আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাড়ে ৪শ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ সুবিধা পেতে সরকার বেশ তাড়াহুড়া করেই সব ধরনের সেবা ও পণ্যের দাম বাড়িয়েছে এবং বাড়াচ্ছে। মাত্র সাত মাস আগে গত জুনে গ্যাস, সার, জ্বালানি তেল ও পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। ঠিক সেটার রেশ ধরে দেশের পরিবহনের ভাড়াও বৃদ্ধি করা হয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সারের দাম বাড়লেই জীবনযাত্রার সঙ্গে জড়িত সব ধরনের জিনিস ও সেবার মূল্যও বেড়ে যাবে। আবার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী ঘোষণাই করেছেন যে, মাসে মাসে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হবে। একইভাবে আবারও সমন্বয় করা হবে পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাসের দামও। কারণ সরকারকে এসব খাতে ভর্তুকি কমাতে হবে। এটাই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) অন্যতম শর্ত। আইএমএফকে তুষ্ট রাখতে মানুষের উপর চাপ বাড়াচ্ছে সরকার।
মূলত অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করার জন্য বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে সাড়ে ৪শ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে। আর বাংলাদেশকে সাড়ে ৪শ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত আলোচনা করতে ঢাকায় এসেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রতিনিধি দল। ওই ঋণের বিপরীতে সরকারকে ভর্তুকি কমাতে হবে। বাড়াতে হবে পণ্য ও সেবার দাম। আইএমএফের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) আন্তোয়েনেট মনসিও সায়েহর নেতৃত্বে ১৪ জানুয়ারি প্রতিনিধি দল ঢাকা পৌঁছায়। আইএমএফ মিশনপ্রধান রাহুল আনন্দসহ প্রতিনিধি দলে আরও চারজন ছিলেন বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এদিকে গত বছরের জুলাইয়ে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ চেয়ে আইএমএফকে চিঠি দেয় বাংলাদেশ। এরপর ২৬ অক্টোবর থেকে ৯ নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে বৈঠক করে রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে আইএমএফের প্রতিনিধি দল।
আর আইএমএফের ঋণের অর্থ পাওয়ার কারণেই গত ৫ জুন ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম ২২.৭৮ শতাংশ বাড়ানো হয়। পহেলা আগস্ট ইউরিয়া সারের দাম সাড়ে ৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। ৫ আগস্ট জ্বালানি তেলের দাম ৫২ শতাংশ বাড়ানো হয়। আর ২১ নভেম্বর পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের প্রতি ইউনিট ১৯.৯২ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে।
সর্বশেষ ১২ জানুয়ারি ২০২৩ সালে খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম গড়ে ৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা হলো। গত আগস্টে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। নভেম্বরে এটা কমে ৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ হয়েছে। কিন্তু এটাও সরকারি তথ্য। সদ্য বিদায়ী ডিসেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতির এই হার এখনো ৮.৭১ শতাংশ বলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সদ্য এই তথ্য প্রকাশ করেছে। খাদ্য খাতে এই মূল্যস্ফীতির হার ৮ শতাংশ এবং খাদ্য বহির্ভূত খাতে ১০ শতাংশকে ছুঁই ছুঁই করছে। নভেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮.৮৫ শতাংশ। তাই হার কমেছে ০.১৪ শতাংশ পয়েন্ট। কিন্তু বিবিএসের তথ্যই বলছে, নভেম্বরের তুলনায় ডিসেম্বরে সব ধরনের চাল ও আটার দাম বেড়েছে। মাছ, গোশত, তেল চিনি, ডিমসহ বেশিরভাগ ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে।
জানা যায়, আইএমএফের কাছ থেকে সর্বশেষ বাংলাদেশ ঋণসহায়তা পেয়েছিল ২০১২ সালে। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১০ সালেই আইএমএফ থেকে ঋণ চাওয়ার কথা প্রথম বলেছিলেন। পরের বছর সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বার্ষিক সভায় আনুষ্ঠানিকভাবে আইএমএফের কাছে ঋণসহায়তা চান তিনি। সেই ঋণ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা শুরু থেকে ঋণের শেষ কিস্তি পাওয়া পর্যন্ত সময়ে সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছিল পাঁচবার, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় আটবার এবং পানির দাম বাড়ানো হয় পাঁচবার।
এর আগে ১২ বার আইএমএফ থেকে ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৭২ সালে সদস্য হওয়ার পর আইএমএফ থেকে প্রথম ঋণ নেওয়া হয় ১৯৭৪ সালে। ২০১২ সালে নেওয়া সর্বশেষ ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার। সেটাই ছিল আইএমএফের কাছ থেকে নেওয়া সর্বোচ্চ ঋণ। আর এবার বাংলাদেশ পাবে আরও বেশি-৪৫০ কোটি ডলার। এই অর্থের মধ্যে ৩২০ কোটি ডলার পাওয়া যাবে বর্ধিত ঋণ সুবিধার (ইসিএফ-ইএফএফ) আওতায় এবং বাকি ১৩০ কোটি দেওয়া হবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায়।
অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ঋণের জন্য মূলত পাঁচ ধরনের পদক্ষেপ বাংলাদেশকে গ্রহণ করতে হবে। যেমন সরকারের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, মূল্যস্ফীতি কমাতে মুদ্রানীতির কাঠামো আধুনিকায়ন, আর্থিক খাতকে শক্তিশালীকরণ, বাণিজ্য পরিবেশ আরও উন্নত করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলার সামর্থ্য আরও বাড়ানো। আর এই পাঁচ ধরনের বিষয়ের মধ্যে মূল বিষয়ই হচ্ছে, সরকারের ভর্তুকি কমাতে হবে। যাতে সরকার বেশি অর্থ উন্নয়ন ও সামাজিক খাতে ব্যয় করতে পারে। ফলে সরকারকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি, গ্যাস, পানি ও সারের দাম বাড়াতে হবে। ওই সব পণ্যেই সরকারকে বেশি ভর্তুকি দিতে হয়। সরকার এ কাজ সহজেই করে ফেলছে। ব্যাংকিং খাতের উপরও বিশেষ নজর দিতে হবে সরকারকে। আইএমএফ খেলাপি ঋণ কমানো, সরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ থেকে আমলা পরিচালকদের বাদ দেওয়া, বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা বাড়ানো, বেসরকারি ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা এবং পুঁজিবাজারকে উন্নত করার কথা বলেছে। যা সরকারের জন্য হবে সবচেয়ে কঠিন কাজ। কারণ রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা এই খাত দখল করে রেখেছে।
আগামী ২০২৪ সালের নির্বাচন বেশ ঘনিয়ে আসছে। ঠিক এই মুহূর্তে সরকার এই সব সংস্কার কাজ কতটা করতে পারবে সেটা নিয়েও চরম সন্দেহ রয়েছে। কারণ এর আগে ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন নিয়ে ব্যবসায়ীদের চরম আপত্তির মুখে সেটা বাস্তবায়নে বিলম্ব হয়েছে। যে কারণে আন্তর্জাতিক ওই সংস্থাটির কাছে সরকারকে বেশ প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয়েছে।
সম্প্রতি আবার খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দামবৃদ্ধি হলো। পাশাপাশি গ্যাসের দাম আবারও বাড়ানোর বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। চলছে পানির দাম বৃদ্ধির আলোচনা। আর এসবের প্রভাব পড়বে দেশের কৃষি ও শিল্পে। সেখানে উৎপাদিত পণ্যে ও সেবার দাম বাড়বে। যার ভোগান্তির শিকার হবে দেশের ভোক্তারা। মূল্যস্ফীতি আরও ঊর্ধ্বমুখী হবে। বেড়ে যাবে জীবনযাত্রার ব্যয়। নাভিশ্বাস উঠবে সাধারণ মানুষের।
অর্থমন্ত্রী বলেন, আইএমএফ তিন মাসের মধ্যে ঋণ প্রস্তাবের সব আনুষ্ঠানিকতা এবং চূড়ান্ত বোর্ড অনুমোদন সম্পন্ন করবে। ঋণটি ২০২৬ সাল পর্যন্ত চার বছর মেয়াদি। এ ঋণ মোট সাত কিস্তিতে পাওয়া যাবে। মোট ঋণের পরিমাণ ৩ দশমিক ৪৬৮ বিলিয়ন এসডিআর (স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস)। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী যা প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমান এসডিআর সুদ হার অনুযায়ী ঋণের গড় সুদহার ২ দশমিক ২০ শতাংশ।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুরের মতে, আইএমএফের ঋণের বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। যে কোনো সময়ে ঘোষণা আসতে পারে। তিনি বলেন, সারের পর তেলের দাম বাড়ানোয় এখন আমাদের বুঝতে সমস্যা হচ্ছে না যে, ঋণ পেতেই আইএমএফের কথা মতো তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে।
এই ঋণের ব্যাপারে সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের অভিমত হলো, দেশে এমনিতেই মূল্যস্ফীতির হার বেশি, তার মধ্যে আবার বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম। এটা মোটেও যৌক্তিক হয়নি। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে একদিকে যেমন বিদ্যুতের বিল বাড়বে, অন্যদিকে বাজারে পণ্যের দাম আরও বাড়বে। যেমন কৃষিকাজে সেচের ব্যয় বাড়বে। কৃষিপণ্যের দাম বাড়বে। এর সঙ্গে দোকানের বিদ্যুৎ এবং কারখানায় উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। সাধারণত দেখা যায়, ব্যয় বৃদ্ধির বড় একটি অংশ ভোক্তাদের ওপর চাপানো হয়। তিনি বলেন, সম্ভবত আইএমএফের ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে তারা যে ভর্তুকি ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তনের কথা বলেছিল, তার অংশ হিসেবে এটা করা হয়েছে। আমি মনে করি, মূল্য বৃদ্ধি না করে অন্যভাবে তা করা যেত।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : আইএমএফ ঋণ ডলার বিদ্যুতের দাম
© 2023 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh