জুলাই-আগস্টের দ্রোহের দিনগুলো জানান দিয়েছিল বাংলাদেশে মানুষ রাজনৈতিক বন্দোবস্তের পরিবর্তন চাইছে। গর্জে ওঠা স্লোগান, আন্দোলন, জনতার মিছিল জাগিয়েছিল আশা। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-পীড়ন, আন্দোলন ঠেকাতে বলপ্রয়োগ, পুলিশের গুলি-হামলা কর্তৃত্ববাদী সরকারের মুখোশ উন্মোচন করেছিল।
শত শত মানুষের মৃত্যু, রক্তস্রোত, অসংখ্য মানুষের দৃষ্টি হারানো, আহত-পঙ্গুত্ব বরণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এগোতে চেয়েছে নতুনের অভিযাত্রায়। ছাত্র-জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষার ফলশ্রুতিতে দায়িত্ব নেয় শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার। দায়িত্ব গ্রহণের এক মাস পূর্তি হয়েছে সরকারের।
এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে এমন একটা সময়ে, যখন দীর্ঘ স্বৈরশাসনে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসপ্রায়, আইনশৃঙ্খলা ও বিচার ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় লুণ্ঠনে অর্থনীতিও বিপর্যস্ত। অন্যদিকে কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসানের পর মানুষের মধ্যে জেগে উঠেছে রাষ্ট্র সংস্কার ও অর্থনীতি পুনর্গঠন করে একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের ব্যাপারে বিপুল আশা ও উদ্দীপনা।
নতুন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের জন্য আরেকটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ হলো, বাংলাদেশের মানুষের আশা ও প্রত্যাশাকে মাথায় রেখে পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে মানিয়ে চলা। প্রথাগতভাবে হাসিনার সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্র ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপড়েন দেখা দিয়েছে। মূলত হাসিনাকে দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য ঢাকার ক্রমাগত অনুরোধেই সম্পর্কের এই অবনতি। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার বলেছে, এই কারণে ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে প্রভাব পড়বে না। তবে বাস্তবতা হলো, ভারত প্রসঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের আবেগ-অনুভূতিও বদলে যাচ্ছে। ফলে ভারতের সঙ্গে কৌশলগত সহযোগিতা এবং সার্বিকভাবে, বৈদেশিক সম্পর্কে আরও ভারসাম্য আনতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের আরও অসংখ্য চ্যালেঞ্জের মধ্যে একটি হলো, দেশের নাগরিকরা বেশ কয়েকটি বিষয়ে ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় রয়েছে। হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে যারা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, তাদের প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণ এবং নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে স্পষ্টভাবে প্রমাণ হয়েছে দেশের সাধারণ মানুষ প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে সন্তুষ্ট নয়। অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, উন্নয়ন অংশীদার ও সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে আরও স্থিতিশীল একটি রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরির জন্য সংস্কার কর্মসূচি চালুর উদ্যোগ নিয়েছে।
শেখ হাসিনার বিদায়ে পক্ষপাতদুষ্ট, একপাক্ষিক শাসন ব্যবস্থা থেকে সরে আসার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই সংস্কৃতি গত তিন দশকে বাংলাদেশের রাজনীতির অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। আগের ভুলগুলোকে শোধরানোর এটাই সুযোগ। ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের বেশকিছু উদ্যোগ প্রশংসা কুড়িয়েছে। ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতে যেসব ফৌজদারি মামলা হয়েছে, সেগুলো প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সন্ত্রাস দমন এবং সাইবার নিরাপত্তা আইনে করা মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলাগুলো দ্রুত প্রত্যাহার এবং আন্দোলনে নিহতের ঘটনা জাতিসংঘের মাধ্যমে তদন্তের সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া গুমের ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠিত হয়। গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ।
৬ আগস্ট দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। ২ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী পদত্যাগ করেন। ১০ আগস্ট প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এবং আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতি পদত্যাগ করেন। একই দিনে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। ৫ সেপ্টেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন পদত্যাগ করেন।
৬ আগস্ট বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নির্বাহী আদেশে মুক্তি দেওয়া হয়। ২৮ আগস্ট জামায়াতে ইসলামী ও এর অঙ্গসংগঠনকে নিষিদ্ধ করে জারি করা প্রজ্ঞাপন বাতিল করা হয়। ৫ সেপ্টেম্বর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফ্যাসিবাদী দল ও জোট পুনর্বাসনের সুযোগ পাবে না।
১০ ব্যাংক ও এক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও আওয়ামীপন্থি ব্যবসায়ী, পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাদের অনেকের ব্যাংক হিসাব স্থগিত হয়েছে। মোবাইলে আর্থিক সেবা নগদের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা পর্ষদ বাতিল করে প্রশাসক নিয়োগ হয়েছে। শেয়ারবাজারে বেক্সিমকো, লা মেরিডিয়ান হোটেলসহ ১২ প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে নতুন গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
১৯ আগস্ট সব উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়রদের অপসারণ ও প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। ১২ আগস্ট বিভিন্ন পদে থাকা চুক্তিভিত্তিক সব নিয়োগ বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়। পরে তা কার্যকর করা হয়। আবার প্রশাসনে নতুন করে চুক্তিভিত্তিতে নিয়োগও দেওয়া হয়। সব সরকারি কর্মচারীকে সম্পদের হিসাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় ১ সেপ্টেম্বর। জনপ্রশাসন ও পুলিশের শীর্ষ পদগুলোতে পরিবর্তন এসেছে। উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতি। ২৫ ডিসিকে প্রত্যাহার।
গণ-আন্দোলনে হতাহতের ঘটনায় সাবেক মন্ত্রী-উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য, পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২৪ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। অস্ত্র উদ্ধারে ৪ সেপ্টেম্বর থেকে বিশেষ অভিযান শুরু হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ হবে গণশুনানির মাধ্যমে, নির্বাহী আদেশে নয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের চুক্তি পর্যালোচনায় কমিটি গঠন হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০-এর আওতায় নতুন কোনো চুক্তি হবে না। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিষয়ভিত্তিক সংস্কার, চিকিৎসাসেবার গুণগত মানোন্নয়ন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কাঠামো শক্তিশালীকরণে ১২ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে ৩ সেপ্টেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি।
বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ১ সেপ্টেম্বর শিক্ষাক্রম নিয়ে নির্দেশনা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে মাধ্যমিকে আবারও ফিরছে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা। তবে উচ্চশিক্ষায় স্থবিরতা কাটেনি। ২০ আগস্ট বাংলাদেশ সচিবালয়ের ভেতরে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে এইচএসসি ও সমমানের স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিল করে সরকার।
এ ছাড়া ৬৪ জেলায় অন্তত ৬৪টি নদী চিহ্নিত করে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হয়েছে। ২১ আগস্ট বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি পদে পরিবর্তন এসেছে। এদিন বিসিবি সভাপতির পদ ছাড়েন সাবেক মন্ত্রী নাজমুল হাসান। একই দিনে সভাপতি হন জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ফারুক আহমেদ। এ ছাড়া আরও কয়েকটি ক্রীড়া ফেডারেশনের সভাপতিকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
৫ সেপ্টেম্বর গণভবনকে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর’ করার সিদ্ধান্ত হয়। ২৯ আগস্ট ‘জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা (রহিতকরণ) অধ্যাদেশ, ২০২৪’-এর খসড়া অনুমোদন দেয় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। ফলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ শেখ মুজিবের পরিবারের সদস্যরা বিশেষ নিরাপত্তা সুবিধা পাবেন না।
১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের সাধারণ ছুটি বাতিল করা হয়। ৪ সেপ্টেম্বর সরকারি অর্থে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনার নামকরণের বিষয়ে আইনি কাঠামো ঠিক করতে উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাধারণ মানুষের এমন চিন্তার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যাশা প্রভাবও পড়বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর। সরকারকে সেসব বিবেচনায় নিতে হবে।
বাংলাদেশে বর্তমানে এমন একটি সেক্টর নেই যার সংস্কার দরকার নেই। বরং দেশটি এক খাদের কিনারায় অবস্থান করছে। সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, দখলদারির সঙ্গে সঙ্গে গুম, খুন, হত্যা যেভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সয়লাব হয়েছে গত ১৫ বছরে, স্বৈরাচারী সরকার পতনের মধ্য দিয়ে নতুন সম্ভাবনাময় একটি সরকার তার যাত্রা শুরু করেছে। ক্ষয় হয়ে যাওয়া এই রাষ্ট্রের সংস্কার ও মেরামত করতে হবে সময় নিয়ে। বাংলাদেশে সুন্দর একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু হোক, দুর্নীতি লুটপাট বন্ধ হোক; আর এরই মাধ্যমে প্রত্যাশিত বাংলাদেশে স্বপ্ন পূরণ হোক। আমাদের সেই অভিযাত্রা চালু থাকুক।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh