Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

ঘাটে ঘাটে সিন্ডিকেট

ডুবছে নৌকা ঝরছে প্রাণ

Icon

কেএম ওবায়দুল্লাহ

প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২২, ১০:৩৭

ডুবছে নৌকা ঝরছে প্রাণ

নৌপথে দুর্ঘটনা। ছবি: সংগৃহীত

ঘাটকেন্দ্রিক কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য। তাই ছোট নদীবন্দর, ফেরি ও লঞ্চঘাট ইজারা নিয়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব। একদিকে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে শত শত কোটি টাকার রাজস্ব থেকে অন্যদিকে যথাযথ সেবা পাওয়া দূরে থাক, উল্টো বিশেষ এক চক্রের লোভের বলি হচ্ছে নদী পার হওয়া যাত্রীরা। ঘটছে অনাকাঙ্ক্ষিত নানা ঘটনা, ঝরছে তাজা প্রাণ। সমস্যা সমাধানে সরকারের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) পাশাপাশি জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণেও দেশের অনেক নৌপথ। এসব নৌপথ ইজারা দিয়ে বছর বছর বিপুল অর্থ আয় করলেও নৌ নিরাপত্তা নিশ্চিত করছেন না সংশ্লিষ্টরা। নৌযান ও নৌপথের নিরাপত্তা নিয়েও নেই কোনো কার্যক্রম। ফলে বাড়ছে দুর্ঘটনা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভুল কর্তৃপক্ষের হাতে নৌঘাটগুলোর নিয়ন্ত্রণ থাকায় নৌ দুর্ঘটনা বাড়ছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশপাশে অন্তত ২০টি নৌঘাটে মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ছয় মাস নৌকা চলে। এতে প্রতিদিন হাজারো যাত্রী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করে। বছরের পর বছর ধরে পরিচালিত হওয়া নৌঘাটেরও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কোনো অনুমোদন নেই। তবে প্রতিটি ঘাট ঘিরেই রয়েছে চক্র। তারা কখনো বাজার কমিটি, কখনো পৌরসভা বা জেলাপ্রশাসকের দোহাই দিয়ে ঘাট নিয়ন্ত্রণ করেন।বাণিজ্যও বেশ রমরমা।

মৌসুমের শুরুতে বিভিন্ন রুটে সিরিয়ালের জন্য প্রতি নৌকামালিককে গুনতে হয় এক থেকে আড়াই লাখ টাকা। সেই সঙ্গে প্রতিদিন ঘাটের সিন্ডিকেটকে দিতে হয় ৫০ থেকে ১০০ টাকা। আর সিন্ডিকেটের বাণিজ্যেও এ টাকা আদায় করা হয় যাত্রীদের পকেট কেটেই। নৌকাগুলোতে ৫০ জনের জায়গায় উঠানো হয় ২০০ জন পর্যন্ত। ফলে প্রতিবছরই ঘটে নৌকাডুবির ঘটনা। গত বছরের আগস্টেও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস নদী নৌকাডুবিতে ২৩ জনের মৃত্যু হয়। ওই দুর্ঘটনার পর কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় গত ২৫ সেপ্টেম্বরও পঞ্চগড়ের করতোয়া নদীতে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইয়ের কারণে একটি নৌকা ডুবে যায়। এতে ৬৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। নিখোঁজের তালিকাতেও আছেন আরও বেশ কয়েকজন।

ওই ঘটনার পর নৌ নিরাপত্তা গবেষকরা নতুন করে দাবি তুলেছেন, জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণে থাকা নৌঘাটগুলো নৌ খাতের দক্ষ কর্তৃপক্ষের আওতায় পরিচালনার। মূলত নৌযান ও নৌ-পরিবহন নিশ্চিত করে তবেই ঘাট ইজারা দেওয়ার নিয়ম। নৌ-সংক্রান্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো চলছে এ নিয়মেই। কিন্তু জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণে থাকা নৌঘাটগুলোয় সে চর্চার দেখা মেলে না। ফলে ওইসব ঘাটে নৌযান চলাচল করে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই।

এ বিষয়ে নিরাপদ নৌপথ বাস্তবায়ন আন্দোলনের সদস্য সচিব ও নৌপথ গবেষক আমিনুর রসুল বাবুল বলেন, ‘সারা দেশের নৌঘাটের দায়িত্ব কার কাছে থাকবে সেটি নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। আমাদের দেশে জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণে বেশকিছু নৌঘাট আছে। নৌ নিরাপত্তার জন্য এটি হুমকি বলে মনে করি। কেননা জেলা পরিষদের কর্মকর্তারা নৌ-সংক্রান্ত কোনো বিষয়েই জানেন না। তাই ঘাট ইজারা দিয়েই খালাস! কিন্তু দেশে নৌ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একাধিক সংস্থা থাকার পরও জেলা পরিষদের লোকজন কেন নৌঘাট পরিচালনা করবেন?’

তিনি আরও বলেন, ‘ব্রিটিশ আমল থেকেই জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণে নৌঘাট থাকার বিষয়টি চর্চা হয়ে আসছে। সে চর্চার এখন পরিবর্তন দরকার। পাশাপাশি জেলা পরিষদ নৌঘাট দিয়ে আয় করে কিন্তু নৌঘাটের সংস্কার কিংবা যাত্রীসেবায় অবকাঠামো নির্মাণ করে না। এটা তো মারাত্মক অন্যায়। যে যাত্রীদের থেকে জেলা পরিষদ আয় করল, সেখানে যাত্রীদের জন্য কোনো অবকাঠামো বানাবে না, এটা হয়েছে সংশ্লিষ্টদের নৌ খাত পরিচালনা সম্পর্কে ধারণা না থাকার কারণে।’

নৌ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, পন্টুন স্থাপনসহ জেটির নির্মাণ, নদীঘাটগুলোতে যান চলাচল ও যাত্রীসাধারণের যাতায়াতের সুবিধার্থে লঞ্চঘাটে যাত্রী ছাউনি তৈরি ও পন্টুনের উভয় পাশে ৫০০ গজ তীরভূমি নির্মাণের কাজ করে থাকে বিআইডব্লিউটিএ। অন্য কোনো পক্ষ এসব কাজ করে না। তাই ইজারা দেওয়া ও রাজস্ব আদায়ের এখতিয়ার একমাত্র তাদেরই। তবে অপর পক্ষগুলো তা মানতে নারাজ। ফলে স্টেশনের ইজারা ও শুল্ক আদায় নিয়ে আছে রশি টানাটানি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিআইডব্লিউটিএর বন্দর বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘যে যে বিষয়ে দক্ষ তাকে সে বিষয়েই দায়িত্ব পালন করতে হয়

নৌ খাত পরিচালনায় স্থানীয় সরকার বিভাগের কোনো দক্ষতা নেই। তাদের উচিত ঘাটগুলো আমাদের কাছে হস্তান্তর করা। ঘাটগুলো অযত্ন-অবহেলায় ফেলে রাখার কারণেই বারবার নৌপথে দুর্ঘটনার শিকার হয়।’ ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘করতোয়াসহ দেশের বিভিন্ন নদ-নদীতে চর পড়ে যাওয়ার সমস্যা আছে। কিন্তু জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের ড্রেজিং করা হয় না। কারণ ড্রেজিং করার যন্ত্রপাতিও নেই তাদের, আবার অভিজ্ঞতাও নেই। ফলে এভাবেই চলতে থাকে নৌযোগাযোগ সেবা। অবকাঠামো নির্মাণ তো করেই না।’

তবে ভিন্ন কথা বলেছেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ছোট ছোট নৌঘাট সরকারি সংস্থা বিআইডব্লিউটিএর আওতায় দেওয়া হলে এতে সমস্যা আরও বাড়বে। প্রথমত বিআইডব্লিউটিএর জনবল সংকট রয়েছে। দ্বিতীয়ত ছোট ছোট ঘাটের পেছনে বিআইডব্লিউটিএ যদি জনবল দেয় সেটাও হবে সরকারের অপচয়। এর চেয়ে ভালো, জেলা পরিষদের উদ্যোগে পরিচালিত ঘাটগুলো যেন জেলা পরিষদের পক্ষ থেকেই সংস্কার করা হয় সে বিষয়ে জোর দেওয়া।

এদিকে পঞ্চগড়ের দুর্ঘটনাকবলিত নৌঘাটটিতে কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করেনি জেলা প্রশাসন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সানিউল কাদের বলেন, ‘এটি ভাঙনপ্রবণ এলাকা। অবকাঠামো নির্মাণ করলে সেটি থাকে না। তাই কোনো স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘নৌঘাটগুলো জেলা প্রশাসকদের একটি বড় আয়ের উৎস। কিন্তু আমাদের পক্ষ থেকে নৌযান পরিদর্শন করার সক্ষমতা নেই। এ বিষয়ে আমাদের কোনো লোকও নেই। বিআইডব্লিউটিএর মতো আমাদের যদি নৌ পরিদর্শক নিয়োগ দেওয়া হয় তাহলে এ ধরনের দুর্ঘটনা কমে আসবে বলে মনে করি।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫