
হরিপদ কাপালী। ছবি: সংগৃহীত
হাজার বছর ধরে বাঙালি কৃষকের যে রুগ্ন চেহারা ইতিহাসের পাতায় দেখতে পাওয়া যায়, হরিপদ কাপালী সেই চিরাচরিত রূপেরই অধিকারী ছিলেন। দিনের পর দিন হাড়ভাঙা খাটুনির স্পষ্ট ছাপ শরীরজুড়ে; তবু মুখমণ্ডলে নেই রুক্ষতার লেশ, বরং সারল্যময় ভুবন ভোলানো একচিলতে হাসি লেগে আছে-হেমন্তের বিকেলে আউশের ক্ষেতে পড়ন্ত সূর্যের আলোর মতো। আমৃত্যু মাটির কাছাকাছি থাকা এই অন্ন উৎপাদক ছিলেন নিরক্ষর, কিন্তু তার আবিষ্কৃত ধানের জাতটি ‘হরিধান’ নামে ঠাঁই করে নিয়েছে স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে।
গত শতাব্দীর শেষের দিকে উচ্চ ফলনশীল বীজ, সার উদ্ভাবন এবং সেচ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে ধান, গম, ভুট্টা প্রভৃতির উৎপাদন পৃথিবীব্যাপী দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ইউএসএইডের পরিচালক উইলিয়াম এস. গাউড দ্রুত ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির এ জয়জয়কারকে ‘সবুজ বিপ্লব’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এ সময় আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্র জলাবদ্ধতা ও খরা সহিষ্ণু উচ্চফলনশীল ধানের বিভিন্ন জাত আবিষ্কার করতে থাকে। ফলে শত শত বছর ধরে প্রকৃতির সান্নিধ্যে থেকে এ দেশের কৃষকেরা যে ধানের জাতগুলো উদ্ভাবন করেছিলেন তা বিলুপ্ত হতে থাকে।
প্রতিটি নতুন জাতের ধানের গায়ে আবিষ্কারের কৃতিত্ব লাগতে থাকে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্র ও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের। ঠিক এমন সময় নতুন এক ধানের জাত হাতে আলোচনায় উঠে এলেন ঝিনাইদহের কৃষক হরিপদ কাপালী। এ কৃষকের গল্পটা বেশ চমক জাগানো। ১৯৯৪ সালে হঠাৎ নামহীন এক ধানের জাত ঝিনাইদহ ও পার্শ্ববর্তী বেশ কয়েকটি জেলায় ব্যাপকহারে চাষ হতে থাকে। প্রচলিত অন্য জাতগুলোর তুলনায় অধিক ফলন পেতে থাকে চাষিরা, তাই জনপ্রিয়তাও তুঙ্গে। ১৯৯৫ সালে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার বরাতে দেশের মানুষ জানতে পারে, এ জাতের আবিষ্কারক কৃষক হরিপদ কাপালীর নাম।
হরিধানের জন্ম যেভাবে
১৯৯১ সালের কোনো একদিন নিজের ইরি ধানক্ষেতে একটি হৃষ্টপুষ্ট ধান গাছ দেখতে পান হরিপদ কাপালী, যেটির ছড়ায় ক্ষেতের অন্যান্য গাছ থেকে অনেক বেশি ধান ছিল। তিনি ধান গাছটিকে আলাদা করে রাখেন, এবং ১৯৯২ সালে সে গাছ থেকে পাওয়া বীজ দিয়ে আবাদ করেন। ফলনের পর দেখলেন মোট জমিতে বিআর-১১ ধানের চেয়ে নতুন বীজ থেকে পাওয়া ধানের ফলন গড়ে বেশি। পরের বার জমিতে শুধু নতুন ধানের চাষই করেন। তখন বিঘাপ্রতি বিআর-১১-এর ফলন ছিল ১৮ থেকে সর্বোচ্চ ২০ মণ। কিন্তু হরিপদ কাপালীর নতুন ধান ২২ মণ ছাড়িয়ে গেল। এ ফলনের জন্য সারের প্রয়োগও বেশি করতে হয়নি।
ধীরে ধীরে আবাদ বাড়ার ফলে এ ধানের অধিক ফলনের বিষয়টি এলাকার অনেক কৃষকের নজরে আসে। তারা হরিপদ কাপালীর কাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করে ইরি ও বোরো মৌসুমে আবাদ করেন। এরপর ছড়িয়ে যাওয়ার শুরু। কোনো নাম না থাকায় ধান চেনার সুবিধার্থে অন্য কৃষকরা এই ধানের নাম দেন ‘হরিধান’।
খরা, অতিবৃষ্টি ও পোকামাকড়ের আক্রমণ সহিষ্ণু এই জাতের ধান আবাদে কৃষকদের আগ্রহ দেখে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে হরিধান চাষ করার ছাড়পত্র দেয়। ‘হরিধান’ আবিষ্কারের জন্য হরিপদ কাপালীকে দেশের বিভিন্ন কৃষি সংগঠন সম্মাননা ও পুরষ্কারে ভূষিত করে। নবম-দশম শ্রেণির কৃষি শিক্ষা বইতে হরিপদ কাপালীর কথা অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
হরিধানের বিষয়ে কৃষিতথ্য বিশ্লেষক রেজাউল করিম সিদ্দিক জানালেন, আমাদের দেশে ধানের আদি জাতগুলো সে অর্থে আর নেই বলা যায়। কেউ কেউ হয়তো টিকিয়ে রেখেছেন, তবে তা বৃহৎভাবে টিকে নেই। বিষয়টি হলো মিশ্রণ। ক্ষেতের কোনো কোনো ধান গাছ একটু বড় ছোট হয়, কোনোটির শিষে বেশি ধান আসে, কোনোটির কম আসে। হরিপদ কাপালী ক্রিয়েটিভ কৃষক, তিনি বেছে বেছে বড় গাছ, বেশি ধান আছে এরকম কিছু গাছকে বাছাই করলেন। এরপর চাষ করতে করতে এটাকে একটা জাত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করলেন, এবং এটাকেই হরিধান বলে।
রেজাউল করিম সিদ্দিক আরও জানালেন, ‘ধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য চার-পাঁচ বছর পর পর পরিবর্তিত হয়। তখন নতুন বীজ কিনে চাষ করার প্রয়োজন পড়ে। হরিপদ কাপালী তার উদ্ভাবিত জাতটির বীজ উৎপাদনের জন্য কোনো সাপোর্ট পাননি, ফলে একটা পর্যায় পর্যন্ত তার জাতটি ছিল, এরপর এটি হারিয়ে গেছে। এখনো হয়তো কেউ বিচ্ছিন্নভাবে চাষ করে, তবে আগের মতো সেই পটেনশিয়ালিটি পাওয়া যায় না।’
হরিপদ কাপালী ১৯২২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ঝিনাইদহ সদর উপজেলার এনায়েতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবেই পিতামাতাকে হারান তিনি। এরপর বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন। পরে আসাননগর গ্রামে সুনীতি বিশ্বাসকে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতে স্থায়ী হন। সেখানেই ২০১৭ সালের ৬ জুলাই বার্ধ্যক্যজনিত কারণে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।