নিয়ন্ত্রণহীন বাজারকে আরো চড়া করতে পারে বিদ্যুৎ

সিফাতুল ইসলাম
প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২২, ০৯:২৭

বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন। ছবি: সংগৃহীত
ভোজ্য তেল থেকে জ্বালানি তেল সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে, বাকি ছিল বিদ্যুতের দাম। সেই বিদ্যুতের দামও বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এতে আরেক দফা সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
করোনার ধাক্কায় নাস্তানাবুদ দেশের অর্থনীতি, অনেকেই চাকরি হারিয়ে বেকার, কারও আবার বেতন কমে গেছে। সেই ধাক্কা যখন সামলে ওঠার চেষ্টা চলছিল তখন ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে টালমাটাল করে তুলেছে।
নিয়ন্ত্রণহীন বাজার দর, আজকে চিনি- তো কালকে ভোজ্য তেল, পরশু পেঁয়াজ, তার পরদিন হয়তো আদা-রসুন। এভাবেই জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে নিম্ন আয়ের লোকজন। শীতকালীন সবজিতে বাজার ভরপুর হয়ে উঠলেও দাম এখনো আকাশ ছোঁয়া।
আগের দাম বৃদ্ধির প্রভাবই যখন সামলে উঠতে পারছে না মানুষ, তখন নতুন করে বিদ্যুতের পাইকারি দাম ১৯.৯২ শতাংশ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ২১ নভেম্বর। আর পাইকারি দাম বাড়ানোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি গ্রাহক পর্যায়ে ২০ শতাংশ দাম বাড়ানোর আবেদন জমা দিয়েছে বিইআরসিতে। অন্যান্য বিতরণ কোম্পানিও জমা দিতে যাচ্ছে।
বিতরণ কোম্পানি সূত্র জানিয়েছে, পাইকারি দাম বাড়ানোর ঘোষণার আগেই তাদেরকে খুচরা দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব জমা দিতে বলা হয়েছে। তারা বলেছেন, পাইকারি দাম বৃদ্ধি না হলে তারা চাননি বিদ্যুতের দাম বাড়াতে।
গত ১৩ অক্টোবর বিদ্যুতের পাইকারি দাম বৃদ্ধির আবেদন নাকচ করে দিয়েছিল বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। পরে রিভিউ আবেদন জমা দেয় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। সেই রিভিউ প্রস্তাবের ভিত্তিতে নজিরবিহীন উচ্চদরে দাম বাড়ানো হয়। এর আগে কখনো একসঙ্গে ১৯.৯২ শতাংশ হারে দাম বাড়ানো হয়নি।
বিইআরসির সদস্য মোহাম্মদ আবু ফারুক জানিয়েছে, বিদ্যুতের পাইকারি দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব বাতিল করেছিলাম, সেই প্রস্তাবটি রিভিউ করার আবেদন করেছেন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। আমরা যে তিনটি কারণ দেখিয়ে বাতিল করেছিলাম সেগুলোর বিষয়ে ব্যাখ্যাসহ জমা দিয়েছে। পরে কমিশন সভা করে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ভাসানটেকের বাসিন্দা সুমন মিয়া জানিয়েছে, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি হলে বাজারে জিনিসপত্রের দাম আরেক দফা বেড়ে যাবে। বিদ্যুতের দাম এক টাকা বাড়লে সুযোগ সন্ধানী ব্যবসায়ীরা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেবে পণ্যের মূল্য। আবার যেখানে পৃথক মিটার নেই, সেসব বাসার মালিকরাও অনেক বেশি হারে আদায় করবেন। এটাই যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে। অল্পহারে দাম বাড়লেও পাবলিকের গলা ঠিকই কাটা হবে।
বিপদের মুখে পড়বেন শপিং মলের ব্যবসায়ীরাও। সেখানে পৃথক মিটারিং সিস্টেম নেই, মার্কেট মালিকের নির্ধারিত বিলই তাদের গুনতে হবে। এভাবে বিদ্যুতের দামের চক্রবৃদ্ধি প্রভাব পড়বে বাজারে।
ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান বলেছেন, আগে যখন বিদ্যুতের পাইকারি দাম বৃদ্ধির গণশুনানি হয়, তখন আমরা একটি ক্যালকুলেশন করেছিলাম। সেই ক্যালকুলেশন নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে বিইআরসিতে জমা দিতে কাজ চলছে।
এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, লোডশেডিং করায় এনার্জি বিক্রি কমে গেছে, এতে রাজস্বে কিছুটা ঘাটতি হতে পারে। তবে পাইকারি দাম না বাড়লে, আমরা দাম বাড়াতে চাইনি। আমরা মুনাফা চাই না, ব্রেক ইভেনে থাকতে চাই। শুধু অপরেশনাল, প্রশাসনিক ও এনার্জি খরচ তুলতে পারলেই হয়। আমরা চাই সাশ্রয়ী দরে উন্নত সেবা দিতে। তবে পাইকারি দাম বেড়ে গেছে এখন দাম না বাড়ালে কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) একজন পদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, খুচরা দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশনা মোতাবেক প্রস্তাব জমা দিয়েছি।
বিপিডিবির পাইকারি দাম বৃদ্ধির আবেদনে বলেছিল, চাহিদামতো গ্যাস সরবরাহ না পাওয়ায় তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে খরচ বেড়ে গেছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিদ্যুতে গড় উৎপাদন খরচ ছিল ২.১৩ টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩.১৬ টাকায়। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, কয়লার মূসক বৃদ্ধির কারণে ২০২২ সালে ইউনিটপ্রতি উৎপাদন খরচ দাঁড়াবে ৪.২৪ টাকায়। পাইকারি দাম না বাড়লে ২০২২ সালে ৩০ হাজার ২৫১ কোটি ৮০ লাখ টাকা লোকসান হবে।
বিপিডিবি নিজেরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে থেকে কেনে। ভারত থেকেও আমদানি করা হয় বড় একটি অংশ। সে সব বিদ্যুৎ বিইআরসির নির্ধারিত পাইকারি দরে বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রি করে থাকে। অন্যদিকে বিতরণ কোম্পানিগুলো পাইকারি দামের সঙ্গে পরিচালন ও উন্নয়ন খরচ যোগ করে দর প্রস্তাব দেয় বিইআরসিতে। বিইআরসি নির্ধারিত দরে গ্রাহকের কাছে তা বিক্রি করে থাকে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সিনিয়র সহসভাপতি জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল আলম বলেছেন, বিদ্যুতের প্রবৃদ্ধি ধরে দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। এখন তো বিদ্যুতের উৎপাদন কমিয়ে দিয়ে লোডশেডিং করা হচ্ছে। যে কারণে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করার কোনো সুযোগ ও প্রয়োজনীয়তা নেই। আমরা হিসাব করে দেখিয়ে দিয়েছি বিদ্যুতের দাম কমানো সম্ভব। ভোক্তারা বাড়তি বিল দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই এখন।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিদ্যুতের পাইকারি দর ইউনিটপ্রতি ৫.১৭ টাকা নির্ধারণ করে। বিপিডিবি ইউনিটপ্রতি বর্তমান দর ৫.১৭ টাকা থেকে ৬৬ শতাংশ বাড়িয়ে ৮.৫৮ টাকা করার আবেদন করেছিল। সেই প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি নেওয়া হয় গত মে মাসের ১৮ তারিখে। আর ১৩ অক্টোবর বিপিডিবি দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব নাকচ করে দেয় বিইআরসি। তখন বলা হয়েছিল কমিশনের আদেশে কোনো পক্ষ সংক্ষুব্ধ হলে ১ মাসের মধ্যে রিভিউয়ের সুযোগ রয়েছে।