
প্রতীকী ছবি
জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নিয়ে দেশের জনগণের দুর্ভোগ ও হয়রানি চরমে। শত কোটি টাকা খরচ করে ছবিসহ যে ভোটার তালিকা করা হলো তাও সবাই পাননি। যারাও পেয়েছেন ভুলে ভরা তথ্যের কারণে আজ ভোগান্তিতে। এনআইডির বেশির ভাগই ভুল করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। আর এখন ভোগান্তির শিকার জনগণ। তাদের ভুলের খেসারত দিচ্ছে দেশের জনগণ।
বর্তমানে ডিজিটাল বাংলাদেশের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি)। সন্তানকে স্কুলে ভর্তির সময় মা-বাবার এনআইডি লাগে। এমনকি মৃত্যুর পরও মৃত ব্যক্তির পরিবারের নানা কাজে লাগে তার এনআইডি নম্বর। এই কার্ড সংশোধনের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে। তবুও কোনো সমাধান পাচ্ছে না। আবার একশ্রেণির দালালদের ফাঁদে পড়ছেন অনেকেই। শিকার হচ্ছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরাও। ভোগান্তি থেকে রেহাই দেওয়ার জন্য ইসির এনআইডি অনুবিভাগ থেকে মাঠ পর্যায়ে নির্দেশনা দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়। তাতেও সমাধান হচ্ছে না বলে সরেজমিনের তথ্য থেকে জানা গেছে।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ১০ কোটি ৯৮ লাখ ভোটার রয়েছে। এর মধ্যে অনেক নাগরিকের কোনো না কোনো সমস্যা রয়েছে এনআইডিতে। তারা সেবা নিতে এসে বিভিন্ন সমস্যায় পড়ছেন। ২০০৮ সালে ছবিসহ ভোটার তালিকা করার পর থেকে ১৩ বছরে এখনো পর্যন্ত নাগরিকদের তথ্য হালনাগাদ করেনি নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রথমদিকে দেওয়া অনেক তথ্যই এখন পুরনো হয়ে গেছে। যা প্রতিনিয়ত সংশোধনে দৌড়ঝাঁপ করতে হচ্ছে নাগরিকদের। নাগরিক ভোগান্তি দূর করতে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে বিকেন্দ্রীকরণ করা হয় জাতীয় পরিচয়পত্র প্রাপ্তির সেবা কার্যক্রম। ভোটার জাতীয় পরিচয়পত্রের সংশোধন, হারানো কার্ড উত্তোলন এবং নতুন কার্ড মুদ্রণে মাঠের উপজেলা অফিস, জেলা অফিস, আঞ্চলিক নির্বাচন অফিস এবং জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের (এনআইডি) কার কী ক্ষমতা তা-ও নির্ধারিত হয় প্রজ্ঞাপনে। তারপরও যেন ভোগান্তি কমছে না। এসএসসি সনদধারীরা কিছুটা সেবা পেলেও, যাদের কোনো সনদ নেই এনআইডি সংশোধনে বেশি বেগ পেতে হয় তাদের।
জানা গেছে, সরকার ৯ কোটি নাগরিককে নতুন করে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের জন্য বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করেছে গত ২০১১ সালের জুলাইতে। আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহ্যান্সড অ্যাক্সেস টু সার্ভিস শীর্ষক এই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক সাড়ে ১৯ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে বাংলাদেশকে।
আবার এনআইডির সঙ্গে মিলছে না শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে প্রণীত স্মার্ট কার্ড। এই স্মার্ট কার্ড করার সময় কোনো ধরনের যোগাযোগ করা হয়নি সংশ্লিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে। ফলে দুটি কার্ডের তথ্যে অনেক ভুল এবং চরমভাবে অমিল রয়েছে। এটা নিয়েও ভোগান্তির শেষ নেই। নিজের নামে তো ভুল আছেই, কারো মায়ের নাম, কারো আবার বাবার নাম ঠিক নেই। ভুল ছাপা হয়েছে নিজের নামও। সিলেটের শ্রীমঙ্গলে সম্প্রতি বিতরণ করা ভুলে ভরা স্মার্টকার্ড নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়েছেন সেখানকার নাগরিকরা। প্রবাসী অধ্যুষিত এই উপজেলার মানুষকে এমন কার্ড নিয়ে দেশ ও বিদেশে বেশ বিড়ম্বনাতেই পড়তে হচ্ছে ও হবে।
আগারগাঁওয়ে এনআইডি অফিসে আসা একজন ভুক্তভোগী আব্দুল মালেক জানান, একটি অযৌক্তিক ভুল সংশোধন করতে এক বছর ধরে ঘুরছি। আমরা বাবা-ছেলে কিনা তারও প্রমাণ দিতে হয়েছে। জেলা কর্মকর্তা তদন্ত করে প্রতিবেদনও পাঠিয়েছেন। এরপরও আমরা এখনো সঠিক পরিচয়পত্র পাচ্ছি না।
সাভারের মেয়ে নাসিমা সৌদি আরবে থাকেন। তার পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তাই দেশে এসেছেন সেটাকে নবায়ন করে ই-পাসপোর্ট করতে। সবকিছু ঠিকঠাক করে পাসপোর্ট নবায়নের জন্য জমা দিলে সেখান থেকে বলা হয় তার এনআইডি ভুল। জন্মতারিখ মিলছে না। ওই এনআইডি দিয়েই পাসপোর্ট করে বিদেশে যান তিনি। তাকে ফেরত এসে সাভারে নির্বাচন অফিসে যোগাযোগ করে ভোগান্তির শিকার হতে হয়। তিনি জানান, নানা বাহানা তাকে দেওয়া হয় সেই ইসি অফিসে। তাকে অফিস সময়ের পর আসতে বলা হয়। এক পর্যায়ে তার কাছে মিষ্টি খাওয়ার জন্যও টাকা চাওয়া হয়। পরে তিনি এনআইডির প্রধান দপ্তরে যোগাযোগ করে সব জানালে সেখানকার হস্তক্ষেপের পর তার এনআইডিতে জন্মতারিখ সংশোধন করে দেওয়া হয়। এরপর তার পাসপোর্ট নবায়ন হয়। এমন অনেকেই হয়রানি হচ্ছেন মাসের পর মাস।
সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ পৌরসভার বাসিন্দা নায়েব আলী জানান, ভুলে ভরা জাতীয় পরিচয়পত্র বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে দিতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। আবার এ ভুল সংশোধন করতে গিয়েও উপজেলা নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে দফায় দফায় হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।
এদিকে, ইসির এনআইডি অনুবিভাগের পরিচালক (অপারেশন্স) মো. শাহেদুন্নবী চৌধুরী এনআইডি সংশোধন সংক্রান্ত নির্দেশনা দেশের সব আঞ্চলিক, জেলা ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের পাঠানো হয়েছে। এতে এনআইডি সেবা ত্বরান্বিত করে নাগরিকদের ভোগান্তি কমাতে মাঠপর্যায়ে ১২টি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। গত জুলাই মাসে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) সংশোধনে অযৌক্তিক দলিলাদি না চাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। একই সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে সংশোধনের আবেদন ঝুলিয়ে রাখা থেকেও বিরত থাকার নির্দেশনা দিয়েছে।
ওই নির্দেশনায় বলা হয়, জাতীয় পরিচয়পত্র সেবা বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যই ছিল নাগরিক সেবা আরও সহজ ও গতিশীল করা। সে লক্ষ্যে মাঠপর্যায়ে ক, খ, ও গ ক্যাটাগরির সংশোধনের আবেদনসমূহ সংযুক্ত দলিলাদি যাচাই-বাছাই ও প্রয়োজনানুসারে তদন্ত করে আবেদন নিষ্পত্তি (অনুমোদন/বাতিল) করে নাগরিক সেবাকে গতিশীল করার নিমিত্ত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এক্ষেত্রে নাগরিকদের দুর্ভোগ লাঘবে বিষয়টি সামনে রেখেই এনআইডি সংশোধনের আবেদন নিষ্পত্তি করতে হবে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা তার আওতাভুক্ত ক্যাটাগরির আবেদন পরীক্ষা করে নিজেই নিষ্পত্তি করবেন। এ জন্য যথাযথ শিক্ষাসনদ, জন্মসনদ বা অন্য যৌক্তিক প্রয়োজনীয় কাগজপত্র থাকার পরও অযৌক্তিকভাবে কোনো কাগজপত্র চাওয়া যাবে না।
আর নির্দেশনাগুলো হলো- নাগরিকদের দুর্ভোগ লাঘবে বিষয়টি লক্ষ রেখে জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের আবেদন নিষ্পত্তি করতে হবে। দীর্ঘদিন ধরে সংশোধনের আবেদন অনিষ্পন্ন রাখা হতে বিরত থাকতে হবে। প্রয়োজনে শুনানি গ্রহণ ও দাখিল করা যৌক্তিক কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে ১৫ কার্য দিবসের মধ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণকে তার আওতাধীন আবেদনসমূহ নিষ্পত্তি (অনুমোদন/বাতিল) করতে হবে। মাঠপর্যায়ে সব ক্যাটাগরির আবেদন নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সপ্তাহে ২ দিন শুনানি গ্রহণের ব্যবস্থা করতে হবে। শুনানি প্রদানের তারিখের পরবর্তী ১০ কার্য দিবসের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে। ক্যাটাগরি বিভাজনের পর হতে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা তার এখতিয়ারভুক্ত সংশোধনের আবেদনগুলো ক্যাটাগরি ‘ক’ ৭ কার্য দিবস, ক্যাটাগরি ‘খ’ ১৫ কার্য দিবস ও ক্যাটাগরি ‘গ’ ৩০ কার্য দিবসের মধ্যে নিষ্পন্ন করবেন।
ওই নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তারা তার আওতাধীন যে আবেদনসমূহ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থ হবেন, সে সব আবেদনের সংশ্লিষ্ট দলিলাদি, তদন্ত প্রতিবেদন এবং আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তারা সুস্পষ্ট মতামতসহ আবেদনসমূহ নিষ্পত্তির জন্য মহাপরিচালক, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ বরাবর প্রেরণ করবেন। এক্ষেত্রে বিদ্যমান প্রজ্ঞাপনের আলোকে ‘গ’ ক্যাটাগরি থেকে ‘ঘ’ ক্যাটাগরিতে স্থানান্তরের সুপারিশ করতে পারবেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদেরকে তার কার্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সফটওয়্যারে ইউজার অ্যাকাউন্টটি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে। সংশোধনের আবেদন নিষ্পন্নের বিষয়টি জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে পর্যবেক্ষণের আওতায় থাকবে। সব প্রকার লগ এনআইডি কেন্দ্রীয় ডাটাবেজে সংরক্ষিত থাকে। এতে প্রত্যেক ইউজার তার কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহিতার আওতায় থাকবে।
যে সব নাগরিক অনলাইনে আবেদন করতে অসমর্থ হবেন তাদের উপজেলা/থানা নির্বাচন অফিসে অনলাইনে আবেদনের বিষয়ে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করতে হবে। হেল্প ডেস্ক অনলাইন আবেদন সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহ ও সংশোধন সংশ্লিষ্ট যৌক্তিক দলিলাদির বিষয়ে তথ্য সরবরাহ করবে। এছাড়া জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে আবেদনের ক্যাটাগরি বিভাজন করার ক্ষেত্রে অঞ্চল ভিত্তিক সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সচেষ্ট থাকতে হবে।
ইসির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারাদেশে প্রতিদিন গড়ে হাজার খানেক আবেদন জমা পড়ে। এ বিষয়ে তিনটি ক্যাটাগরি রয়েছে। যার মধ্যে সামান্য ভুল থাকলে তা উপজেলা-জেলা অফিস থেকে সমাধান করা হয়। কিন্তু নানা ছুতোয় উপজেলা বা জেলা কার্যালয় এনআইডি সংশোধনে নানা বাহানা দেখায়। এ কাগজ সে কাগজ চায়, যার ফলে দেশের বিভিন্ন আঞ্চলিক অফিসে লক্ষাধিক এনআইডি সংশোধনের জন্য পড়ে রয়েছে। আর বয়স বা জটিল কোনো সংশোধনের জন্য আবেদনগুলো প্রধান কার্যালয়ে চলে আসে। অর্থাৎ বি এবং সি ক্যাটাগরির আবেদনগুলো প্রধান কার্যালয়ে পাঠান তারা। বর্তমান বি ক্যাটাগরির প্রায় ১০ হাজার আবেদন এবং সি ক্যাটাগরির হাজারের ঊর্ধ্বে আবেদন ইসিতে জমা আছে। এসব আবেদনের সপক্ষে তেমন কোনো কাগজপত্র বা প্রমাণপত্র জমা দিতে না পারায় আবেদনগুলোর সুরাহা করা যাচ্ছে না
জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক একেএম হুমায়ূন কবীর বলেন, এনআইডি সংশোধনে প্রতিদিন বহু ফাইল দেশের বিভিন্ন উপজেলা-জেলা অফিসে জমা পড়ছে। তা প্রধান কার্যালয়েও আসে। অধিকাংশের ত্রুটিগুলো বয়স বা নাম সংশোধনভিত্তিক। তার সপক্ষে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা না দিতে পারায় তাদের এনআইডি সংশোধন করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, তবে আমরা সতর্কভাবে চলছি। সব তথ্য যাচাই-বাছাই করে সঠিক পাওয়া গেলে সেটি সংশোধনযোগ্য।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল ভোগান্তির কথা স্বীকার করে বলেছেন, জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে অনেক হয়রানি আর ভোগান্তি হচ্ছে। কিছু কিছু মানুষের জন্য সুনাম বিঘ্নিত হচ্ছে। সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। তিনি বলেন, প্রভুর মতো আচরণ করলে হবে না। জনগণের ভৃত্য হিসেবে কাজ করতে হবে। সিইসি বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্রের প্রয়োজন অপরিসীম। ভুল বিভিন্ন কারণে হতে পারে। কারেকশনের ক্ষেত্রে কিন্তু চাহিবামাত্র ইহার বাহককে দিতে বাধ্য থাকিবে তা নয়। আমাদের পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হবে। কিন্তু মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হয়।