Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

১৬ কোটির দেশে জন্ম নিবন্ধন ২০ কোটি

Icon

এ আর সুমন

প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২২, ১০:২০

১৬ কোটির দেশে   জন্ম নিবন্ধন  ২০ কোটি

জন্ম নিবন্ধনের লোগো।

রাজধানীর তেজগাঁও এলাকার নাখালপাড়ায় গেল ১৭ বছর ধরে বসবাস করছেন আব্দুল মোত্তালিক রতন। ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে গেছিলেন। কিন্তু স্কুল থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে ছেলের জন্ম নিবন্ধন কার্ড ছাড়া ভর্তি করানো যাবে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়ম অনুযায়ী জন্ম নিবন্ধন লাগবে। অগত্যা এলাকায় ফিরে জন্ম নিবন্ধন কার্ড প্রস্তুত করতে লেগে পড়লেন। পদে পদে এ অফিস থেকে ও অফিস, এ নেতা থেকে ও নেতা করতে করতে নাজেহাল রতন।

তিনি বলেন, ‘এলাকার এক বড় ভাই নেতাকে ধরলাম, সে আবার আরেকজনের কাছে নিয়ে গেলেন। ওই লোক কমিশনারকে রাজি করিয়ে, পরে পাঠালেন সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়ে। সেখানেও পদে পদে ভোগান্তি। যা-ই হোক নানা মেকানিজমে কার্ড বের করা গেল। কিন্তু বাসায় ফিরে দেখি ভুল এসেছে। এই সনদ পেতে গত ২০ দিন ধরে নানা হয়রানির শিকার হয়েছি। এখন আবার সংশোধনী জমা দিতে এলাম। এসে জানতে পারলাম সংশোধনী হয়ে আসতে অনেকটা সময় লাগবে। তাহলে ছেলের জন্ম নিবন্ধন করব কবে? এদিকে স্কুলে ভর্তির সময়সীমা শেষ হয়ে যাচ্ছে। ছোট একটা কাজে এত ভোগান্তি! এত ভুল!’ সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেছেন, জন্ম নিবন্ধন সংশোধনে

অনেকে হয়রানির শিকার হচ্ছে। এ ব্যাপারে কাউকে হয়রানি না করতে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এ তো গেল এক ভুলের ঘটনা। এমন লক্ষাধিক ভুলে জন্ম নিবন্ধন প্রকল্প ডুবতে বসেছে। দেশের সবশেষ জনশুমারি অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা এখন ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। অন্যদিকে স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীন রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের বার্ষিক পরিসংখ্যান প্রতিবেদনে এসেছে, সারা দেশে গত জুন পর্যন্ত জন্ম নিবন্ধন করেছে ২০ কোটি ১২ লাখ ৩৮ হাজার ৭২৪ জন। কীভাবে সম্ভব? সাড়ে ষোলো কোটি মানুষের দেশে জন্ম নিবন্ধন ২০ কোটির বেশি মানুষের। হ্যাঁ, সমস্ত অসম্ভবকে যেন সম্ভব করা হয়েছে এই জন্ম নিবন্ধনের হিসাবে এসে। তবে সংশ্লিষ্টদের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তারা বলছেন, দ্বৈত নিবন্ধনের কারণে সংখ্যাটি দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়ে বেশি হয়ে গেছে। 

সব মানুষকে জন্ম নিবন্ধনের আওতায় আনতে ২০০১ সালে ইউনিসেফ-বাংলাদেশের সহায়তায় প্রকল্পটি শুরু হয়। তখন হাতে লেখা জন্ম ও মৃত্যুসনদ দেওয়া হতো। এরপর ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের অংশ হিসেবে ২০১০ সালে বার্থ রেজিস্ট্রেশন ইনফরমেশন সিস্টেম (বিআরআইএস) নামে সফটওয়্যার চালু করা হয়। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান পাসকনের কাছ থেকে সফটওয়্যার তৈরি করে নেয় ইউনিসেফ। এই সফটওয়্যারের মাধ্যমে তথ্য যাচাই এবং দ্বৈততা চিহ্নিত করার সুযোগ ছিল না। ফলে অনেকে একাধিক জন্ম সনদ নিয়েছে। স্কুলে ভর্তি, বাল্যবিবাহ, চাকরি, পাসপোর্টসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইচ্ছামতো বয়স নির্ধারণ করেছে। এ সুযোগে রোহিঙ্গারাও নিয়েছে জাতীয় পরিচয়পত্র। নানা অনিয়ম করেছে জালিয়াতচক্র। জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রমে ২১ বছরেও নির্ভুল তথ্য সরবরাহ করতে পারছে না সরকার।

স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীন রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের বার্ষিক পরিসংখ্যান প্রতিবেদনে এ ব্যর্থতার কথা স্বীকার করা হয়েছে। উল্লেখ্য, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের এই তথ্যভাণ্ডার তৈরি করতে ইউনিসেফ গত ২১ বছরে ১৭০ কোটি টাকা খরচ করেছে। বাংলাদেশ সরকার গত দুই বছরে খরচ করেছে ৬০ কোটি টাকা। এর আগের ১৯ বছর সরকার কত টাকা খরচ করেছে সে তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে নির্ভুল এবং দ্রুতগতির জন্ম নিবন্ধন সার্ভার তৈরি করতে ২০১৯ সালে বার্থ-ডেথ রেজিস্ট্রেশন ইনফরমেশন সিস্টেম (বিডিআরআইএস) নামে নতুন সফটওয়্যার চালু করা হয়। ‘রিভ সিস্টেম’ নামে একটি সফটওয়্যার নির্মাণ প্রতিষ্ঠান এটি তৈরি করেছে। তবে একবার মেয়াদ বাড়ানোর পরও তারা আনুষ্ঠানিকভাবে এটি বুঝিয়ে দেয়নি।

গত জুনে প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে নির্ভুল জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের ক্ষেত্রে সাতটি সমস্যার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি কিছু সমাধানও সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- নতুন সফটওয়্যারের সীমাবদ্ধতা দূরীকরণ, একাধিক নিবন্ধন বাতিল, জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধন নিশ্চিত করা, মৃত্যু নিবন্ধনের হার বাড়ানো, বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে নতুন সফটওয়্যারের সংযোগ স্থাপন, জন্ম তারিখ সংশোধনের অস্বাভাবিক প্রবণতা কমিয়ে আনা এবং জনবলের অভাব কমানো।

তবে হতাশার বিষয় হলো, বাস্তবে মানুষ জন্ম নিবন্ধন করতে গিয়ে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে সে বিষয়ে প্রতিবেদনে কিছু বলা হয়নি। উল্টো নির্ভুল তথ্য দিয়ে সনদ দিতে না পারার জন্য নাগরিকদের দায়ী করা হয়েছে। বলা হয়েছে, জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধনে অভিভাবকের অনীহা, সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নিবন্ধনের জন্য স্কুলে ভর্তির আগ পর্যন্ত অপেক্ষা, পরবর্তী সময়ে স্কুলের সনদ দিয়ে জন্ম নিবন্ধন বা সংশোধনের আবেদন করা। প্রসঙ্গত, বর্তমানে দেশে ও দেশের বাইরে পাঁচ হাজার ৫৩২টি জায়গা থেকে জন্ম নিবন্ধন করা যায়। দেশের সব ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, পৌরসভা কার্যালয়, সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের পাশাপাশি বিদেশের বাংলাদেশি দূতাবাসে অনলাইনের মাধ্যমে জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

২০০১ সালে হাতে লিখে প্রথম নিবন্ধন শুরু হয়। ২০১০ সালে ইউনিসেফের সহযোগিতায় ডিজিটাল নিবন্ধন শুরু হয়। সেই সফটওয়্যার অকেজো দাবি করে, ২০১৯ সালে সরকার নিজেই নতুন সফটওয়্যারে জন্ম নিবন্ধনের তথ্য সংরক্ষণ শুরু করে। তিন বছরের মাথায় এসে এখন বলা হচ্ছে, এই সফটওয়্যারটিও হালনাগাদ (আপডেট) করতে হবে। বিষয়টি নিয়ে জন্ম নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেল রাশেদুল হাসান বলেন, ‘নতুন সফটওয়্যারে কিছু চাহিদার কমতি আছে। ম্যানুয়ালি যেসব তথ্য যুক্ত করা হয়েছে, সেখানে কিছু ত্রুটি থাকতে পারে। প্রয়োজন হলে সফটওয়্যার আবার আপডেট করা হবে।’ বিপুল সংখ্যক ভুলের বিষয়ে তিনি আরও বলেন, ‘ভুল শনাক্ত করে সমাধান করা হচ্ছে। আগের চেয়ে এখন ভুলের হার কম। ইউপি কার্যালয়গুলোতে দক্ষ জনবল দিয়ে নিবন্ধন ফরম পূরণের কথা বলা হয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতিরোধে নজরদারি বাড়াতে বলা হয়েছে।’

নতুন এই সফটওয়্যার তৈরির জন্য ১৫ কোটি টাকা দিয়েছে ইউনিসেফ। সংস্থাটির চাইল্ড প্রটেকশন স্পেশালিস্ট জামিলা আক্তার বলেন, নতুন সফটওয়্যারের অর্ধেক কাজ এখনো হয়নি। চাহিদার বেশির ভাগ শর্ত পূরণ করেনি সফটওয়্যার নির্মাণ প্রতিষ্ঠানটি। ফলে নিবন্ধনের কাজ নির্ভুল করা যাচ্ছে না। আগে একই ব্যক্তির দুইবার নিবন্ধন বা দ্বৈততা ছিল। আবার অনেকে অজ্ঞতার কারণে নিবন্ধনে ভুল করছে। কোনো কোনো নিবন্ধন কার্যালয়ে দুর্নীতি হচ্ছে। এমন নানা জটিলতার কারণে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনের ডাটাবেস বা তথ্যভাণ্ডার নির্ভুল করা যাচ্ছে না।   

রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয় সূত্র থেকে জানা গেছে, ২০১০ সালে ইউনিসেফের তৈরি পুরনো সফটওয়্যারে নিবন্ধন করা তথ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ দ্বৈততা আছে। এটা দূর করার জন্যই নতুন সফটওয়্যার নেওয়া হয়। কিন্তু নতুন সফটওয়্যারে বেশির ভাগ সময় কাজ করা যাচ্ছে না। বেশ কয়েকটি ফিচার ঠিকভাবে কাজ করছে না। সরেজমিনে দেখা গেছে, জন্ম সনদে সংশোধন ও ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা নিয়ে প্রতিদিন স্থানীয় ও আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোতে মানুষ ভিড় করছেন। সারা দেশের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি), পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয় এবং দূতাবাসের মাধ্যমে (প্রবাসীরা) গত ৪ অক্টোবর পর্যন্ত জন্ম ও মৃত্যু সনদের তথ্যের সংশোধন চেয়ে ২৪ লাখ ৯১ হাজার ৫৪৬টি আবেদন জমা হয়েছে। এর মধ্যে জন্ম তথ্য সংশোধনের আবেদনই ২৪ লাখ ৮৭ হাজারের বেশি।

জন্মনিবন্ধন হয়েছে প্রায় ২১ কোটি ১১ লাখ, আর জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। জনসংখ্যার চেয়ে জন্ম নিবন্ধন প্রায় সাড়ে চার কোটি বেশি হওয়ার কারণ সম্পর্কে উপ-রেজিস্ট্রার জেনারেল মির্জা তারিক হিকমত জানান, হাতে লেখা জন্মসনদের অনেকগুলো অনলাইনে তোলা হয়েছে। জন্ম নিবন্ধন নিয়েছিলেন এমন অনেক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে, তাদের নামও জন্ম নিবন্ধনের মোট হিসাবের সঙ্গে গণনা করা হয়। এ ছাড়া কারও কারও একাধিক জন্ম নিবন্ধন রয়েছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫