Logo
×

Follow Us

বাংলাদেশ

ডুবে যাচ্ছে উপকূল

Icon

জাহিদুর রহমান

প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২২, ১১:৫৯

ডুবে যাচ্ছে উপকূল

জোয়ারের পানিতেই ডুবে যাচ্ছে উপকূল। ফাইল ছবি

অক্টোবর-নভেম্বর মাসকে বলা হয় ঘূর্ণিঝড়ের মৌসুম। এবারও  ২৪ অক্টোবর ‘সিত্রাং’ নামে ঝড়টি বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হেনে দুর্বল হয়ে গেছে। তবে এখন আর ঘূর্ণিঝড় কিংবা বৃষ্টির দরকার হয় না, জোয়ারের পানিতেই ডুবে যাচ্ছে উপকূল।

বছর বছর বাড়ছে পানি, বিস্তৃত হচ্ছে আগের বছরের চেয়ে আরও বেশি এলাকা। বিশেষ করে ভরাকাটালের পূর্ণিমায় এমন ঘটনা বেশি ঘটছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে দক্ষিণ উপকূলের নদ-নদীগুলো এখন আর অমাবস্যা-পূর্ণিমার জোতে সৃষ্ট উঁচু জোয়ারের পানি ধারণ করতে পারছে না। ফলে এসব পানি ডুকে পড়ছে লোকালয়ে। এতে পুকুর-ঘেরের মাছ ভেসে যাচ্ছে, ফসলহানি ও জমিতে লবণাক্ততা বাড়াচ্ছে এবং বাড়িঘর ডুবে গিয়ে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। আগে যেসব এলাকা উঁচু ও সুরক্ষিত ছিল সেসব এলাকাও এখন জোয়ারের পানিতে নিমজ্জিত হচ্ছে। জোয়ারের এই উচ্চতাকে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রতিক্রিয়ার অংশ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে উপকূলের নদ-নদীতে জোয়ারের এমন উচ্চতা দেখা যায়নি। এই পরিস্থিতিকে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে অশনিসংকেত বলেও মনে করছেন তাঁরা।

ডুবছে উঁচু ও সুরক্ষিত এলাকাও

নদ-নদীতে অধিক উচ্চতার জোয়ারের এই প্রবণতার শুরু এক দশক আগে, ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডর থেকে। এরপর যত ঝড় আঘাত হেনেছে, সবকটিতে জোয়ারের উচ্চতা বেড়েই চলেছে। শুধু ঘূর্ণিঝড় নয়, অমাবস্যা-পূর্ণিমার জোতেও ৮ থেকে ১৪ ফুট উচ্চতার জোয়ারের কবলে পড়ছে লোকালয়। এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ছে এ অঞ্চলের মাটি, পানি, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যে। 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) জোয়ার পরিমাপক শাখার তথ্য অনুযায়ী ২০০৪ সালে বরিশাল অঞ্চলের প্রধান নদ-নদী বিষখালী-পায়রা-বলেশ্বরে সর্বোচ্চ জোয়ারের উচ্চতা ছিল ৩ দশমিক ৪৫ মিটার, ২০০৫ সালে ৩ দশমিক ৫১ মিটার, ২০০৬ সালে ২ দশমিক ৯৬ মিটার, ২০০৭ সালে সিডরে জোয়ারের এই উচ্চতা গিয়ে দাঁড়ায় ৪ দশমিক ২২ মিটার আর ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলায় জলোচ্ছ্বাস হয় ৩ দশমিক ৬৫ মিটার। এরপর ২০১৩ সালের ১৬ মের ঘূর্ণিঝড় মহাসেনে জোয়ারের তীব্রতা ছিল ৩ দশমিক ৩৬ মিটার। ওই বছরের ১৫ জুলাই পূর্ণিমার প্রভাবে উপকূলে জোয়ারের উচ্চতা ছিল ৩ দশমিক ৬২ মিটার। ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় বুলবুল আঘাত হানার সময় জোয়ারের উচ্চতা ছিল ৩ দশমিক ১০ মিটার থেকে ৪ মিটারের মধ্যে। ২০২০ সালে আম্পানে জোয়ারের উচ্চতা ছিল ৩ দশমিক ৩৬ মিটার থেকে ৪ মিটারের ওপরে। ২০২১ সালে জোয়ারের উচ্চতা ছিল ৩ দশমিক ১ থেকে ৪ দশমিক ৩ মিটারের ওপরে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ৩ দশমিক ১৮ মিটার উচ্চতারও বেশি জোয়ারের পানিতে ভেসেছে উপকূল। এসব নদীর জোয়ারের স্বাভাবিক মাত্রা হচ্ছে সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৮৫ মিটার।

সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল এন্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশনের তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর ৭ থেকে ৮ মিলিমিটার করে উচ্চতা বাড়ছে বঙ্গোপসাগরের। ত্রিশ বছরে পানির উচ্চতা বেড়েছে ৬ ফুটেরও বেশি। পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় বন্যা-ঘূর্ণিঝড় ছাড়াই দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে জোয়ারের বিস্তার বেড়েছে। 

গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ : এনহেন্সিং কোস্টাল রিজিলিয়ান্স ইন চেঞ্জিং ক্লাইমেট’ শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ২৭ শতাংশ মানুষ বর্তমানে বন্যার ঝুঁকিতে আছে। চলতি শতাব্দীতে উপকূলীয় বন্যার এই ঝুঁকি বেড়ে ৩৫ শতাংশ হতে পারে। বর্তমানে বন্যায় উপকূলীয় এলাকায় বছরে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতি হয় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের ক্ষতির পরিমাণ চলতি শতাব্দীতে দ্বিগুণ হতে পারে। ২০৫০ সাল নাগাদ দেশের উপকূলীয় এলাকার জনসংখ্যা বেড়ে ৬ কোটি ১০ লাখে দাঁড়াবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বাড়লে বাংলাদেশের উপকূলের ৪ হাজার ৮০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ডুবে যেতে পারে। 

পানি বিশেষজ্ঞ ও পাউবোর সাবেক আঞ্চলিক প্রধান প্রকৌশলী সাজেদুর রহমান সরদার বলেন, নদী সংকোচন করা হলে আমাদের নদীগুলোর ধারণক্ষমতা আরও কমবে। তাতে উপকূলে জোয়ারের উচ্চতা আরও বাড়বে। অনেক এলাকা পানিতে নিমজ্জিত হয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, এ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য দ্রুত বাঁধের উচ্চতা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, মৎস্যসম্পদ ও নৌপথবান্ধব নদীকেন্দ্রিক অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা নিতে হবে।

উপকূলজুড়ে বাঁধ ভাঙা দুঃখ

রফিকুল ইসলামের জন্ম সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার কুলিয়া ইউনিয়নের বহেরা গ্রামে। ৫৫ বছর বয়সে সম্প্রতি তিনি মারা যান। স্বজনরা তাকে বহেরা পোস্ট অফিসের পেছেন একটি কবরস্থানে দাফন করেন। পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবন কাটানো রফিকুল ইসলামের মৃত্যুর পরও ঘটেছে মর্মন্তুদ ঘটনা। গত ১২ সেপ্টেম্বর দুপুরে বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে তার মরদেহ ভেসে ওঠে। পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে পচা গন্ধ। পরবর্তীতে ভেসে ওঠা সেই লাশ আবার দাফন করা হয়।

গ্রামের বাসিন্ধারা জানান, এ রকম ঘটনা নতুন নয়। বর্ষায় অমাবস্যা-পূর্ণিমা ভয়ের কারণ হয়ে আসে তাঁদের কাছে। জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায় বসতঘর। পানিবন্দি হয়ে পড়েন সবাই। পানি নেমে গেলে শুরু হয় ঘর গোছানোর কষ্ট। এর পর আবার পানি ঢোকে, পানি নামে; কিন্তু দুর্ভোগ কমে না। ভাঙা বাঁধের এমন দুঃখ শুধু বহেরা গ্রামে নয়, কষ্টে আছেন দেশের উপকূলীয় এলাকার লাখ লাখ বাসিন্দা। 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্যমতে সারাদেশে ১৭ হাজার ৭০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ আছে। এর মধ্যে ৭ হাজার বেড়িবাঁধ উপকূলীয় এলাকায়। এগুলো পুরনো হওয়ায় বিভিন্ন সময়ে ঘূর্ণিঝড়ে ভেঙে গেছে; কিন্তু তার বড় অংশ যথাযথভাবে মেরামত হয়নি। ফলে পুরো উপকূলীয় এলাকা এখন অরক্ষিত।

দীর্ঘদিন ধরে উপকূলের মানুষের জীবনযাত্রা ও দুর্যোগ পর্যবেক্ষণ করছে নেটওয়ার্ক অন ক্লাইমেট চেঞ্জ বাংলাদেশ। মানুষের দুর্ভোগের বিষয়ে সংস্থার গবেষক মুহাম্মদ ফররুখ রহমান বলেন, দশকের পর দশক ধরে উপকূলীয় বেড়িবাঁধগুলো অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। ফলে উপকূলীয় জনপদ রক্ষায় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উঁচু বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা দরকার।

বাঁধ নিয়ে অব্যবস্থাপনা

ষাটের দশকে দেশের ১৩ জেলায় ৫ হাজার ৮১০ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকায় ১৩৯টি পোল্ডার (বেড়িবাঁধ) নির্মাণ করা হয়েছিল। অথচ স্বাধীনতার ৫০ বছরে উপকূল সুরক্ষায় নতুন একটি পোল্ডারও তৈরি করতে পারেনি বাংলাদেশ। পাকিস্তান আমলে তৈরি বেড়িবাঁধ সংস্কার আর পুনর্নির্মাণেই কেটে গেছে ৫০টি বছর। অর্ধশত বছর আগে নির্মিত এসব বাঁধ এখন আর সামাল দিতে পারছে না সামুদ্রিক ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কা। ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূল রেখার প্রায় ১৫ হাজার কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকা এখনো অরক্ষিত।

উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্পের (সিইআইপি-১) প্রকল্প পরিচালক ও পাউবোর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, দেশে বর্তমানে পোল্ডারের সংখ্যা ১৩৯, যা ষাটের দশকে তৈরি। এর মধ্যে ৬০টি বেড়িবাঁধ এখন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। বিভিন্ন কারণে আমরা এসব সংস্কার করতে পারিনি। বাকিগুলো পাউবো বিভিন্ন সময় সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ করেছে। 

তিনি বলেন, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলের সাগর উপকূল রক্ষায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে তিন হাজার ২৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘কোস্টাল ইমব্যাংকমেন্ট ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট (সিইআইপি-১)’ নামের মেগাপ্রকল্পের কাজ চলছে। সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, বরগুনা, পটুয়াখালী ও পিরোজপুর জেলার ঝুঁকিপূর্ণ ১০টি পোল্ডার নিয়ে কাজ হচ্ছে এই প্রকল্পের। ৫০ বছরের স্থায়িত্ব ধরে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। 

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, আমাদের দেশে দুর্যোগের আগে নানা রকমের প্রস্তুতি নেয়া এবং দুর্যোগের পর পর সব ভুলে যাওয়ার সংস্কৃতি চালু আছে। এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫