ে গেছে। কিন্তু এরকম চলতে পারে না। সেবাগ্রহীতা যখন সেবা নিতে সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে যায়, তখন তার কাছে বাড়তি টাকা চাওয়া হয়। অর্থাৎ যাদের কাছে মানুষ সার্বক্ষণিক সেবা আশা করেন, তারাই দুর্নীতিগ্রস্ত। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে সরকারকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।