চুকনগর গণহত্যা: রক্ত নদীর উপাখ্যান

মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জীবনের এক জন্ম জরুল। ৯ মাসের আকাঙ্খিত প্রহরবেষ্টিত অজস্র মানুষের আত্মদানের এ এক গৌরব গাঁথা। স্বাধীনতার চিন্তা বাঙালির নতুন নয়। এ আকাঙ্খা অনেক পুরনো। অতঃপর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামক সামরিক বর্বরতা শুরু হয়। প্রথমে শহর তারপর গ্রামের পর গ্রামজুড়ে চলে হত্যার মহোৎসব। গণহত্যা চলে নির্বিচারে।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শুরু হয় স্বাধীনতা যুদ্ধ। শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। একইসঙ্গে সারাদেশে চলছিল পাকিস্তানি বর্বরদের তা-ব। এ সময় যে যেভাবে পারে সে দেশ ছেড়েছে। তার মধ্যেও অনেকে ধরা পড়ে বর্বর পাকবাহিনীর নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছে। অনেকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানকার জীবনও মানবেতর ছিল; কিন্তু দেশতো হার্মাদদের জল্লাদখানা। রাস্তার ধারে, এভিনিউর মোড়ে, গ্রামে-গঞ্জে টিলায়, জলে স্থলে তারা হত্যার উৎসব শুরু করেছিল। নিরাপদ আশ্রয়- ভারত। এরকম আতঙ্ক ছড়িয়েছিল চারদিকে। বাতাসে ওতপেতে থাকত আততায়ীরা। সে কি শঙ্কার দিন, ঘাতকের উল্লাসের দিন, আমার পতাকা জন্মের দিন। শরণার্থী হতে অজুত মানুষ ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে। ছুটছে মুক্তির নেশায়। একবারে কোথাও যাওয়ার অবস্থা তখন ছিল না। পথে পথে মিলিটারি। বহুপথ পার হয়ে গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, বরিশাল, খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর থেকে অজুত মানুষ ভিড় জমিয়েছিল খুলনার ডুমুরিয়া থানার চুকনগরে। জায়গাটা নিরাপদ ভেবে এখানে শ্রান্তির অবকাশ নিচ্ছিল। কারণ পাকিস্তানি আর্মি যানবাহন বন্ধ করে দিলে এলাকার স্বাধীনতাকামী লোকজন (যারা পথ-ঘাট চিনতো) একসঙ্গে অনেক লোক জড়ো হলে ভারতের সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দিত। মিলিটারি, রাজাকারের চোখ ফাঁকি দিয়ে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার অপেক্ষায় তখন অজুত মানুষ। চুকনগর বাজার মাঠ, নদীতে নৌকা ভরা শুধু মানুষ আর মানুষ। কয়েক দিন ধরে তারা জমা হচ্ছিল। জীবন বাঁচানোর জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা ছিল সবার। একথা স্থানীয় রাজাকারদের মাধ্যমে খবর চলে যায় পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর কাছে। এ খবর পাওয়ার পর পাক বর্বর বাহিনীর কতগুলো কনভয় চলে আসে চুকনগর বাজারে। পাশে শান্ত শীতল ভদ্রা নদী বইছে। হঠাৎ শুরু হয় গুলি। নির্বিচারে মেশিনগানের তপ্ত বুলেট ছোড়ার শব্দে পাথর হয়ে যায় এলাকাবাসী। সে এক খা-বদাহন! নিহতের সংখ্যা কে গুনবে? কার্তিকের ঝরা ধানের মতো লাশ আর লাশ। মুহূর্তের মধ্যে কোলাহল মুখরিত চুকনগরে নেমে আসে কবরের নিস্তব্ধতা। জীবিত মানুষ নেই। 

একদিনে সংগঠিত পৃথিবীর বৃহত্তম গণহত্যা চুকনগর গণহত্যা। এই গণহত্যাকে যারা প্রত্যক্ষ করেছেন, যারা বেঁচে আছেন, লাশ সরিয়েছেন, লাশ গুনেছেন এমন মানুষের সঙ্গে কথা বললে শরীর হিম হয়ে আসে। এখনো জীবিত এলাকার প্রবীণ সাংবাদিক সামসুজ্জামান বলেন, কি ভয়ংকর ইতিহাসের সেই বিনিদ্র প্রহর। চারপাশ ঘিরেছিল আতঙ্কিত প্রহরে। সবাই আতঙ্কে কখন পাকিস্তানি বাহিনী এসে পড়বে। মানুষ প্রাণের ভয়ে পালাচ্ছে দিগি¦দিক। সবার গন্তব্য সীমান্তের ওপারে, কেউ পার হতে পারেনি। হত্যা-খুনে ভদ্রা নদীর রক্ত লাল হয়ে গিয়েছিল। আর কচুরি পানার মতো ভাসছিল মানুষের লাশ।

১৯৭১ সালের ২০ মের গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা মতে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক বর্বরোচিত গণহত্যার নানা অজানা ঘটনা উঠে এসেছে। সেদিন সকাল ১০টায় অধিকাংশ শরণার্থী পরিবার সকালের খাবার শেষ করে ভারতে পাড়ি জমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সেসময় চলে এ গণহত্যা, এই গণহত্যার পাশাপাশি বর্বর পাকিস্তানি বাহিনি যুবতী নারীদের ধর্ষণ করে। এ ছাড়াও অনেক বাঙালিকে নিকতবর্তী পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে পরে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। এ সময় চুকনগর বাজার কমিটির সদস্য সিরাজ উদ্দীন মোড়ল, গোলাম হোসেন নুরুজ্জামান ও হায়দার নামের তিন ব্যক্তি লাশ নদীতে ফেলার জন্য লোক ঠিক করে। এই গণহত্যার পরে ভদ্রা নদীতে লাশ ফেলার দায়িত্ব দেওয়া হয় অনেককে। প্রতি লাশের জন্য ৫০ পয়সা দেওয়া হবে বলে ঘোষণাও করা হয়। সেদিন যারা ৫০ পয়সায় ভদ্রা নদীতে লাশ ফেলেছিল তারা মাত্র ৪ হাজার লাশ ফেলেছিল। তারপরে আর স্থির থাকতে পারেনি। পচে গলে লাশ মিশে গেছে মাটিতে। এখনো জমি চাষ করলে মানুষের হাড় খুলি উঠে আসে। অলঙ্কারও পাওয়া যায়। শুধু মানুষগুলো জানেনি, কেন তারা এই বর্বরতার শিকার হয়েছিল।

চুকনগরের গণহত্যার প্রকৃতসংখ্যা নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যেও নানা মত রয়েছে। যেহেতু নিহতদের মধ্যে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা শরণার্থীর সংখ্যাই বেশি তাই প্রকৃতসংখ্যা নিয়ে জটিলতা কাটেনি এখনো। তবে গণহত্যা শেষে লাশ পরিষ্কারের দায়িত্বে যারা ছিলেন, তাদের জবানবন্দিতে নিহতের সংখ্যা ১০ হাজারের নিচে নয়।

গণহত্যার পর মাঠে, ঝোপঝাড়ে, জঙ্গলে, ধানক্ষেতে অসংখ্য লাশ পড়ে থাকতে দেখেছেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। 

ওই দিন শহীদ হওয়া অবিনাশ গাইনের ছেলে নিতাই গাইন বর্তমানে খুলনার বটিয়াঘাটায় বাস করেন। তিনি বলেন, ওইদিন একটি মসজিদের বারান্দায় প্রতিবেশী ভদ্র মহিলা আমাকে পাটি দিয়ে ঢেকে রেখেছিলেন। আমি পাটির ফাঁক দিয়ে দেখেছি পাকিস্তানিরা কীভাবে একে একে গুলি করে মানুষ হত্যা করেছে। আর সে গুলিতে আমার বাবা, চাচা বাদল গাইন, চাচি মালতী গাইন, চাচাতো ভাই রঞ্জিত গাইন ও ঈশ্বর গাইন, চাচাতো ভাইয়ের ছেলে বিনয় গাইন, পিসা অধর ম-ল, ফুফাতো ভাই ধীরেন ম-ল মারা যান।

একদিনে সংঘটিত পৃথিবীর বৃহত্তম গণহত্যার নাম হিসেবে ইতিহাসে ঠাঁই পেয়েছে ভিয়েতনামের মাইলাই। মাইলাইয়ের গণহত্যায় মারা যায় প্রায় ১৫০০ মানুষ। আর চুকনগরে কম করেও হলে গণহত্যার শিকার হয়েছে ১০ সহস্রাধিক মানুষ। তবু পৃথিবীর কোন ইতিহাসে এই গণহত্যার স্থান মেলেনি। বিশ্ব ইতিহাসের আগে চোখ ফেরানো দরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে। কোথাও নেই চুকনগর। চুকনগরের গণহত্যা কি তাহলে কথার কথা?

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //