-copy-66a4e1c51a247.jpg)
সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য সেনা মোতায়েন। ছবি: সংগৃহীত
কোটা সংস্কার ইস্যুতে চলমান আন্দোলনে দেশজুড়ে সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে ১৯ জুলাই মধ্যরাতে সারা দেশে কারফিউ জারি করা হয়। অনির্দিষ্টকালের জন্য সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত হয়। এতে ২০০৭ সালের পর আবারও ভিন্ন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি দেশ। এমন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন দেশবাসী।
মর্গ যেন নরকপুরী
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গ। এখানে বসে তিন দিন ধরে কাঁদছেন তিনি। এখন চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে। ৭২ ঘণ্টা পর আহাদের লাশ অ্যাম্বুলেন্সে রাখতে রাখতে নিচু স্বরে বিলাপ করছিলেন, ডাকছিলেন সৃষ্টিকর্তাকে। তার বিলাপে অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলেন না।
আবুল হাসান চাকরি করেন সরকারের রাজস্ব বিভাগে। যাত্রাবাড়ীর রায়েরবাগ এলাকায় তার বাসা। কোটা সংস্কার আন্দোলন সহিংস রূপ পাওয়ার পর গত বৃহস্পতিবার থেকে ওই এলাকা পরিণত হয় রণক্ষেত্রে।
গত শুক্রবার (২০ জুলাই) বাবা-মায়ের সঙ্গে আটতলার ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয় আহাদ। পরে স্বজনেরা মিলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এরপর থেকে আহাদের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢামেক মর্গে রাখা। আবুল হাসানের মতো একই পরিস্থিতি দশ বছরের হোসাইনের বাবা মানিক মিয়া আর মা মালেকা বেগমের। মর্গের সামনে বসে বিলাপ করছিলেন। মানিক মিয়া ফুটপাতে আচার বিক্রি করেন। আর মালেকা গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করেন। শুক্রবার দুপুরের পর বাসা থেকে বের হয়ে পেটে গুলিবিদ্ধ হয় হোসাইন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। শিশুটির মা মালেকা বলছিলেন, আমি দুপুরে পুতেরে ভাত খাওয়াইয়া, প্যান্ট-গেঞ্জি পরাইয়া দিছি। কিছুক্ষণ পর ও বাসা থিকা বাইর হইল। এরপর বিকালে আর বিচরায়া পাই না। মাইনষে মোবাইলে ছবি দেখাইয়া কয় এইটা কী আপনেগো পুত, তাইলে ঢাকা মেডিক্যালে যান। আইসা দেখি পুতে আমার মইরা গ্যাছে গা।
২৫ বছরের জিসান ভ্যানে করে অফিসে-বাড়িতে পানি সরবরাহ করতেন। শনিবার পানির গাড়ি নিয়ে বের হওয়ার পর রায়েরবাগ এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি। গত রবিবার ঢাকা মেডিক্যালের মর্গের পাশে গাছতলায় বসে বিলাপ করছিলেন তার মা। কাছে গিয়ে নাম জানতে চাইলে বললেন, আমার কুনো নাম নাই, মাইনষে আমারে জিসানের মা কইতো। অ্যাহন আমার পোলায় তো আর নাই, আমিও নাই।
ঢামেকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১৭ জুলাই থেকে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত ময়নাতদন্ত শেষে ৭৮ জনের লাশ তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ছাড়া মর্গে রয়েছে আরও চার লাশ। তবে এদের পরিচয় নিশ্চিত না হওয়ার কারণে লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা যায়নি। তবে আসল চিত্রটা হয়তো ভিন্ন। অনেকেই লাশ নিয়ে চলে গেছেন নথিভুক্ত না করেই। তাদের কোনো হিসাব এই মর্গে নেই।
আর এখনো প্রতিদিনই নিখোঁজ অনেকের সন্ধানে মর্গের সামনে ভিড় করছে মানুষ। তাদের আহাজারি আর স্বজন হারানো মানুষের কান্না আর্তচিৎকার আর বিলাপে ঢামেক মর্গ এক জীবন্ত নরক পুরীতে পরিণত হয়েছে।
নিম্ন আয়ের মানুষ
রবিবার (২১ জুলাই) দুপুর আড়াইটা। পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্ক। পান-সিগারেট বিক্রেতা কাশেম মিয়া বসে ছিলেন উদাস ভঙ্গিতে। সড়কে যানবাহন চলাচল নেই বললেই চলে। মানুষও কম। যারা বের হয়েছেন তাদেরও বাসায় ফেরার তাড়া। চারপাশে আতঙ্ক, কখন কী হয়। তবে এসবের লেশমাত্র নেই কাশেম মিয়ার চেহারায়। তার চোখে উদাস দৃষ্টি। কথা বলতেই জানা গেল, তিন দিন ধরে ঘরে ছোট মেয়েটি জ্বরে আক্রান্ত। চিকিৎসা করাবেন সেই অবস্থা নেই। কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে গত এক সপ্তাহ ধরে বাসায় বসা, আজকে বাধ্য হয়েই বের হয়েছেন। যদি বিক্রি ভালো হয় তবে মেয়েকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন। এ ছাড়া ঘরেও অভাব, আর হয়তো দুদিন, তারপর পেটের ভাতেও টান পড়বে। কাশেম মিয়া বলেন, প্রতিদিন আগে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকার বেচাকেনা হলেও এখন তা নেমে এসেছে ১০০ কি ২০০ টাকার ঘরে।
শুধু কাশেম মিয়া নয়, চলমান কারফিউতে বেকায়দায় পড়েছেন সব শ্রেণির মানুষ। তাদের আয়ে ভাটা পড়েছে। তবে গত চার দিন কোনো সহিংসতার ঘটনা না থাকায় নগর জীবনে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরছে। লোকজনও আয়ের জন্য রাস্তায় নামছে।
গত মঙ্গলবার (২৩ জুলাই) গুলিস্তানে ভ্যানে আম নিয়ে বসে ছিলেন আনোয়ার। কারফিউর কারণে তিন দিন তিনি বাসা থেকে বের হননি। গতকাল মঙ্গলবার কারফিউ শিথিল হলে বের হন। দুই ঘণ্টায় ৬০০ টাকার মতো বেচাবিক্রি হয় তার। বলেন, মারামারি হলে পরিবারের লোকজন বাসা থেকে বের হতে দেয় না। তারা ভয় পায়। কিন্তু আয় না থাকলে পেটে ভাত জুটবে না।
তার সঙ্গে কথা শেষ করে দেখা হয় পঞ্চাশোর্র্ধ্ব রিকশাচালক মো. ইউসুফের সঙ্গে। জিরো পয়েন্ট মোড়ে বসে ছিলেন তিনি। চারপাশে তাকিয়ে খুঁজছেন যাত্রী। সামনে দিয়ে যে যাচ্ছে, তাকেই জিজ্ঞাসা করছেন, কোথায় যাবেন? তিনি বলেন, দুই ঘণ্টায় একটি ভাড়াও পাইনি। ভাতের টাকাও জোগাড় করতে পারছি না। তাই বাসায় চলে যাচ্ছি। লোকজন বের হলেও বাসাবাড়ির পাশ থেকে বাজার-সদাই করে ফিরে যাচ্ছে। দূরে কোথাও যাচ্ছে না।
কোটা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে দেশজুড়ে উদ্ভূত সহিংস পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেকায়দায় পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। শহরাঞ্চলে লোকজনের স্বাভাবিক চলাফেরা না থাকায় দিনমজুর, হকার, পরিবহন শ্রমিকসহ অনেকে বেকার হয়ে পড়েছেন। অনেকেই ধারকর্জ করে দুই বেলা খাবার জোগাড় করছেন। যারা তা পারছেন না অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটছে তাদের।
বাজার দর
এক দিকে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের সংহিংসতা, আরেকদিকে কারফিউ। এর মধ্যে আটকা পড়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পণ্য নিয়ে রাজধানীতে আসা শত শত পণ্যবাহী ট্রাক। দেশের বিভিন্ন সড়কে অপেক্ষায় থাকা ট্রাকগুলো যেন জৈব সার তৈরির কারখানায় রূপান্তর হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সংঘর্ষের কারণে অসংখ্য ট্রাক আটকা পড়ে। কাঁচপুর ব্রিজের অপর প্রান্তে সিলেট থেকে বিভিন্ন রকমের সবজি নিয়ে ঢাকায় আসছিলেন রহমান মিয়া। তিনি জানান, তিন দিন ধরে এখানে রয়েছেন। ট্রাকের ভেতর বেশিরভাগ কাঁচামাল পচে গেছে, দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। চারপাশে দুর্গন্ধে তার কথার সত্যতা মিলল। একই চিত্র ছিল নবীনগরে। সাভারে তুমুল সংঘর্ষের কারণে এখানে মাছ নিয়ে আটকা পড়েন ট্রাক ড্রাইভার মাসুদ। তিনি বলেন, আমি চার দিন ধরে মাছ নিয়ে এখানে বসে আছি। কিন্তু তার ট্রাক খালি। তিনি জানান, আজ সোমবার ভোরে পচা মাছের গন্ধ সহ্য করতে না পেরে তিনি সব মাছ রাস্তার পাশের এক নর্দমায় ফেলে দেন। তাহলে এখনো বাড়ির দিকে যাচ্ছেন না কেন? এমন প্রশ্ন শুনে হেসে বলেন, তেল নেই। টাকা আনমু সেই অবস্থাও নেই। বিকাশও বন্ধ। গতকাল রবিবার থেকে এক বেলা খেয়ে এই সড়কে হেলপারসহ বসে আছেন তিনি।
একই পরিস্থিতি ঢাকার অন্যান্য প্রবেশ পথগুলোতেও। আর এমন পরিস্থিতির প্রভাব পড়েছে রাজধানীতে। প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়েছে। আর তাতে আন্দোলন আর কারফিউতে আয়হীন মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, কারফিউতে দেশের সব জায়গায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি কম হওয়ায় খুচরা বাজারে দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। তবে খুচরা ব্যবসায়ীদের দাবি, দাম বেশি বাড়ানো হয়নি। আর ক্রেতারা বলছেন টাকা থাকলেও অনেক পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না। মূলত দেশের বিভিন্ন জেলার বিভিন্ন স্থানে পরিবহন চলাচল করতে না পারায় নিত্য পণ্যের দাম বেড়েছে বলে জানিয়েছেন আড়তদাররা।
স্বস্তির খবর নেই মাছের বাজারেও। প্রকারভেদে মাছের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ২০ থেকে ১০০ টাকা। ক্রেতারা মাছ কিনতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন। এ ছাড়া স্বস্তি নেই মাংস ও মসলার বাজারেও। ব্যবসায়ীরা জানান, কারফিউর কারণে কোনো পণ্য নেই।
গুজব
গত এক সপ্তাহে কোটাবিরোধী আন্দোলন ও কারফিউতে স্থবির ছিল গোটা দেশ। আন্দোলন ও সংঘর্ষে উত্তপ্ত ছিল রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল। এর মধ্যেই ছিল না ইন্টারনেট সংযোগ। যার ফলে কোথায় কী ঘটছে, তা সাধারণ মানুষের জানার বাইরে ছিল। এমন পরিস্থিতিতে সুযোগটি নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। খবরের পাশাপাশি ছড়িয়েছে নানা ধরনের গুজব। যা দিন দিন বেড়েই চলেছিল। এসবের ভিড়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ঘিরে দুটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে, যা ছিল উল্লেখযোগ্য।
স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজের আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তিন দিনের সফরে ২১ জুলাই মাদ্রিদ যাওয়ার কথা ছিল। অন্যদিকে ২৩ থেকে ২৫ জুলাই জি-২০-এর বিশেষ অধিবেশন ও দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় যোগ দিতে ব্রাজিল যাওয়ার কথা ছিল প্রধানমন্ত্রীর। ব্রাজিল সফরের আগে তিনি স্পেন যাবেন, এমনটিই ছিল সিদ্ধান্ত।
অথচ আন্দোলনের মধ্যেই গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পেনে পালিয়ে গেছেন; যা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শেখ হাসিনা কখনো পালায় না।’
অপরদিকে কোটাবিরোধী এই আন্দোলনের মধ্যেই গুজব ছড়িয়ে পড়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া মারা গেছেন। এই গুজবের পরিপ্রেক্ষিতে গত রবিবার (২১ জুলাই) বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, খালেদা জিয়াকে নিয়ে গুজব ছড়ানো হচ্ছে, তিনি ভালো আছেন।
এদিকে গুজব ছড়ানো হয় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হেলিকপ্টার থেকে গুলি করার। পরে র্যাব মহাপরিচালক নিশ্চিত করেন, বিষয়টি পুরো প্রপাগান্ডা (অপপ্রচার/গুজব)। আমরা জানতাম এ ধরনের গুজব রটানো হবে। তাই আমরা আগে থেকে ভিডিও করে রেখেছিলাম। আর আমাদের টিয়ার গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেডে কেউ আহত হয়নি। তিনি আরও বলেন, হেলিকপ্টারের মাধ্যমে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড মেরেছি। যেখানে তারা আগুন ধরিয়েছে আমরা দ্রুত সেই আগুন নেভানোর চেষ্টা করতে এই কাজ করেছি। যাতে ধ্বংস কমানো যায়, সেখানকার মানুষকে বাঁচানো যায়।
৯৯৯ ব্যর্থ
কোটা আন্দোলনে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী মূলত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। এ এলাকায় সংঘর্ষ আর সহিংসতা এতটাই চরম পর্যায়ে ছিল যে, কাউফিউ ঘোষণা করার পরও এখানে সংঘর্ষ চলতেই থাকে। শনিবার (২০ জুলাই) হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হন আসাদ মিয়া। তাকে হাসপাতালে নিতে কোনো যানবাহন না পেয়ে তার পরিবারের সদস্যরা জাতীয় পরিষেবা ৯৯৯-এ কল করেন। বারবার অনুরোধ করেন আসাদ মিয়াকে হাসপাতালে পৌঁছানোর জন্য কোনো যানবাহনের ব্যবস্থা করার। কিন্তু তাতে ফল মেলেনি।
মিরপুরের বাসিন্দা ওহাব আলী। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে হাসপাতালে নিতে তিনিও ৯৯৯-এর শরণাপন্ন হন। কিন্তু তিনিও সেখান থেকে সেবা পেতে ব্যর্থ হন। এ ছাড়া রাজধানীর পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের হাসিম অথবা উত্তরার সাধন চন্দ্র দাস, কেউই বারবার ফোন করেও বিপদে জাতীয় পরিষেবা থেকে কোনো সাহায্য পাননি।
লক্ষ্মীবাজারের বাসিন্দা ব্যাংকার হাসিম জানান, তার চাচা গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীতে মারা গেছেন। তিনি বারবার ফোন করে ঢাকার বাইরে যেতে সাহায্য চান ৯৯৯-এ। কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে তাকে বারবার আশ্বাস বাণী শোনানো ছাড়া আর কিছুই করা হয়নি।
৯৯৯-এ জাতীয় পরিষেবা থেকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মী জানিয়েছেন, কোটা আন্দোলনে সহিংসতা ও কারফিউতে নানা কারণে বিপদগ্রস্ত মানুষ ফোন করেছেন, কিন্তু পরিস্থিতির কারণে তারা কাউকেই আসলে সেবা দিতে পারেননি। আর অনেকে বারবার ফোন করেও সংযোগ না পাওয়ার অভিযোগ করেন।
পথে থাকা মানুষগুলো
কারফিউ পরিস্থিতিতে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্তের জীবনে আর্থিক সংকট এখন পর্যন্ত প্রকট না হলেও, যারা দিন আনে দিন খায় তাদের জীবনে দুরবস্থা নেমে এসেছে। সোমবার রাজধানীর গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম, ফার্মগেট, নিউমার্কেট, এলিফ্যান্ট রোড, মতিঝিল, নয়াপল্টন, মহাখালী, বনানী, গুলশানসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সড়কে বসবাস করা ছিন্নমূল মানুষগুলো যেন উধাও হয়ে গেছে। কী হলো তাদের? কোথায় গেল তারা? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্কসহ বিভিন্ন এলাকার ফাঁকা স্থানে গিয়ে স্থান নিয়েছেন তারা। তারা জানায়, মূল সড়কে আন্দোলনের সংঘর্ষ আর সহিংসতা। এরপর আবার কারফিউ। সড়কে কাউকেই থাকতে দিচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাই বাধ্য হয়ে তারা বিভিন্ন জায়গায় মাথা গোঁজার জন্য ঠাঁই নিয়েছেন। রহমান টিএসসিতে লেবুর শরবত বিক্রি করেন। রাতে ঘুমাতেন টিএসসির মূল ভবনের সামনের বারান্দায়। কিন্তু আন্দোলন আর কারফিউতে এখানে থাকতে দিচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে পাশের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে থাকছেন। এমন পরিস্থিতি আরও অনেকের। উদ্যানের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, সারি সারি পলিথিনের অস্থায়ী ঘর। সেসব ঘরের সামনে উদ্যান থেকে কুড়িয়ে নেওয়া পাতা আর ডালপালা দিয়ে রান্না বসিয়েছেন অনেকে। জানা গেছে, আয় নেই কারও। তাই যে যা পারছে তা-ই দিয়ে এক সঙ্গে অনেকে রান্নার আয়োজন করেছেন। একই চিত্র রাজাধানীর ওসমানী উদ্যানে। পার্কের উন্নয়নের জন্য বাইরে থেকে চারপাশ আটকে রাখা হলেও, ভিতরে শত শত মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। তারাও কারফিউর মধ্যে এখানে নিরাপদ বোধ করছেন।
প্রায় শতবর্ষী আছিয়া খাতুন। বসে ছিলেন উদ্যানের একটি গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে। কাছে গিয়ে কথা বলতেই, হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দেন। আন্দোলনের কারণে তার মেয়ের থেকে আলাদা হয়ে গেছেন তিনি। এখানে পরিচিত একজন নিয়ে এসেছেন, দুই দিন ধরে তাকে খাওয়াচ্ছেন। কিন্তু এরপর সব স্বাভাবিক হলে তিনি কোথায় যাবেন। আছিয়া খাতুনের চোখে জল, কথা থামিয়ে উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করছেন। কী বলছেন, তা শোনা না গেলেও অনুভব করা যায়। মনে বাজে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতার লাইন অ্যালেন গিন্সবার্গ লিখেছিলেন, ... আকাশে বসত মরা ঈশ্বর, নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে।
প্রিন্ট ও ভিজ্যুয়াল মিডিয়া
কোটা আন্দোলনে সহিংসতায় ডাটা সেন্টারে আগুন দেয় দুর্বৃত্তকারীরা। এই কারণে সারা দেশে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে যায়। এতে সব ধরনের ডিজিটাল সেবায় ধস নেমেছে। এতে দেশের মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনেও বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। মোটা অঙ্কের অর্থনৈতিক লোকসান গুনতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। আর দেশের অনলাইন মিডিয়া বন্ধ হয়ে যায়। ভিজ্যুয়াল মিডিয়ায় সরাসরি সম্প্রচার করাও বন্ধ হয়ে যায়। এতে করে খবর নিতে মানুষ আবারও প্রিন্ট মিডিয়ার ওপর ঝুঁকে পড়েন।
সকাল সাতটা। পুরান ঢাকা। কবি নজরুল সরকারি কলেজের গেট। পত্রিকা বিক্রেতা রফিকের অপেক্ষায় অনেক মানুষ। সাইকেল চালিয়ে রফিক আসতে না আসতেই তার সব পত্রিকা বিক্রি শেষ। রফিক বলেন, আমি প্রতিদিন এই এলাকায় দেড়শ পত্রিকা বিলি করি। কিন্তু আজকে আর বিলি করা যাবে না। কারণ আর কোনো পত্রিকা নেই।
একই চিত্র রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়। বিভিন্ন এলাকায় খবর নিয়ে জানা গেছে, প্রতিদিনের তুলনায় বেশি পত্রিকা এনেও তারা চাহিদা কুলাতে পারছেন না। গেন্ডারিয়ার পত্রিকা হকার সবুজ জানান, আমি তো পালিয়ে পালিয়ে বিভিন্ন বাসায় পত্রিকা বিলি করছি। কেউ দেখে ফেললেই তারা পত্রিকা কিনতে চায়। তবে এমন পরিস্থিতিতে কিছুটা হলেও খুশি সবুজ। অনেক আগে এমন পরিস্থিতি ছিল। দেশে বড় কিছু ঘটলে মানুষের মধ্যে পত্রিকা কেনার হিড়িক পড়ে যেত। পরে অনলাইন পত্রিকার বাজার রমরমা হওয়ার কারণে তারা প্রায় হারিয়ে যেতেই বসেছিলেন। তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন, আবারও ফিরে এসেছে আগের আমেজ।
গেন্ডারিয়ার ধূপখোলা মাঠের পাশে কথা হয় মজিবর সারোয়ারের সঙ্গে। তিনি একজন ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, আগে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকা না পড়লে মাথা ঠিক থাকত না। এবার কোটা আন্দোলনে সেই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সেই হিসেবে এবার দেশের ভিজ্যুয়াল মিডিয়া থেকে প্রিন্ট মিডিয়া অনেকখানি এগিয়ে।
নিত্যদিনের বিভিন্ন কাজ ব্যাহত
কয়েক কোটি মানুষের জীবিকা নির্ভর করছে মোবাইলভিত্তিক অর্থনৈতিক সুবিধার (এমএফএস) ওপর। গেল কয়েক দিন ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় তাদের হাত এখন কপর্দকশূন্য হয়ে পড়েছে।
প্রিপেইড গ্যাস ও বৈদ্যুতিক মিটারেও রিচার্জ করা সম্ভব হচ্ছে না। ঢাকা ও ঢাকার বাইরের শত শত গ্রাহক বিদ্যুৎহীন অন্ধকারে দিন কাটাচ্ছেন।