আমায় ভাসাইলি কে

শুকনো মাটির খোঁজে কোমর পানি ভেঙে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দিকে যাচ্ছিলেন আনোয়ার। মাথায় একটি খাঁচায় কিছু মুরগি বয়ে আনছেন তিনি। সেখানে কয়েকজন সংবাদকর্মী দেখে ‘আমার নতুন ঘর ভেঙ্গে সব শেষ, কিছু নেই আর... ঘরের পিঠ ভাইঙ্গা গেছে, থাকার মতো কিছু নাই’-এ কথা বলে কেঁদে ফেললেন আনোয়ার। তার এই ভোগান্তি ও কষ্টের চিত্র দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি মানুষের। 

বাংলাদেশের ফেনী, কুমিল্লা ও নোয়াখালী শুধু নয়, এর আশপাশের ৫ জেলাসহ মোট ১২ জেলায় বন্যা আগ্রাসী রূপ নিয়েছে। 

আকস্মিক এই বন্যায় মুহূর্তেই পানিবন্দি হয়ে পড়ে কয়েক লাখ মানুষ, ডুবে যায় একতলা সমান কাঁচা-পাকা বাড়ি। কোনো পরিবার ঘরের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরানোরও সুযোগ পায়নি। তাদের কাছে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানোও হয়ে পড়ে দুরূহ। খোয়াই নদের কথাই ধরা যাক। এখানে অন্তত ৬০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ পানি প্রবাহ দেখা গেছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে মনু নদ ইতিহাসের সর্বোচ্চ স্তরে প্রবাহিত হয়েছে। 

এই যে সর্বনাশা বন্যায় মানুষের অসহনীয় দুর্দশা, এর ‘মূল কারণ’ যদি জানতে চাওয়া হয়, তা হলে সুনির্দিষ্ট একটি নাম বলা কঠিন হয়ে পড়বে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত বাঁধ খুলে দেওয়ায় উজান থেকে নেমে আসা পানি বাংলাদেশের ফেনী, কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলকে ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এটা যেমন সত্য; একই সঙ্গে বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে ভারী বৃষ্টিপাত, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের যৌথ নদী কমিশনের নিষ্ক্রিয়তা, অসতর্কতা ও সার্বিক অব্যবস্থাপনাও দায়ী। গত ১৮ আগস্টের আগে ত্রিপুরা ও মিজোরামে অতি বৃষ্টিপাত ও বন্যার খবর গণমাধ্যমে এলেও বাংলাদেশে এ নিয়ে খুব বেশি সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। তবে ফেনী ও কুমিল্লা অঞ্চলে পানি ঢুকতে শুরু করলে বেশ সরব হয় ইন্টারনেট-ভিত্তিক সামাজিক মাধ্যমগুলো। নেটিজেনরা কোনো আগাম সতর্কতা বার্তা ছাড়া ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ডুম্বুর বাঁধ খুলে দেয়াকে এই ভয়াবহ বন্যায় মানুষের চরম ভোগান্তির কারণ হিসেবে দুষছেন। 

যৌথ নদী কমিশন বলছে, গত বছরের আগস্টে বন্যার পূর্বাভাসের ব্যাপারে ভারতের কাছ থেকে তিন ধরনের তথ্য চেয়েছিল বাংলাদেশ। ভারতের কাছে জানতে চাওয়া হয়-প্রথমত অভিন্ন নদীগুলোর উজানে কী পরিমাণে বৃষ্টি হচ্ছে। সেই পানি কত গতিতে নিচের দিকে নেমে আসছে। দ্বিতীয়ত আগামী তিন দিনে বৃষ্টির পরিমাণ ও পানি বৃদ্ধির গতি কেমন হতে পারে। তৃতীয়ত বাংলাদেশের উজানে ভারতীয় অংশের নদীগুলোয় যে ৬০টি বাঁধ রয়েছে, তা কোন সময়ে খুলে দেওয়া হবে এবং সেখান থেকে কী পরিমাণে পানি ভাটির দিকে আসতে পারে।

ওই সময় ভারত শুধু অভিন্ন নদীগুলোর ১৪টি পয়েন্টের পানি বৃদ্ধির তথ্য সরবরাহ করে। কিন্তু বাংলাদেশ চেয়েছিল ২৮টি পয়েন্টের বিস্তারিত তথ্য। এরপর একাধিকবার চিঠি দিলেও অন্য তথ্য দেওয়ার ব্যাপারে প্রতিবেশী দেশটি কোনো সাড়া দেয়নি। ১৯৭২ সালের যৌথ কমিশন চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ এই একটিমাত্র তথ্য দৈনিক দুবার পায়। বাংলাদেশে বন্যার পানির ৯২ শতাংশের উৎস হচ্ছে উজান থেকে আসা ঢল। ফলে উজান থেকে আসা পানির পরিমাণ, গতিবেগ ও ব্যাপ্তিকাল বিস্তারিত না জানলে বন্যার সঠিক পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব নয় এমনটিই বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশের পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদের তুলনায় বরাক, মনু, গোমতী, খোয়াই ও মুহুরী নদীর পানি দ্রুত প্রবাহিত হয়। সঠিক ও বিস্তারিত তথ্য ছাড়া এসব নদীর বন্যার পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন। এসব নদী সরু ও উঁচুনিচু পথ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় এবং উজানে পাহাড় থাকায় পানি দ্রুত ভাটির দিকে নেমে আসে। এতে প্রস্তুতি নেওয়ার আগেই বন্যার পানিতে সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বরাক, মুহুরী ও গোমতী নদীর ক্ষেত্রে অন্তত এক দিন আগেও পূর্বাভাস দিতে হলে ভারতের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া দরকার বলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।

আর দেশের পূর্বাঞ্চলের মুহুরী ও খোয়াই নদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে ন্যূনতম তথ্যও পায় না। ফলে বন্যা ও দুর্যোগ মোকাবিলার প্রস্তুতি নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এসব এলাকায় যেসব বাঁধ, নিষ্কাশন অবকাঠামো রয়েছে, তা বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড নিয়ন্ত্রণ করে। আকস্মিক বন্যার কারণে এসব অবকাঠামোর ব্যবস্থাপনাও কঠিন হয়ে পড়ে। আর তাই, এমন আকস্মিক ও ভয়াবহ বন্যার ক্ষতি থেকে বাংলাদেশকে বাঁচাতে সঠিক তথ্য সঠিক সময়ে পাওয়ার বিকল্প নেই। 

বিশ্বের নানা প্রান্তে বন্যা মোকাবিলায় আঞ্চলিক সহযোগিতাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আর বাংলাদেশের মতো ভাটি দেশের জন্য উজানের সব কটি দেশের সঙ্গে মিলে কাজ করতে হবে। উজানের দেশ নেপাল, ভুটান ও বিশেষত ভারতের কাছ থেকে পানিপ্রবাহের সঠিক তথ্য যদি না পাওয়া যায় তবে বাংলাদেশকে এমন আগ্রাসী বন্যার মুখোমুখি প্রায় প্রতিবছরই হতে হবে, এ থেকে মুক্তি নেই।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh