
কিশোর অপরাধ। প্রতীকী ছবি
সামাজিক সমস্যার আরেক নাম কিশোর অপরাধ, যার সংখ্যা ক্রমে বেড়েই যাচ্ছে। আতঙ্ক ছড়িয়ে সব জায়গায় অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে তারা। যদিও এক দশক আগেও কিশোর অপরাধের এমন ভয়াবহ রূপ দেখা যায়নি। অপরাধ বিশেষজ্ঞ, সমাজ বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধের ফলই হলো ‘কিশোর গ্যাং’।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর তথ্য অনুযায়ী সারাদেশেই কিশোর অপরাধ বেড়েছে। তবে শহরাঞ্চলে এ অপরাধ বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে, যা আইশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে।
এসব কিশোর অপরাধের সঙ্গে রয়েছে রাজনৈতিক ছত্রছায়াও। রাজনৈতিকভাবে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোররা ব্যবহার হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে কিশোর ছাত্ররা শিক্ষক পিটিয়ে হত্যা বা লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটাচ্ছে। তুচ্ছ কারণে খুনের মতো ঘটনার সঙ্গে কিশোরদের সম্পৃক্ত থাকার খবর আসছে হর-হামেশা।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক তথ্য অনুযায়ী দেশে কিশোর-কিশোরীর সংখ্যা ৩ কোটি ৬৩ লাখের মতো, যা মোট জনসংখ্যার ২১ দশমিক ৪ শতাংশ। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচের বয়সীরা কিশোর-কিশোরী হিসেবে বিবেচিত; তাদের সাজা দেয়া যায় না। সাজাপ্রাপ্ত ও গ্রেফতার হওয়া গ্যাংয়ের সদস্যদের রাখা হয় সংশোধনাগারে। মূলত কিশোরকালে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার ভিত্তি তৈরি হয়। আর এ সময়টাতেই অপরাধীর খাতায় নাম লেখাচ্ছে কিশোরেরা। এটা আগামী সুন্দর সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে অশনিসংকেত বলে মনে করেন সমাজ বিজ্ঞানীরা। এ বিষয়ে পরিবার থেকে রাষ্ট্রীয় সব পর্যায়ের সক্রিয় পদক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়েছে।
যেসব অপরাধে জড়াচ্ছে কিশোর
ছোট ছোট অপরাধ থেকে শুরু করে হত্যাকাণ্ড, ইভটিজিং, ধর্ষণ, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, মাদকাসক্তি, মাদক, আগ্নেয়াস্ত্র সম্পর্কিত গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে ‘কিশোর গ্যাং’।
এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও দখলবাজিতেও তাদের ব্যবহার করা হয়। এদের কেউ কেউ নিজেদের শক্তি-সামর্থ্য দেখাতে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশি অস্ত্র বহন করে। তারা এলাকায় প্রভাব দেখাতে গিয়ে এবং সিনিয়র- জুনিয়র দ্বন্দ্বের জেরে প্রায়ই সংঘাত ও খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ে। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে উত্তরায় আদনান কবির হত্যার পর কিশোর গ্যাংয়ের কর্মকাণ্ড আলোচনায় আসে।
যে কারণে অপরাধে কিশোর
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, কিশোরদের অপরাধপ্রবণ হওয়ার পেছনে সাধারণত যে ছয়টি বিষয় পরিলক্ষিত হয় তা হলো- দারিদ্র্য, স্বাস্থ্য সুরক্ষার অভাব, পারিবারিক সমস্যা, নিম্নমানের জীবনযাপনের পদ্ধতি, অপর্যাপ্ত শিক্ষাব্যবস্থা এবং প্রযুক্তির অপব্যবহার।
আধুনিক সমাজে পরিবার ভেঙে ছোট পরিবার গঠন এবং জীবনযাত্রা ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়াটাও শিশু-কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার একটা বড় কারণ বলে মনে করেন অপরাধ বিজ্ঞানীরা। সমাজ পরিবর্তনের কারণে পারিবারিক ও সামাজিক অনুশাসন চর্চার বিষয়টি ভেঙে পড়েছে বলেও মনে করেন তারা।
সমাজবিজ্ঞানী মাহবুবা নাসরীন বলেন, শিশু-কিশোরদের খেলাধুলাা, বিনোদনের সুযোগ কমে যাওয়া এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের অংশ না নেয়াও অপরাধ-প্রবণতার বড় কারণগুলোর অন্যতম। ‘হিরোইজম’ প্রকাশ করতেও পাড়া- মহল্লায় কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে।
ডিজিটাল ডিভাইসের অপব্যবহারও শিশুদের অপরাধের দিকে ঠেলে দেয়। ভিডিও গেমস খেলতে খেলতে তাদের মধ্যে অস্ত্র চালানো শেখার ইচ্ছা জাগে বলেও মনে করেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।
তবে কিশোর অপরাধের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি বেশি দায়ী তা মূলত পারিবারিক। বাবা- মায়ের যথাযথ ভূমিকার অভাবে কিশোররা বিপথে চলে যাচ্ছে। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় যদি সুষ্ঠুভাবে কিশোরের ব্যক্তিত্বের বিকাশ না ঘটে তাহলে পরিবারের ছেলেমেয়েরা কিশোর অপরাধী হয়ে উঠতে পারে। অপসংস্কৃতির বাঁধ ভাঙা জোয়ারও এজন্য অনেকাংশে দায়ী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জনপ্রিয় অ্যাপ টিকটকের ভিডিও বা টিকটক লাইকি কেন্দ্র করেও ‘কিশোর গ্যাং’ গড়ে উঠছে বলেও জানা গেছে।
পরিসংখ্যানে কিশোর অপরাধ
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন তথ্যে কিশোর অপরাধের যে চিত্র উঠে এসেছে তাতে রাজধানীতে প্রতি মাসে হত্যার ঘটনা ঘটে গড়ে ২০টি। এর বেশির ভাগ ঘটনা তদন্তে কিশোর-তরুণদের সম্পৃক্ততার তথ্য উঠে আসছে। আবার ২০১৮ সাল থেকে গত ২৭ জুন পর্যন্ত রাজধানীতে হওয়া ৩৮৯টি ছিনতাইয়ের অনেক ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিল কিশোর- তরুণরা।
কিশোর খুনের মামলার কাগজপত্র বলছে, খুনের শিকার বেশির ভাগ কিশোরের বয়স ১২ থেকে ১৭ বছর। এসব খুনের ঘটনায় যারা জড়িত, তাদের বয়স ১৫ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। দেশের ৬৪ জেলা, উপজেলা ও মহানগর এলাকায় অন্তত ৫ শতাধিক কিশোর গ্যাং সক্রিয়। কেবল রাজধানী ঢাকাতেই সক্রিয় ৫০ কিশোর গ্যাং। গত তিন বছরে সারাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুন হয়েছে অর্ধশতাধিক মানুষ। এসব খুনের ঘটনায় আসামি করা হয়েছে পাঁচ শতাধিক কিশোর গ্যাং সদস্যকে। গত তিন বছরে কিশোর গ্যাংয়ের দেড় শতাধিক সদস্যকে সাজা দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
অন্য এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ১৭ বছরে ঢাকায় কিশোর অপরাধীদের হাতে ১২০ জন খুন হয়েছেন। এর মধ্যে গত ২ বছরে ৩৪ জন খুন হয়েছেন। এসব ঘটনায় চার শতাধিক কিশোরকে আসামি করা হয়েছে।
জানা গেছে, আগে ঢাকার শিশু আদালতে শিশু- কিশোরদের মামলার বিচার হতো। ২০১৯ সালের ১৯ জানুয়ারির পর থেকে এসব মামলার বিচার ঢাকার ৯টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে চলছে।
বন্ধের উপায়
গোয়েন্দা সংস্থার এক প্রতিবেদনে কিশোর গ্যাং প্রতিরোধ ও প্রতিকারের বিষয়ে ১২ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে কিশোর গ্যাং সদস্য গ্রেফতারের জন্য বিশেষ অভিযান পরিচালনা করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অভিযান চালিয়ে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন গ্রুপের প্রায় ৪০০ কিশোরকে গ্রেফতার করে র্যাব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, সমাজে নানা অসঙ্গতি রয়েছে। নিজেদের সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে কিশোররা। তাদের আচরণে পরিবর্তন হচ্ছে। কিশোরদের বয়সে হিরোইজম ভাব থাকে। এই হিরোইজমকে সঠিক পথের অনুসারী করে তুলতে হবে। আবার কিশোরদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার কারণে তাদের মধ্যে এক ধরনের গ্যাং কালচার গড়ে উঠছে। এর দায় আমাদের সবার।
একেবারে ছোট বয়স থেকেই শিশুকে বই পড়া, বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী পড়ার প্রতি আকৃষ্ট করে তোলা উচিত, তবে সে বিপথে যাবে না বলেও জানিয়েছেন সমাজবিজ্ঞানীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক উম্মে ওয়ারা বলেন, ‘প্যারেন্টিং’কে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সন্তানের সঙ্গে মা- বাবার বন্ধুসুলভ সম্পর্ক স্থাপন, স্কুল ও কলেজে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা, পাড়া বা কমিউনিটিতে পর্যাপ্ত খেলাধুলা ও সংস্কৃতিচর্চাই পারে কিশোর অপরাধকে প্রতিরোধ করতে। অন্যদিকে কিশোর অপরাধীদের বিচারব্যবস্থার আওতায় আনার সঙ্গে সঙ্গে কিশোর সংশোধনাগারগুলোর সার্বিক ব্যবস্থাপনার দিকেও নজর দিতে হবে। নয়তো সংশোধন হওয়ার পরিবর্তে এই কোমলমতি কিশোরদের আরও বড় অপরাধী হয়ে সমাজে ফেরার আশঙ্কা থেকেই যায়।
আইন- বিধিবিধান
বড় অপরাধ করলেও কিশোর বলে দণ্ডবিধিতে পুলিশ এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। ‘বাংলাদেশের শিশু আইন ২০১৩’ অনুযায়ী ১৮ বছর বা এর কম বয়সী যেসব শিশু-কিশোরের বিরুদ্ধে অপরাধের প্রমাণ পাওয়া যাবে তাদের জেলে নেয়ার পরিবর্তে উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠাতে হবে, যেন তারা সংশোধন হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে।
গত বছরের জানুয়ারি মাসে সদ্যবিদায়ী পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বাংলাদেশে আইনের জটিলতা, জনবলের অভাব এবং অবকাঠামোর অভাবে কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।
শিশুর বয়স কমিয়ে কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে চায় সরকার। আইন অনুযায়ী অপরাধীর বয়স ১৮ বছরের কম হলে বিচার করা যায় না। তাই সরকার শিশুর বয়স কমানোর চিন্তা- ভাবনা করছে।
গত ২ জুলাই সচিবালয়ের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটির সভা শেষে কমিটির সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, কিশোর গ্যাংসহ বর্তমানে যেসব সমস্যা লক্ষ করা যাচ্ছে, তাতে মনে হয়েছে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আইনের সংশোধন হওয়া উচিত। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ১৮ বছর পর্যন্ত শিশু। বাংলাদেশের আইনে শিশুদের গ্রেপ্তার, বিচারে নানা রকমের নিষেধাজ্ঞা আছে; কিন্তু আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের সঙ্গে মেলে না।
কয়েক দিন আগে দশম শ্রেণির ছাত্র শিক্ষককে মেরে ফেলেছে; কিন্তু আইনে সে শিশু হিসেবে বিবেচিত। শিশুর বিরুদ্ধে তো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। সে কারণে বাস্তবতার নিরিখে আইনগুলো পরিবর্তন হওয়া দরকার। কারণ অপরাধীরা বয়স কম বলে ছাড় পেয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে আইনমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে তার মাধ্যমে বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হচ্ছে।
শিশু আইন সংশোধনে আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে উদ্যোগও নিতে বলেছে কমিটি। তবে শিশুর জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ ও মানবিক বোধসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত না করে এবং শিশুদের বিভিন্ন অপরাধে জড়িত করার পেছনের ব্যক্তিদের শনাক্ত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার আওতায় না এনে শুধু বয়স কমিয়ে শিশুদের অপরাধে শামিল হওয়া থেকে বিরত রাখা যাবে না- মন্তব্য করেছেন আইনজীবী, শিশু অধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তি এবং শিশু- কিশোর মনোচিকিৎসকরা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আমাদের আজকে মনে হচ্ছে এই ১৮ বছর সময়সীমাটা চিন্তা করার সময় এসেছে। যদিও আমরা আন্তর্জাতিক একটা আইনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ, সেই জায়গাটিতে আমাদের করণীয় কী- প্রধানমন্ত্রী সেটা চিন্তা করবেন। সেই জায়গা থেকে দেখার বিষয় রয়েছে বলে আমি মনে করি।’