-66cdb2cc6c14d.jpg)
বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন পাকিস্তান আর ভারতেও আছড়ে পড়েছে। ছবি: সংগৃহীত
শিল্প ও শিল্পীর কোনো সীমানা নেই, ধর্ম নেই। তেমনি মানুষের সংগ্রামেরও কোনো সীমানা নেই। সুন্দরের জন্য লড়াই সব বাধা ডিঙিয়ে চলে যায় এক ভূখণ্ড থেকে অন্য ভূখণ্ডে। এক নাগরিক থেকে আরেক নাগরিকের চেতনায়। এমন উদাহরণ বিশ্ব জুড়ে অনেক। রেনেসাঁ, শিল্প বিপ্লব, রুশ বিপ্লব, ইরানের বিপ্লব অথবা আরব বসন্ত, যা-ই বলি না কেন, প্রতিটি বিপ্লব, আন্দোলন একটি থেকে আরেকটি অনুপ্রেরণা নিয়েছে, এমন অবস্থা সম্প্রতিক সময়ে আবারও দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থানে ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকা শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। সারা দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে এই আন্দোলনে অভূতপূর্ব উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। ফলে এর ঢেউ কাঁটাতারের সীমানা পেরিয়ে পাকিস্তান আর ভারতেও আছড়ে পড়েছে। এই দুই দেশের মানুষের অধিকারের প্রশ্নে বাংলাদেশের আন্দোলন মশালের মতো আলোকপ্রভা ছড়াচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে উত্তাল পাকিস্তান। দেশটির সংবাদমাধ্যম ডন বলেছে, স্পষ্টতই শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটানো বাংলাদেশি ছাত্রদের আন্দোলনে প্রভাবিত হয়ে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) ছাত্র শাখা ইনসাফ স্টুডেন্ট ফেডারেশন (আইএসএফ) বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে। পাকিস্তানে এখন ‘ফ্যাসিবাদী শাসন’ চলছে। অত্যধিক বিদ্যুৎ বিল, কর, মুদ্রাস্ফীতির চাপে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে মানুষ। সঙ্গে সীমাহীন দুর্নীতি। দেশকে সংকট থেকে উদ্ধারের জন্য একটি ছাত্র আন্দোলন শুরু করতে যাচ্ছেন তারা।
সংবিধান ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং আগামী ৩০ আগস্টের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মুক্তির দাবিতে সরকার পতনের আলটিমেটাম দিয়েছে পাকিস্তান স্টুডেন্ট ফেডারেশন (পিএসএফ)। ৩০ আগস্টের মধ্যে দাবি পূরণ না হলে গণ-অভ্যুত্থানের জন্য সারা পাকিস্তানে বিক্ষোভ শুরুর ডাক দিয়েছে তারা।
এদিকে এমন পরিস্থিতিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের লাঠিপেটা আর টিয়ারশেলের সঙ্গে পাকিস্তান জুড়ে ইন্টারনেটের গতি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে নেট ব্যবহারে বিঘ্নের মুখে পড়েছেন ব্যবহারকারীরা। কোথাও ইন্টারনেট বন্ধও করা হয়েছে। কোথাও গতি অনেক কম। বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলছেন না পাকিস্তান টেলিকমিউনিকেশন অথরিটি (পিটিএ)। ঠিক একই কায়দায় ছাত্র আন্দোলনের সময়টিতে বাংলাদেশে কখনো ইন্টারনেট বন্ধ, কখনো আবার গতি কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মনে করা হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা সরকারের কৌশল পাকিস্তান গ্রহণ করেছে।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, এর মাধ্যমে সরকার শুধু যোগাযোগেই ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে না, মৌলিক অধিকারও লঙ্ঘন করছে। কথাগুলো কেমন পরিচিত মনে হচ্ছে। চেনা জানা আর নিজের অনুভূতি মেশানো যেন! সত্যিই তাই। বাংলাদেশের আদলেই মূলত এই আন্দোলনের সূত্রপাত। এ আন্দোলনের স্লোগান আর ব্যানারে যেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাদৃশ্য রয়েছে। পাকিস্তানের সড়কে গাওয়া হচ্ছে, ‘আমায় ভাসাইলিরে আমায় ডুবাইলিরে’, স্লোগান দিচ্ছে, ‘তুমি কে আমি কে...’, ‘ইনসাফ চাইয়ে, বাংলাদেশের মতো ইনসাফ চাই’, ‘ত্যারা মেরা রিসতা ক্যায়া, ইনসাফ ইনসাফ...’, আবু সাঈদ ম্যারা ভাই হ্যায়...’ এমন স্লোগানে মুখর করেছে দেশটির মানুষদের হৃদয়।
দেশটির সংবাদমাধ্যমের বরাতে জানা গেছে, বাংলাদেশের মতো ব্যাপক না হলেও করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদের দেয়ালে গ্রাফিতি আঁকছে আন্দোলনকারীরা। তাদের দেয়ালেও স্থান পেয়েছে আমাদের আবু সাঈদ। যার আত্মত্যাগ কাঁটাতার পেরিয়ে, ভাষার বাধা ডিঙিয়ে স্থান করে নিয়েছে ওই দেশটির আন্দোলনে।
পাকিস্তানে আন্দোলনকারীরা বলছে, বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে, নতুন পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য। লাহোরের কলেজছাত্র ইসমাইল দারা জানান, বিগত বছরগুলোতে আমরা সামরিক শাসন আর অগণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে দাসের মতো বসবাস করছি। কিন্তু আর নয়, আমরাও বাংলাদেশের মতো উঠে দাঁড়াতে চাই।
করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও আন্দোলনের নেতা সরফরাজ জানান, পাকিস্তানে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলোকে দাবিয়ে রাখা হয়েছে। আমরা এই দেয়াল ভাঙতে চাই। জয় আমাদের হবেই। সরফরাজের এই কথার সুর মিলে যায় পাকিস্তানের চিরশত্রু বলে বিবেচিত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সোনালী ধরের কথায়, গানে। কলকাতার রাস্তায় সোনালী গাইছিল কবীর সুমনের গান, ‘আমি চাই কাশ্মীরে আর শুনবে না কেউ গুলির শব্দ/আমি চাই মানুষের হাতে রাজনীতি হবে ভীষণ জব্দ...’
সোনালী জানান, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মৌমিতা নামের এক চিকিৎসককে ধর্ষণের পর হত্যাকে ঘিরে ভারতজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। ৩১ বছর বয়সী ওই তরুণীর দেহের ময়নাতদন্তের পর চরম বিকৃত যৌনাচারের প্রমাণ মিলেছে।
পশ্চিমবঙ্গের সংবাদপত্রের বরাতে জানা গেছে, ধর্ষণের শিকার ওই নারী শিক্ষার্থীকে তার সহকর্মীরা মিলে গণধর্ষণ করেছে। এই ঘটনার প্রতিবাদে কলকাতার এক যুবতী, রিমঝিম সিনহা সমাজমাধ্যমে প্রথম পোস্ট করেছিলেন, ‘আরজি কর হাসপাতালে চিকিৎসককে ধর্ষণ এবং খুনের প্রতিবাদে মেয়েরা, রাত দখল করো।’ প্রথমে এই কর্মসূচি কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় হওয়ার কথা থাকলেও ক্রমশ তা ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভারতে। কলকাতার রাস্তা হয় জনসমুদ্র। আর প্রতিবাদে শামিল হন হায়দরাবাদ, মুম্বাই, দিল্লিসহ বিভিন্ন শহরের নাগরিকরা। তারা পালন করেন কর্মসূচি ‘কমপ্লিট শাটডাউন’। শুধু তাই নয়, দেশের সীমানা পেরিয়ে এই আন্দোলনে সমর্থন জানাতে দেখা যায় বিদেশে বসবাসকারী বাঙালিদেরও।
এই ঘটনাটাও কেমন যেন মিলে যাচ্ছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে। সেই ফেসবুকে পোস্ট, কর্মসূচি ঘোষণা, তারপর তাতে সারা দেশের মানুষের সাড়া। হ্যাঁ মিল আছে। আরও আছে, স্লোগানে আর দেয়াল লিখনে, আছে গানে, কবিতায়, আর প্রতিবাদে মুখর সড়কে দাঁড়ানো প্রদীপ, সুভাষ, রিমঝিম, অপর্ণাদের শরীরের চকচকে ঘামে। বুকের ভেতরে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের সঙ্গে আগুনের।
‘মেয়েরা রাত দখল করো’এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল যুক্তরাজ্যের লিডসে, নারী স্বাধীনতা নিয়ে আন্দোলনের অংশ হিসেবে। ১৯৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল জার্মানিতে যে ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতা হয় তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি শহরে বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। এর অংশ হিসেবে ১৯৭৭ সালে ব্রিটেনে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে দেশটির পুলিশের পরামর্শ ছিল, মেয়েরা যেন রাতে বাড়ি থেকে বাইরে না বেরোয়। তারই প্রতিবাদে শুরু হয়েছিল মেয়েদের রাত দখলের আন্দোলন। আমেরিকাতেও গত শতকের সাতের দশকে একটি নারীপন্থি সংগঠন এই আন্দোলনের ডাক দেয়।
পশ্চিমবঙ্গে স্লোগান উঠেছে, ‘বাংলাদেশে হলো যা, পশ্চিমবঙ্গে হবে তা’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, নেই কোনো সীমানা’ ইত্যাদি। আর গ্রাফিতির কথা বলতে গেলে বাংলাদেশের আবু সাঈদের গ্রাফিতির চিত্রটি প্রথম পশ্চিমবঙ্গেই আঁকা হয়েছিল। আর যা মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের আনাচেকানাচে। এখন দেখার পালা ভারত আর পাকিস্তানের এই আন্দোলন বাংলাদেশের পরিণতির দিকে যায় কিনা।