জগৎজ্যোতি দাস

ছাত্ররাজনৈতিক কর্মী থেকে হাওরাঞ্চলের দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা

শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মিছিল, টিয়ারশেল আর গুলির শব্দ ভেসে আসছে না। লাল-সবুজ পতাকা মাথায় বেঁধে সংগ্রাম মুখর বৃষ্টিস্নাত দিনে রাজপথে হেঁটে বেড়ানো অগণিত দুরন্ত তরুণ-তরুণীর বিজয়ের উৎসবও থেমে গেছে। নতুন দায়িত্ব নিয়ে তারা এখনো পথেই আছে।

সারা শহর পরিচ্ছন্ন করা এবং রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিয়েছে তারা। যুদ্ধের পর যেন দেশ পুনর্গঠন হচ্ছে। এমন দিনে মনে পড়ে যায় সিলেটের দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জগৎজ্যোতি দাসের কথা। বিজয়ের দিনটি তিনি দেখে যেতে পারেননি, একটা মুক্ত দেশ উপহার দিতে প্রাণপণে লড়াই করতে করতে শহীদ হন। 

 ১৬ নভেম্বর ১৯৭১, ভোরের আবছা আলোয় গোপন আশ্রয় থেকে বেরিয়ে এলেন দাস পার্টির প্রধান জগৎজ্যোতি। সঙ্গী  ৪২ জন সহযোদ্ধা। তখন অগ্রহায়ণ মাস, শীতের বার্তা নিয়ে কুয়াশা এসে চারপাশ ঢেকে দিয়েছে। মেঠোপথের ঘাসের ওপর কুয়াশা চাদর বিছিয়ে দিয়েছে, তাতে দাস পার্টি সুশৃঙ্খলভাবে হেঁটে যায় নিঃশব্দে। লক্ষ্য বানিয়াচংয়ের বাহুবল। পথিমধ্যে বদলপুর পৌঁছে তারা দেখতে পান, কয়েকজন রাজাকার ব্যবসায়ীদের নৌকা থামিয়ে চাঁদা আদায় করছে, সে দৃশ্য দেখে দাস পার্টির কমান্ডার জগৎজ্যোতি দাস ওই রাজাকারদের ধরে আনার নির্দেশ দেন। অবস্থা বুঝতে পেরে রাজাকাররা পালাতে থাকে। তাদের পালাতে দেখে জগৎজ্যোতি দাস ও তার বাহিনী রাজাকারদের তাড়া করতে শুরু করেন। এতক্ষণ যা ঘটল তা ছিল একটা ফাঁদ। দাস পার্টির গতিবিধি সম্পর্কে পাকিস্তানি বাহিনী আগেই জেনে গিয়েছিল। তারা বদলপুর থেকে কিছুটা দূরে ফাঁদ পেতে অপেক্ষা করছিল। রাজাকারদের তাড়া করতে করতে একসময় জগৎজ্যোতি দাস বুঝতে পারেন তারা হানাদারদের তৈরি চক্রব্যূহে ঢুকে পড়েছেন। হানাদারদের বিশাল বহর চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছে তাদের। দমে যাননি জগৎজ্যোতি। যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন সহযোদ্ধাদের। কিন্তু একটা সময় তিনি বুঝতে পারলেন এভাবে সম্ভব নয়। এমন হলে সবাই শহীদ হবেন। তখন জগৎজ্যোতি সহযোদ্ধাদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দেন, তাদের নিরাপদে সরে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে সহযোদ্ধা ইলিয়াসকে সঙ্গী করে একটানা গুলি চালিয়ে যান। হঠাৎ একটি গুলি এসে লাগে সহযোদ্ধা ইলিয়াসের পাঁজরে। জগৎজ্যোতির নিজের মাথা থেকে গামছা খুলে ইলিয়াসের পাঁজর বেঁধে দেন। বাঁধতে বাঁধতে জগৎজ্যোতি দাস বলেছিলেন, বাঁচবি? ইলিয়াস উত্তর দিয়েছিল, ‘বাঁচতে পারি।’ তখন জগৎজ্যোতি বলেছিলেন, ‘তাহলে যুদ্ধ কর।’ এ সময় জগৎজ্যোতিকে সরে যাওয়ার অনুরোধ করেন ইলিয়াস কিন্তু জগৎজ্যোতি যাননি। যুদ্ধ চালিয়ে যান। তাদের সঙ্গে গুলিবিনিময়ে ততক্ষণে ১২ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়েছে। 

বিকেল ঘনিয়ে এসেছে, গুলিও শেষের পথে। ম্যাগাজিন লোড করে শত্রুর অবস্থান দেখতে মাথা উঁচু করতেই একটি গুলি এসে বিদ্ধ হয় জগৎজ্যোতির চোখে। পড়ে যান জগৎজ্যোতি দাস। মৃত্যুর পূর্বে সহযোদ্ধা ইলিয়াসকে বললেন, ‘আমি যাইগ্যা।’ জগৎজ্যোতি শহীদ হলে ইলিয়াস পিছু হটে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী রাজাকার সদস্যরা রাতে জগৎজ্যোতির লাশ খুঁজে পেয়ে পাকবাহিনীকে খবর দেয় এবং জ্যোতির মৃতদেহটি আজমিরীগঞ্জ বাজারে নিয়ে যায়। রাজাকাররা জ্যোতির হত্যার ঘটনা ছড়িয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য তার মৃতদেহকে আজমিরীগঞ্জ গরুর হাটে একটি খুঁটির সঙ্গে বেঁধে পেরেক মেরে রাখে। তারপর এক সময় জগৎজ্যোতির দেহ ভাসিয়ে দেওয়া হয় কুশিয়ারা নদীতে।

জগৎজ্যোতি দাস জন্মেছিলেন বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ উপজেলার জলসুখা গ্রামে, ২৬ এপ্রিল ১৯৪৯ সালে। বাবা-মায়ের কনিষ্ঠ সন্তান তিনি। স্কুল জীবনেই জগৎজ্যোতি আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৬৮ সালে ম্যাট্রিক পাস করার পর সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে ভর্তি হয়ে ছাত্র ইউনিয়নে (মেনন গ্রুপ) যোগ দিয়ে ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৬৯ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, তারপর সংগঠনের বিশেষ দায়িত্ব পালনে ভারতের গৌহাটির নওপং কলেজে ভর্তি হন। সেখানে অবস্থানকালে নকশালবাড়ী আন্দোলনে যারা সরাসরি যুক্ত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং অস্ত্র গোলাবারুদ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নিয়ে আবার দেশে ফিরে আসেন। 

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারতের মেঘালয়ের ইকো-১ প্রশিক্ষণ শিবিরে অংশগ্রহণ করেন জগৎজ্যোতি দাস। গৌহাটির নওপং কলেজে পড়া অবস্থায় নকশালপন্থিদের সঙ্গে জড়িত হওয়ার ফলে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সম্পর্কে তার যে পূর্ব ধারণা ছিল সেটি তাকে এগিয়ে রাখে। প্রশিক্ষণ শেষে গণযোদ্ধাদের নিয়ে জগৎজ্যোতি দাস গড়ে তোলেন ‘দাস পার্টি’ নামের  দুর্ধর্ষ গণবাহিনী। ইংরেজি, হিন্দি ও গৌহাটির আঞ্চলিক ভাষা জানতেন জগৎজ্যোতি দাস, এর ফলে ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ গড়ে ওঠে। এর ফলে ভারতীয় বাহিনী থেকেও বহু অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করতে সমর্থ হন জগৎজ্যোতি দাস।

তারপর সুনামগঞ্জ-কিশোরগঞ্জ-নেত্রকোনা ও হবিগঞ্জের হাওর অঞ্চলে একের পর এক অপারেশন চালাতে শুরু করে জগৎজ্যোতি দাসের নেতৃত্বাধীন দাস পার্টির মুক্তিযোদ্ধারা। টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের অধীনে বিস্তীর্ণ ভাটি অঞ্চল শত্রুমুক্ত রাখার দায়িত্ব পড়েছিল জগৎজ্যোতি দাসের ওপর। সুনামগঞ্জের দিরাই, শাল্লা, ছাতক, আজমিরীগঞ্জ, বানিয়াচং, জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার নৌপথ হানাদার দখলমুক্ত রাখার জন্য অসংখ্য অপারেশন চালিয়েছিলেন দাস পার্টির মুক্তিযোদ্ধারা। এতে দাস পার্টি হয়ে উঠল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে আতঙ্কের নাম। একসময় বাধ্য হয়ে হানাদার বাহিনী রেডিওতে ঘোষণা দেয়, “এই পথে চলাচলকারী ব্যক্তিদের জানমালের দায়িত্ব সরকার নেবে না।” দাস পার্টির অন্যতম সফল ও বড় অপারেশন ছিল ২৯ জুলাইয়ের জামালগঞ্জ অপারেশন। এ যুদ্ধে অসামান্য ভূমিকা রেখেছিলেন জগৎজ্যোতি দাস। 

জামালগঞ্জ থানা ও নৌ-বন্দর সাচনাবাজারকে হানাদারদের হাত থেকে শত্রুমুক্ত করার জন্য জামালগঞ্জে আক্রমণ করা সিদ্ধান্ত নেন ৫ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মীর শওকত আলী। সে অনুযায়ী ২৯ জুলাই অপারেশনের দিন ধার্য করে রেকি করা হয়। প্রায় ১৪০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে তিনটি দলে বিভক্ত করে ৬টি নৌকায় অপারেশনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন জগৎজ্যোতি দাসসহ মুক্তিযোদ্ধারা। রাত ১২টায় নির্দিষ্ট স্থানে সমবেত হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা অতর্কিত আক্রমণ চালান হানাদার বাহিনীর ওপর। এ সময় হানাদার সেনারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। তাদের ধারণাই ছিল না জগৎজ্যোতি দাস ও তার দল এমন আক্রমণ চালাতে পারে। একপর্যায়ে হানাদাররা ঘুরে দাঁড়ায়, কিন্তু জগৎজ্যোতি দাসের রণ কৌশলের কাছে হেরে যায়। শেষরাতের দিকে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। 

স্বাধীনতার পর জগৎজ্যোতি দাসকে বীর বিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। কিন্তু অনেকেই সে সময় তার বীরত্বের জন্য সর্বোচ্চ খেতাব আশা করেছিলেন। 

জগৎজ্যোতি দাস মুক্তিযোদ্ধা ছাড়াও ছিলেন একজন ছাত্ররাজনৈতিক কর্মী, তার আত্মত্যাগ ও বীরত্বের জন্য সর্বোচ্চ খেতাব তিনি পাননি। জগৎজ্যোতি দাস ও অগণিত ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা পথ দেখিয়েছেন ১৯৭১-এ। দেশের সাধারণ মানুষ সে পথে মিশে যায় পদ্মা, মেঘনার স্রোতের মতো। তাদের দেখানো পথেই হেঁটে গেছে ছাত্র আর সাধারণ মানুষ ২০২৪ সালে। এমন একটি সময় হয়তো খুব দ্রুতই আসবে, যখন জগৎজ্যোতি দাস ও দাস পার্টির মতো মুক্তিযোদ্ধা এবং দলগুলোর আত্মত্যাগ, বীরত্বের গৌরবগাথা চর্চিত হবে নতুনভাবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //