মানুষ ভজলেই সোনার মানুষ হবি

পুরান ঢাকার নবাবপুর রোডের হার্ডওয়্যারের দোকানগুলো ছাড়িয়ে একটি সরু গলি এঁকেবেঁকে এসে থেমেছে বহু পুরনো এক মন্দিরের দরজায়। নাম তার শ্রীশ্রী রাধাশ্যাম জিউ ঠাকুর বিগ্রহ মন্দির।

পুরনো স্যাঁতসেঁতে ভবনটির সামনের রাস্তার দুপাশে সারি দিয়ে বসা অনেক মানুষ। সবার সামনে রাখা থালা। সকলের পরনে শতছিন্ন আর মলিন পোশাক, মুখে অনাহারের রেখা পষ্ট। কিছুক্ষণ পরই মন্দিরের মূল ফটক খুলে গেল, তিনটি বড় লোহার বালতি হাতে তিনজন মানুষ বেরিয়ে এলেন। হাসি ফুটে উঠল বসে রাস্তার পাশে থাকা মানুষগুলোর মুখে। সারি দিয়ে বসা সবার পাতে একে একে পড়ল ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, পাঁচ রকমের সবজির তরকারি আর ডাল। খেয়ে উঠে গেল একদল। তাদের জায়গায় পাত পেড়ে বসলেন আরও একদর মানুষ। পুরান ঢাকার ১০৯ নম্বর নবাবপুর রোডের নিয়মিত দৃশ্য এটি। ৯২ বছর ধরে এভাবেই প্রতিদিন অনাহারীর মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে মদনমোহন অন্নছত্র ট্রাস্ট।

বিখ্যাত সংগীত শিল্পী ভূপেন হাজারিকা গেয়েছিলেন, মানুষ মানুষের জন্য...। চারিদিকের বিরাজমান পরিস্থিতিতে গানের কথাগুলো মানতে যখন অস্বস্তি হয়; তখন সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের শঙ্কার ভেতর হঠাৎ শঙ্খনাদের মতো আশ্বাস বাণী শোনায় মদনমোহন অন্নছত্র ট্রাস্ট। শঙ্খের মঙ্গল ধ্বনি আছড়ে পড়ে মনের ভূমিতে, দূর করে সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। শোনায় অভয় বাণী, মানুষ মানুষের জন্যে।

আজ থেকে ঠিক ১০০ বছর পূর্বে, ১৯২৪ সালে ঢাকায় খাদ্যাভাব দেখা দিল। প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের সরবরাহ কম, দামও আকাশছোঁয়া। প্রতিদিন না খেয়ে থাকছে বহু মানুষ। আর এই পরিস্থিতিতে ঠিক থাকতে পারেননি নবাবপুরের জমিদার মদনমোহন পাল ও তার তিন ছেলে-রজনীকান্ত পাল, মুরলীমোহন পাল আর প্রিয়নাথ পাল। তারা সমাজের নি¤œবিত্ত অনাহারী মানুষের মুখে অন্নের জোগান দিতে শুরু করেন। অনেক দিন চলে এমন। একটা সময়ে এসে জমিদার পরিবারটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, আর  কখনো বন্ধ হবে না এই খাবার বিতরণ। সৃষ্টি হলো মদনমোহন অন্নছত্র ট্রাস্টের। জনশ্রুতি আছে, মদনমোহন পালের নবাবপুরে শতাধিক বাড়ি ছিল। তিনি তার ভেতর থেকে নয়টি বাড়িকে এই ট্রাস্টের অধীন করে দিলেন, বাড়িগুলোর আয় থেকে চলবে এই ট্রাস্ট, প্রতিদিন শত শত নিরন্ন মানুষের ক্ষুধার অন্ন জোগাবে বাড়িগুলোর আয়।  

মদনমোহন পালের তিন ছেলে তাদের বাবার নামের এই অন্নছত্রের দায়িত্ব নেন। জানা গেছে, সে সময় প্রতিদিন দুপুরবেলা ১২৫ জনকে বিনামূল্যে খাওয়ানোর ভার নেন তারা। এরপর গত ১০০ বছর ধরে এ ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন তাদের উত্তরাধিকারীরা। বর্তমানে প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত প্রায় ৩০০ অনাহারী মানুষকে খাওয়ানো হয়। বর্তমান সময়ে নিঃসন্দেহে এটি বিরল এক দৃষ্টান্ত। 

ট্রাস্টের ব্যবস্থাপক পরিমল কৃষ্ণ ভট্টাচার্য জানান, এখানে ধর্ম-জাত-পাতের কোনো ভেদাভেদ নেই। ক্ষুধার্ত অবস্থায় যিনি আসবেন, তিনিই খেতে পাবেন। অন্নছত্রের একজন নিয়মিত অতিথি ষাটোর্ধ্ব ভিক্ষুক মালেক মিয়া। চোখে ঠিকমতো দেখেন না। বলেন, এখানকার খাবার বেশ ভালো। তাই দুপুরের খাবার নিয়মিত এখানেই খান। যে বাবুর নামে অন্নছত্র, তার জন্য প্রাণ ভইরা দোয়া করি। শুধু দরিদ্ররাই নন, মোটামুটি আয়ের অনেকেও এখানে নিয়মিত খাবার খেয়ে থাকেন। নবাবপুরে বিভিন্ন দোকানে যন্ত্রাংশের সরবরাহকারী অসীম দাশ দুপুরের খাবার এখান থেকেই টিফিন বাটিতে করে নিয়ে যান। অসীমের পরিবার চট্টগ্রামে থাকে। তাই রেঁধে খাওয়ানোর লোক নেই। তিনি বললেন, এখানে খেয়েই তো প্রাণে বেঁচে আছি। 

মন্দিরের পাচক স্বপন চক্রবর্তী জানান, প্রতিদিন ৩৫-৪০ কেজি চাল, ১ মণ সবজি আর ৫ কেজি ডাল রান্না হয়। ট্রাস্টের শুরু থেকে এই তিনটি পদই রান্না হয়ে আসছে। আর এখানে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রকম খাবার রান্না হয়। যেমন পায়েস, সেমাই, পোলাও ইত্যাদি।

মদনমোহন পাল অন্নছত্র ট্রাস্টের বর্তমান প্রধান নির্বাহী দীপক কুমার পাল। সহকারী নির্বাহী তপন কুমার পাল। আর নির্বাহী সদস্য হিসেবে আছেন মিন্টু রঞ্জন পাল। মদনমোহনের বংশধর তারা। উইল অনুসারে বংশধররাই ট্রাস্টের দায়িত্ব নেবেন। তবে বংশের যদি কেউ না থাকে, ঢাকার জেলা প্রশাসক তখন ট্রাস্টের প্রধান হবেন।

ট্রাস্টের প্রধান নির্বাহী দীপক কুমার পাল জানান, মাসের দুই একাদশী (চাঁদের একাদশ দিন) আর জন্মাষ্টমী বাদে সারা বছর বেলা সাড়ে ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত এখানে খাবার বিতরণ করা হয়। বছরে ২৪ দিন ছাড়া বাকি সব দিনেই প্রসাদের ব্যবস্থা করা হয়। জামাই ষষ্ঠী, পূজা, পহেলা বৈশাখেও খাবারের বিশেষ আয়োজন থাকে। বর্তমানে এই ট্রাস্টের কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন ১২ জন। তার মধ্যে দুজন রান্না এবং পূজার কাজ করেন। তবে নির্ধারিত সময়ের পর কেউ এলে তাকেও ফেরানো হয় না। ট্রাস্টের উইলে খুব স্পষ্ট করে বলা আছে, অভুক্ত কোনো অতিথিকে যেন ফেরানো না হয়।

দীপক কুমার পাল বলেন, আমরা কাউকে অভুক্ত ফেরাই না। অনেকে নির্ধারিত সময়ের পর আসেন। ট্রাস্টের সেবকদের জন্য বরাদ্দ করা খাবার থেকে তাকেও খাবার দেওয়া হয়। পরে সেবকরা রেঁধে খান। আর এখানে ধনী গরিব কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও সবাই একই খাবার খান।

অন্নছত্রের একজন সেবক সুখরঞ্জন পাল (৬৫)। তার বাবাও এখানে কাজ করতেন। বয়স হয়েছে বলে এখন ছেলেকেও নিয়ে এসেছেন তাকে সাহায্য করার জন্য। তবু তিনি প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থেকে খাবার বিতরণের তদারক করেন। বললেন, মানুষের সেবাই তো বড় ধর্ম। যে যে ধর্মেরই হোক, তাদের সেবা করে মরতে পারলে জীবন ধন্য।

সুখরঞ্জনের কথায় মনে পড়ে মহাত্মা লালন ফকিরের গান ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি...’। মদনমোহন পাল আর তার ছেলে হয়তো ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন, মানুষের মাহাত্ম্য। হানাহানি আর হিংসার রাজত্বে জ্বলতে পুড়তে থাকা আমরা কবে গেয়ে উঠতে পারব, বড়ু চণ্ডীদাসের কীর্তনের সুর, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’



সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //