
বাংলাদেশে অপরিণত শিশু জন্মের ব্যাপারটি বেশ উদ্বেগজনক। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে প্রতিবছর ৪ লাখ ৪০ হাজার অপরিণত শিশুর জন্ম হয়। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নবজাতকের জন্ম বা মৃত্যু হয় যেসব দেশে, এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিশ্বে প্রতি ১০ শিশুর মধ্যে একটি শিশু অপরিণত হয়ে জন্মাচ্ছে। বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া অপরিণত শিশুদের অর্ধেকই পৃথিবীতে আসার দিন মারা যায় এবং বাকি অর্ধেকের মৃত্যু হয় জীবনের প্রথম মাসে।
গর্ভধারণের পর ৩৭ সপ্তাহের আগে জন্ম হলে সে শিশু অনেক সমস্যা নিয়ে আসে পৃথিবীতে- এদেরই অপরিণত শিশু বলে। এ সময় শরীরগঠনে অপূর্ণতা থাকে, শ্বাসকষ্ট হয় ও মস্তিষ্ক গঠনেও অপূর্ণতা থেকে যায়। এমনকি খুব আগে জন্মালে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক হেলথ সার্ভে ২০১৪-এর (বিডিএইচএস) পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুর ৬১ শতাংশ ঘটে ৫ বছর বয়সের মধ্যে। এর মধ্যে ৪৩ শতাংশ অপরিণত নবজাতক। বর্তমানে জন্ম নেওয়া প্রতি হাজার জীবিত শিশুর মধ্যে মৃত্যুর হার ১৮।
অপরিণত শিশু জন্মরোধ ও এ ধরনের শিশুর যত্নে প্রতি বছর ১৭ নভেম্বর ‘বিশ্ব অপরিণত শিশু দিবস’ পালন করা হয়ে থাকে। এবারও বাংলাদেশে শিশু চিকিৎসকদের সংগঠন এবং সরকারিভাবে দিবসটি পালন করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে দৈনিক ২৩০টি মৃত সন্তান জন্মে
বাংলাদেশে অপরিণত শিশু জন্মের ব্যাপারটি বেশ উদ্বেগজনক। এ ধরনের শিশুকে নিয়ে যেমন পিতা-মাতারা সারাজীবন ভোগেন, একই সাথে বেঁচে থাকলে এরা সমাজের জন্য সম্পদ না হয়ে বোঝা হয়ে থাকে। বাংলাদেশে অপরিণত শিশুমৃত্যু দৈনিক গড়ে প্রায় ২৩০টি; কিন্তু এগুলোর বেশির ভাগই কর্তৃপক্ষের নজরে আসে না।
তাই এরকম প্রাণহানির কারণও অজানা থেকে যায়। শিশু জন্মের সাথে মায়ের মৃত্যুর ব্যাপারটিও বাংলাদেশে প্রায় একই রকমভাবে ঘটে থাকে। প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ হাজার ২০০ নারীর মৃত্যু হয় গর্ভকালীন এবং সন্তান জন্মের পর সৃষ্ট জটিলতায়।
অপরিণত অবস্থায় জন্মানোর কারণে বছরে পাঁচ বছরের কম বয়সী ২৩ হাজার ৬০০টি শিশুর মৃত্যু হয়। এ ধরনের শিশুরা বেঁচে গেলে পরে অন্ধ, বধির ও মস্তিষ্কে সমস্যা হয়ে থাকে। সারা পৃথিবীতে বছরে দেড় কোটি অপরিণত শিশুর জন্ম হয়। এর মধ্যে ১ কোটি ১০ লাখ শিশু মারা যায়। প্রতি ১০টি নবজাতকের মধ্যে অপরিণত অবস্থায় জন্ম নেয় একটি শিশু।
নবজাতকের মোট মৃত্যুর ৩৫ শতাংশ মারা যায় অপরিণত অবস্থায় জন্ম নেওয়ার কারণে এবং বেঁচে থাকলেও থেকে যায় অনেক জটিলতা। বাংলাদেশকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) পৌঁছতে হলে নবজাতকের মৃত্যুহার প্রতি হাজারে ১২টিতে নামিয়ে আনতে হবে। বর্তমানে নবজাতকের মৃত্যু প্রতি হাজারে প্রায় ২৮টি।
অপরিণত জন্ম ঠেকানোর উপায়
অল্প বয়সে মা হলে অপরিণত সন্তান জন্ম হতে পারে। অপরিণত শিশুর জন্ম ঠেকানোর জন্য নিউনেটালজিস্টরা বলছেন, শিশু জন্মের আগে মায়ের যথাযথ যত্ন (অ্যান্টিনেটাল) নিতে হবে এবং পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। মায়ের মাধ্যমে ভ্রুণ (ফিটাস) পুষ্টি পাবে। মা যেন কোনো ধরনের ইনফেকশনে না ভোগেন সেজন্য প্রয়োজনীয় যত্নের সাথে চিকিৎসা নিতে হবে। মায়ের ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ থাকলে এর চিকিৎসা করতে হবে।
গর্ভ ধারণের সময় অনেক মায়েরই উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস হয়ে থাকে। ১৮ বছরের পর বিয়ে এবং ২০ বছরের পর সন্তান নিতে চিকিৎসকরা পরামর্শ দিয়ে থাকেন। চিকিৎসকরা বলছেন, অপরিণত শিশু তার শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ফলে ঠাণ্ডা লেগে মারা যেতে পারে।
এদের সংক্রমণের আশঙ্কা বেশি। কখনো কখনো এতো বেশি শ্বাসকষ্ট হয় যে, হাসপাতালে নিয়ে ভেন্টিলেটরে চিকিৎসা দিতে না পারলে মায়ের কোলেই শিশু মারা যায়। এসব হয়ে থাকে জন্মগত ত্রুটির কারণে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এ ক্ষেত্রে কিছু পরামর্শ দিয়েছে।
অপরিণত শিশুদের জন্য ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার
পরীক্ষায় যদি ধরা পড়ে যে, মা একটি অপরিণত নবজাতকের জন্ম দিতে যাচ্ছেন, তখন তাঁকে কিছু ওষুধ দেওয়া হলে (অ্যান্টিনেটাল কর্টিকোস্টেরয়েডস) সেই শিশুর মৃত্যুর ঝুঁকি কমে যায়। আবার অপরিণত শিশুর জন্মের পর ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ারে রাখা হলে সেই শিশুরও মৃত্যুঝুঁকি কমে যায়।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট নিউনেটালজিস্ট অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ সহীদুল্লা বলছেন, অপরিণত শিশুদের জন্য ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার (কেএমসি) খুবই কার্যকর। এমন শিশুকে জন্মের পর সারাক্ষণ মায়ের বুকের সাথে লাগিয়ে রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিশু এবং মায়ের বুকের মধ্যে কোনো কাপড় থাকবে না। মায়ের গর্ভে থাকতে শিশুর সাথে মায়ের যেমন নিবিড় যোগাযোগ থাকতো, তেমনি ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ারেও মা এবং শিশুকে কাছাকাছি রাখলে তাদের একটি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা হবে এবং শিশুর অপরিণত অবস্থার উন্নতি হবে।
মায়ের বুকের সাথে শিশুকে লাগিয়ে রাখলে মায়ের বুকে দুধও আসতে থাকে বলে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জন্মের আগে মায়ের ৮টি সেবা নেওয়ার কথা বলেছে; কিন্তু বাংলাদেশে চারটি সেবা চালু করা হয়েছে। অর্থাৎ শিশু গর্ভে আসার পর ৯ মাসের মধ্যে নির্দিষ্ট ব্যবধানে মাকে চারবার চিকিৎসকের কাছে আসতে হবে।
ইতোমধ্যে ৪২টি জেলায় সরকারিভাবে স্পেশাল কেয়ার নিউবর্ন ইউনিট (এসসিএএনইউ) করা হয়েছে। এখনো ৬৪ জেলায় এ সেবা চালু করা হয়নি। ইতোমধ্যে দেশে ২০০টির বেশি কেএমসি সেবাকেন্দ্র চালু করা হয়েছে। এই সেবা আরও সম্প্রসারণ করা হচ্ছে।
অপরিণত শিশুরা চোখের সমস্যায় ভোগে
অপরিণত নবজাতকেরা রেটিনোপ্যাথি অব প্রিম্যাচিউরিটিতে (আরওপি) ভোগে। এমন অবস্থায় নবজাতকের চোখের রেটিনায় রক্ত সঞ্চালনের প্রক্রিয়া সঠিকভাবে তৈরি হয় না। ফলে দেখা দিতে পারে রেটিনোপ্যাথি। এ জন্য প্রত্যেক অপরিণত নবজাতককে জন্মের পর পরই চোখের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখানো উচিত। আরওপি নামক একটি পরীক্ষা করানো উচিত।
এ ছাড়া অনেক সময় অপরিণত শিশুদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে সেবাদানকারীদের অসচেতনতায়ও আরওপি হতে পারে। অপরিণত অবস্থায় জন্ম নেওয়া শিশুর শ্বাসপ্রশ্বাস ঠিক রাখার জন্য অক্সিজেন দিতে হয়; কিন্তু জীবন বাঁচানোর এই অক্সিজেন বেশি হয়ে গেলে শিশুর রেটিনোপ্যাথি হতে পারে। এই রোগ হলে শিশুর চোখে নানা সমস্যা দেখা দেয়।
যেমন চোখ সাদা হয়ে যাওয়া, ঠিকমতো দেখতে না পারা এবং অনেক সময় শিশু অন্ধও হয়ে যেতে পারে। অক্সিজেন দেওয়ার সময় পালস অক্সিমিটারের মাধ্যমে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা দেখে অক্সিজেন ব্যবস্থাপনা করতে হয়। ৩৫ সপ্তাহের আগে জন্ম অথবা শিশুর ওজন দুই কেজির কম হলে তাকে ৩০ দিনের মধ্যে অবশ্যই চোখের স্ক্রিনিং করতে হবে শিশুর রেটিনোপ্যাথি দেখার জন্য। আর যদি শিশুর ওজন ১২০০ গ্রাম বা জন্ম ২৮ সপ্তাহের মধ্যে হয়, তবে ২০ দিনের মধ্যে চোখের স্ক্রিনিং করতে হবে।
বাড়িতে শিশু জন্ম নিরাপদ নয়
বাংলাদেশে প্রায় ৫০ শতাংশ শিশুর জন্ম হয় (ডেলিভারি) বাড়িতেই। বিশেষ করে অপরিণত শিশু বাড়িতে জন্মালে সে শিশুর বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। অপরিণত শিশু জন্ম প্রতিরোধে অ্যান্টিনেটাল কেয়ারের সাথে সাথে সন্তান নেওয়ার আগেই মায়ের শারীরিক সুস্থতা জেনে নিতে হবে। মায়ের যদি রক্তস্বল্পতা (অ্যানিমিয়া) থাকে তবে অপরিণত শিশুর জন্ম হতে পারে।
সন্তান নেওয়ার আগে মায়ের রক্ত স্বল্পতা দূর করতে হবে। একই সাথে হাইপারটেনশন (উচ্চ রক্তচাপ) থাকলে তা মাতৃমৃত্যুর কারণ হতে পারে। ডায়াবেটিস থাকলেও সমস্যা হতে পারে। কাজেই গর্ভধারণের আগেই মাকে সুস্থ থাকতে হবে। পুষ্টির ঘাটতি থাকলে পূরণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কিছু ওষুধ এবং পুষ্টিকর খাবার খেলে এ সমস্যাগুলো দূর হতে পারে।