কতটা এগোলো ডাক বিভাগ

চিঠি দিও প্রতিদিন, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো.... এরকম কতশত গান। চিঠির জন্য অপেক্ষার পর অপেক্ষা, চিঠি পেলে আনন্দে উদ্বেলিত হওয়া, এ সবই এখন অতীত বললে ভুল হবে না। আধুনিক প্রযুক্তির যুগে কেউ আর ব্যক্তিগত চিঠি লেখে না। দাপ্তরিক কাগজপত্রও অনেকটা ই-মেইলনির্ভর হয়ে গেছে। বাসার সামনে যেসব ডাকবাক্স ছিল, সেগুলো আর বাসিন্দাদের কাজে আসছে না। রাজধানীর সড়কের চিঠির বাক্সগুলো হয় জরাজীর্ণ, না হয় তুলে নেওয়া হয়েছে। ডাক বিভাগের মেট্রো সার্কেল ঢাকা থেকে জানা যায়, মহানগরে এখন ১১৮টি চিঠির বাক্স আছে। সড়ক সংস্কারসহ নানা কারণে এগুলো তুলে নেওয়া হচ্ছে। এখন সামাজিক মাধ্যম, ইন্টারনেট-ডিজিটাল যুগে মুহূর্তেই যোগাযোগ করা যাচ্ছে প্রয়োজনীয় মানুষের সঙ্গে। মানুষের ব্যস্ততা বেড়েছে, জীবন থেকে হারিয়ে গেছে চিঠির গুরুত্ব। কিন্তু বাস্তবতা ও যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডাক বিভাগ কী এগোতে পারছে- এমন প্রশ্ন এখন উঠছে।

ডাক বিভাগ দাবি করছে, সময়ের আবর্তে তাদের কাজের ধরনে পরিবর্তন এসেছে। আর তাই এখন ডাক হরকরা বা ডাক পিয়নদের কাজকে ডিজিটাইজড করার প্রতি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। একই সঙ্গে আর্থিক খাতসহ বিভিন্ন সেবা খাতকে ডিজিটাল প্রযুক্তির আওতায় এনে সেবা দিতে কাজ করছে ডাক বিভাগ।

এখন সময়ের চাহিদায় খুব অল্প সময়েই মোবাইলে একটি ছোট্ট মেসেজের মাধ্যমে চিঠির বার্তা পৌঁছে যাচ্ছে। তাই ব্যক্তিগতভাবে খুব কম মানুষই চিঠি লেখে। ডাক বিভাগের সূত্র জানাচ্ছে, ব্যক্তিগত চিঠির পরিমাণ কমলেও এর কাজের পরিধি একেবারেই কমেনি। কমেনি সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন দাপ্তরিক চিঠির চাহিদা। একই সঙ্গে বেড়েছে বিভিন্ন অফিসের কার্যক্রমের চাহিদা।

আনজুমান ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তিনি নিয়মিত মানি অর্ডারের মাধ্যমে তার বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে বাবা-মায়ের জন্য টাকা পাঠান। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘একমাত্র মানি অর্ডার করলেই ডাকপিয়ন গিয়ে বাড়িতে টাকা পৌঁছে দিয়ে আসে। এর বাইরে বিকাশে বা নগদে পাঠালে কিংবা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা করলে সেই টাকা বাবা-মাকে বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়ে তুলতে হয়। আর এখন রাস্তা-ঘাটের যে অবস্থা। বয়স্ক মানুষের জন্য রাস্তায় বের হওয়াটা খুব রিস্ক। তাই আমি মার্নি অর্ডার করাটাকেই বেশি নিরাপদ মনে করি।’ 

ডাক বিভাগের জন্মকথা
এই উপমহাদেশে প্রথম ডাক সেবা চালু হয় ১৭৭৪ সালে। আর ব্রিটিশ ভারতে প্রথম ডাক বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয় ১৮৫৪ সালে। স্থায়ীভাবে প্রথম ডাকটিকিট চালু হয় ১৮৫২ সালে সিন্ধুতে। ১৮৭৮ সালে ঢাকায় সদর দপ্তর করে ইস্ট বেঙ্গল পোস্টাল সার্কেল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৫ সালে ঢাকার সদরঘাটে স্থাপিত হয় প্রথম জিপিও। ১৯৫০ সালে সদরঘাট থেকে গুলিস্তান জিরো পয়েন্টে জিপিও স্থানান্তর হয়। ১৯৬২ সালে অপারেশনাল কার্যক্রমের লক্ষ্যে তিনতলা ভিত্তির ওপর বর্তমান জিপিও ভবন নির্মাণ করা হয়। ১৯৭১ সালের ৬ মে যশোরের শার্শা উপজেলার সীমান্ত সংলগ্ন গ্রাম কাশিপুরে মুজিবনগর সরকার প্রথম ডাকঘর স্থাপন করে। ১৯৭১ সালের ২৯ জুলাই মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকার বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকিট- যা ৮টি ডাকটিকিটের একটি সেট প্রকাশ করে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর সেবাই আদর্শ স্লোগানে ডাক অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়।

ইউপিইউয়ের সদস্যপদ লাভ
বাংলাদেশ ডাক বিভাগ শুরু থেকে যেসব কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং বর্তমানে যে ডিজিটাল ব্যবস্থা চালু করছে এর পুরোটাই ইউপিইউয়ের অধীনে আইন দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ১৪৭তম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব ডাক সংস্থার (ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়ন-ইউপিইউ) সদস্যপদ লাভ করে। ইউপিইউয়ের শর্তানুযায়ী, দেশের প্রত্যেক নাগরিক তার নিজ এলাকায় ডাক সুবিধা পাবে। সেবা সবার জন্য গ্রহণযোগ্য হতে হবে। প্রত্যেক এলাকায় সম্মানিত ব্যক্তি, স্থানীয় পোস্ট মাস্টার হিসেবে বিবেচিত হবে। ইউপিইউয়ের শর্তানুযায়ী, বর্তমানে কোনো স্থানীয় ব্যক্তি জমি দিলে উপজেলা পর্যায়ে দুই কক্ষবিশিষ্ট ডাকঘর স্থাপন করে দিচ্ছে সরকার।

ডাক সেবাসমূহ
বর্তমানে ডাক বিভাগের যেসব সেবা চালু আছে এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, সাধারণ- সর্বজনীন ডাকসেবা, রেজিস্ট্রি- দায়বদ্ধ ডাকসেবা, জিইপি- দ্রুত ডাকসেবা ও নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যসমূহ, পার্সেল- ভারী পণ্যের ডাক সেবা ও হোম ডেলিভারি, ব্লাইন্ড লিটারেচার- বিনা মাসুলে প্রদেয় দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের পঠন সামগ্রী পরিবহনের বিশেষ সুবিধা, ভ্যালু পেয়েবল- দেশের যে কোনো প্রান্তের ক্রেতার নিকট বাণিজ্যিক পণ্য বিলি ও পণ্যমূল্য আদায়, ইনস্যুরড- ডাক দ্রব্যের বীমা করার সুবিধা ও ডাকদ্রব্য খোয়া গেলে ক্ষতিপূরণ, হোম ডেলিভারি-চাহিদা মোতাবেক বাড়ির ঠিকানায় ডাকদ্রব্য বিলির সুবিধা, উইন্ডো ডেলিভারি- চাহিদা মোতাবেক ডাকঘরে এসে ডাক দ্রব্য, বিলি নেওয়ার সুবিধা।

আর্থিক সেবাসমূহ
ডাক বিভাগ থেকে দেওয়া আর্থিক সুুবিধাগুলো হচ্ছে- আর্থিক সঞ্চয় ব্যাংক, ডাক জীবন বীমা, সঞ্চয়পত্র, মানি অর্ডার, মানি অর্ডার- ইলেকট্রনিক মানি ট্রান্সফার সার্ভিস (ইএমটিএস), আন্তর্জাতিক ইলেকট্রনিক মানি অর্ডার (অইএমও), পোস্টাল অর্ডার, প্রাইজবন্ড, নগদ ডাক বিভাগের ডিজিটাল লেনদেন, পোস্টাল ক্যাশ কার্ড, রাজস্ব স্ট্যাম্পস, এক্সাইজ স্ট্যাম্পস, নন-পোস্টাল স্ট্যাম্পস, নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পস, নন-পোস্টাল স্ট্যাম্পস, চেইন ম্যানেজমেন্ট, বিডি ব্যান্ডরোল ইত্যাদি।

ডাক বিভাগ সূত্র জানায়, যে কোনো পণ্য ডাকযোগে পাঠানোর ক্ষেত্রে একটি বারকোড যুক্ত করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে গ্রাহক ঘরে বসেই তার পণ্যটির অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবে। সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে গ্রাহককে ডিজিটাল সেবার আওতায় আনা হয়েছে। এর ফলে তার মাসিক মুনাফার হার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হচ্ছে। গ্রাহককে আর ডাকঘরে গিয়ে তার প্রাপ্য মুনাফার টাকা তুলতে হবে না।

বিশেষ জনপ্রিয় সেবা
ডাক বিভাগ সূত্র জানায়, ডাকযোগে ভূমি সেবা একটি অন্যতম জনপ্রিয় সেবা। এই সেবার আওতায় একজন ভূমির মালিক তার হালনাগাদ খতিয়ান ও মৌজা ম্যাপ পাওয়ার জন্য অনলাইনে ভূমি অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে গিয়ে ফরম পূরণ করবেন। এরপর সেই ফরমের তথ্য ভূমি অধিদপ্তর ডাক বিভাগকে দিয়ে ডাক বিভাগ প্রাপকের চাহিদানুযায়ী তার কাছে পৌঁছে দেবে। 

ডাকযোগে পাসপোর্ট সেবাও ডাক বিভাগের আরেকটি ডিজিটাল গ্রাহক সেবা। গ্রাহক পাসপোর্ট অফিসের মাধ্যমে তার পাসপোর্টের যাবতীয় তথ্য পূরণ করবে। পাসপোর্ট হয়ে যাওয়ার পর এটি নেওয়ার জন্য তাকে অফিসে গিয়ে ধরনা দিতে হতো। এখন থেকে ডাকযোগে পাসপোর্টটি তার নির্ধারিত ঠিকানায় পৌঁছে দেবে। স্মার্ট ড্রাইভিং লাইসেন্স সেবার আওতায় এখন ড্রাইভিং লাইসেন্স পাচ্ছে গ্রাহক। এটি ২০২৩ সালের ১৫ জানুয়ারি৬ থেকে চালু আছে। এর মাধ্যমে নিজের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেওয়ার জন্য গ্রহীতাকে আর বিআরটিএতে গিয়ে ধরনা দিতে হবে না। বিআরটিএ কর্তৃক ইস্যুকৃত ড্রাইভিং লাইসেন্স ডাক বিভাগ নির্ধারিত গ্রহীতার কাছে তার কপি পৌঁছে দেবে।

নতুন সংযোজন হিমায়িত খাদ্যদ্রব্য পরিবহন
দেশের ৬টি জেলায় হিমায়িত পণ্য পরিবহনের কাজ শুরু করেছে ডাক বিভাগ। ঢাকা, বরিশাল, রাজশাহী, খুলনা, যশোর, চট্টগ্রামে এই সেবা পাওয়া যাচ্ছে। এর জন্য ১৪টি মেইল প্রসেসিং সেন্টারে ফ্রিজিং প্রসেসিং সিস্টেম তৈরি করা হয়েছে। ডাক বিভাগ সূত্র জানায়, এই পদ্ধতিতে কাঁচা মাছ, মাংস থেকে শুরু করে রান্না করা খাবারও পাঠানো যাবে। ঢাকার তেজগাঁও মেইল প্রসেসিং সেন্টার থেকে এই পণ্যের বুকিং নেওয়া হচ্ছে। এই পণ্যগুলো নেওয়ার পর ডাক গাড়ির ফ্রিজিং ভ্যানে বহন করা হয়। যার ফলে এটি নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে।

সারাদেশে বর্তমানে ৯ হাজার ৯শ ৭৪টি ডাকঘর ও ১৮ হাজার কাউন্টার রয়েছে। প্রতিবছর এই ডাকঘরের মাধ্যমে ৫ কোটি ডাকদ্রব্য বিলি হয়। বিশ্বের ১৭৮টি দেশের সঙ্গে বিমানযোগে এবং ১৮১টি দেশে সমুদ্রপথে ডাক ব্যবস্থা চালু আছে। প্রতিদিন সরকারের প্রায় ৭৫ হাজার কিলোমিটার ডাক পরিবহন হয়। প্রতি ডাকঘরে গড়ে ১৫ বর্গকিলোমিটার এলাকায় সেবা প্রদান করা হয়। সারা দেশে প্রায় ১০ হাজার পোস্টম্যান রয়েছে। ডাকঘরপ্রতি গড়ে ১৫ হাজার মানুষের ঠিকানা রয়েছে। 

ডাক বিভাগের ডেপুটি পোস্ট মাস্টার জেনারেল মোহাম্মদ মাসুদ পারভেজ জানান, ডাক বিভাগের সেবাকে গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিতে একে সময়োপোযোগী ও প্রযুক্তি নির্ভর সেবায় পরিণত করছি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2023 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //