টিকা সংগ্রহের নতুন জোট
দক্ষিণ এশিয়ার কূটনীতিতে উল্টোরথ!

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৪ মে ২০২১, ০৮:৪৩

মডার্না, জনসন অ্যান্ড জনসন ও ফাইজারের টিকা পেতেও উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ফাইল ছবি
দীর্ঘ দিনের সম্পর্কে হঠাৎই ছন্দপতন! বাংলাদেশে টিকা রফতানির চুক্তিতে খানিকটা রক্ষণশীল নীতি গ্রহণ করেছে প্রতিবেশী ভারত। দেশটির প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ এবং কূটনৈতিক পর্যায়ে সর্বোচ্চ যোগাযোগের পরও রক্ষণশীল সিদ্ধান্তেই অটুট দেশটি। এমন অবস্থায় টিকার সন্ধানে তাই বাংলাদেশ নতুন উৎসে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে।
রাশিয়ার প্রযুক্তি এনে বাংলাদেশে টিকা উৎপাদন বা চীনের নেতৃত্বে নতুন প্ল্যাটফর্মে যোগদানে এখন মনোযোগী বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জনগণকে রক্ষায় সরকারের বহুমুখী তৎপরতার একটি অংশ যেন এ উদ্যোগ, যা দক্ষিণ এশিয়ার কূটনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থানের গতিপথ পাল্টে দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। পাল্টে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক কূটনীতির ধরনও।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বাংলাদেশে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত ৫৭ লাখ ৯৮ হাজার ৮৮০ জন প্রথম ডোজের টিকা নিয়েছেন। আর দ্বিতীয় ডোজের টিকা নিয়েছেন ২১ লাখ ৫৫ হাজার ২৯৬ জন। টিকা গ্রহণের জন্য এ পর্যন্ত নিবন্ধন করেছেন ৭২ লাখ ৬ হাজার ৫৬৫ জন। এমন অবস্থায় প্রথম ডোজের টিকা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জনগণের জন্য করোনা সুরক্ষায় যাবতীয় স্বাস্থ্যসেবা দিতে বদ্ধ পরিকর সরকার। বিশেষ করে, দেশের জনগণকে বিনামূল্যে করোনার টিকা দিয়ে সুরক্ষা নিশ্চিতে সবধরনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ সরকার প্রধানের। তাই ভারতের সঙ্গে আগামী চুক্তিও করা হয়; কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকায় করোনার জন্য পূর্ব-পশ্চিমে দৌড়-ঝাঁপ শুরু করেছে বাংলাদেশ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় করোনার টিকা পেতে রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে ঢাকা আর যেখানে তৎপরতায় গতি ছিল চীন থেকে টিকা আমদানিতেও। উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা বেশি হওয়ায় আপাতত বাংলাদেশকে প্রযুক্তি দিয়ে সহযোগিতার কথা বলে কূটনীতির লাগাম নিজেদের ঘরেই রাখতে চাইছে রাশিয়া। সেদিক থেকে খানিকটা এগিয়ে চীন। চুক্তি হওয়া মাত্রই পাঁচ লাখ কোভিশিল্ড বাংলাদেশকে দিতে রাজি হয়েছে দেশটি। এর বাইরে মডার্না, জনসন অ্যান্ড জনসন ও ফাইজারের টিকা পেতেও উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তবে এসব উদ্যোগের মধ্যে আশার আলো দেখা যাচ্ছে চীনকে ঘিরেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চীনে যে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া করে, দেশটির সঙ্গে নিয়মিত যারা ব্যবসা করে, তারা চীনের টিকা নিতে চায়। কারণ চীনের টিকা নিলে তাদের সেখানে ভিসা প্রাপ্তি ও ভ্রমণ সহজ হবে।
করোনার পর্যাপ্ত টিকা সংগ্রহে ‘ইমার্জেন্সি ভ্যাকসিন স্টোরেজ ফ্যাসিলিটি ফর কোভিড ফর সাউথ এশিয়া’ নামের নতুন প্ল্যাটফর্মে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশ। কোভিড মোকাবেলায় বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানের মিলেমিশে কাজ করার আহ্বান থাকলেও আঞ্চলিক সহযোগিতার কোনো প্ল্যাটফর্ম এই প্রথম গঠিত হলো চীনের নেতৃত্বেই। আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নেপাল ও শ্রীলঙ্কাও এই প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশের সারথী। তবে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এই জোটে ভারত নেই।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, ‘বাংলাদেশ এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে দেশের মানুষকে সুরক্ষার বিষয়টি। কোনো দেশ বা প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর না করে তাই যেখানে টিকা পাওয়া যাবে, সেখানেই টিকা জোগাড়ের চেষ্টা করছে বাংলাদেশ। নতুন এই জোট নিয়ে তাঁর মন্তব্য, মানুষের প্রাণ রক্ষার বিষয়টি প্রাধান্য দেওয়া উচিত। নতুন কোনো জোট বা মোর্চাতে অন্তর্ভুক্তি হলেও প্রতিবেশীসহ সব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অটুট থাকবে- বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি সেটাই বলে।’
ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, দেশটিতে প্রতিদিন নতুন আক্রান্ত হচ্ছে সাড়ে তিন লাখ আর মারা যাচ্ছে দু’হাজারেরও বেশি লোক। এমন অবস্থায় ভারতীয় জনগণের মধ্যে টিকা প্রদানে মনোযোগী এখন দেশটি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা রফতানিতে শীর্ষ দেশ ভারত। এমন অবস্থায় অন্য দেশের কাছে করোনা টিকা চাইবে না তারা। তবে করোনা পরিস্থিতিতে টিকা সরবরাহের মাধ্যমে দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগে এগিয়ে থাকবে চীন। সব মিলিয়ে কূটনৈতিক গ্রাফে তা হয়তো বাড়তি সুবিধা চীনকে এনে দিবে না বলেই বিশেষজ্ঞদের মত।
সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক হুমায়ুন কবীর এ প্রতিবেদককে বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে নিজেদের সুরক্ষাই প্রথম অগ্রাধিকারে থাকা উচিত। ভারতে সংক্রমণের হার অত্যন্ত বেশি। এমন অবস্থায় তারা নিজেদের সুরক্ষায় রক্ষণশীল নীতি গ্রহণ করেছে। কাজেই কেবল বাংলাদেশ নয়, ভারত থেকে যেসব দেশ টিকা আমদানি করছে, তারাও চাইবে এমন অবস্থায় অন্য উৎস থেকে টিকা সংগ্রহ করতে। এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তিনি আরও বলেন, সংকটে এমন জোটের আবির্ভাব হতে পারে। তাতে কোনো দেশ এগিয়ে বা কেউ পিছিয়ে যাবে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বভাবতই দক্ষিণ এশিয়ায় যে কোনো মঞ্চ, জোট বা নতুন উদ্যোগে নেতৃত্ব দেয় ভারত। তবে প্রথমবারের মতো ভ্যাকসিন জোট গঠনের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় আরও প্রত্যক্ষভাবে ঢুকে গেলো চীন। অন্যদিকে টিকা নিয়ে ভারতের কৌশল সময়োপযোগী কোনো সিদ্ধান্ত নয়। কারণ নিজেদের প্রয়োজন মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছে তারা। করোনা পরিস্থিতির চরম বিপন্ন মুহূর্তে চীনের কাছ থেকে টিকা পেলে স্বভাবতই সেসব দেশ চীনের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। এসব ঘটনা ভারতকে আবর্তিত দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক রাজনীতি যে চীনের দিকে ঝুঁকে যাবে না, তা বলা কঠিন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, করোনার টিকা নিয়ে ভারতের কূটনৈতিক কৌশল সময়োপযোগী ছিল না। কেননা দেশটির অভ্যন্তরীণ চাহিদাই মেটাতে যেখানে হিমশিম খেতে হচ্ছে, সেখানে টিকা রফতানির সিদ্ধান্ত ভেবে-চিন্তে নেওয়া উচিত ছিল। করোনাকালে টিকা রফতানির প্রতিশ্রুতি না রাখলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ ভারতের প্রতি রুষ্ট হওয়া স্বাভাবিক।