কাকস্য পরিবেদনা একটি সংস্কৃত প্রবাদ। এর অর্থ হচ্ছে- কাকস্য অর্থাৎ কাকেদের সহিত, ‘পরিবেদনা’- পরী অর্থাৎ সুন্দরীদের বে- অর্থাৎ বিবাহ দেওয়া যাবে না বা দেবে না। কারণ কাক- কৃষ্ণবর্ণ, কাক-কুৎসিত, কাক-অসুন্দর।
‘কাক’ নিয়ে সংস্কৃত বা বাংলা সাহিত্যে হিতোপদেশমূলক গল্প থেকে অনেক বাগধারা পর্যন্ত চালু রয়েছে। স্বভাবগুণে কাক পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করে। আমরা প্রতিদিন যত্রতত্র যেসব ময়লা-আবর্জনা নিয়ম ছাড়াই ফেলে দেই, তার বড় একটি অংশই সাফ করে ফেলে যে পাখিটি, সেটা হলো কাক। আমাদের দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আমলে কাকের সেবার গুরুত্ব অনেক। আশপাশের পাখিদের মধ্যে কাক অনেক বুদ্ধিমান, দলবদ্ধ ও সাহসী। বিজ্ঞানীদের গবেষণা থেকে জানা যায়, শরীরের সঙ্গে মগজের তুলনা করলে কাক শিম্পাঞ্জির সমপর্যায়ের অর্থাৎ তুলনামূলক বিচারে মানুষ কাকের চেয়ে খুব বেশি এগিয়ে নেই। কাকের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় ঈশপের গল্পেই পাওয়া যায়। একটি পিপাসার্ত কাক কলসির পানি যখন ঠোঁটের নাগালে পাচ্ছে না, তখন কিছুটা দূরে পড়ে থাকা নুড়ি পাথর এনে কলসিতে ফেলতে থাকলে পানির উচ্চতা বেড়ে কাকের ঠোঁটের নাগালে চলে এলো। সংস্কৃত সাহিত্যেও কাককে নিয়ে এমন অনেক গল্প রয়েছে।
প্রাচীনকালে মানুষ কাকের ডাক শুনে সংবাদ-দুঃসংবাদকে নির্ণয় করত। কাকেদের ভাষা বোঝার জন্য সংস্কৃত সাহিত্য ‘কাক চরিত’ নামে একটা বইও রয়েছে। ‘কাকডাকা ভোর’ শব্দটির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। কৃষক কাকের ডাকেই ঘুম থেকে উঠে মাঠে যেত। ঘুম ভাঙানোর কৃতজ্ঞতা এবং কাকের প্রতি ভালোবাসা থেকেই নবান্নের দিন কাককে নিমন্ত্রণ করত। দক্ষিণবঙ্গের অনেক অঞ্চলে এখনো ভোরে কিশোর-কিশোরীরা এক জায়গায় জড়ো হয়ে উচ্চৈঃস্বরে ছড়া কেটে বলে, ‘কাউয়া কো কো কো, মোগো বাড়ি আইও, এট্টা কলা দেব, প্যাটটা ভইরা খাইও।’ নবান্নের খাবার নারকেলের আচিতে করে কাককে দিয়ে তারপর সবার খাওয়ার রেওয়াজ এখনো আছে। কিন্তু নাগরিক জীবনের ছোঁয়ায় উৎসব- আচারে বদলের হাওয়া লেগেছে। কাকও আর আগের মতো চোখে পড়ে না।
জীববৈচিত্র্যবিষয়ক অনলাইন পোর্টাল লিস্টভার্স ডটকম থেকে জানা যায়, কাকের উদ্ভব ঘটেছে মধ্য এশিয়ায়। সেখান থেকে এটি উত্তর আমেরিকা, আফ্রিকা, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীতে ৪০টিরও বেশি প্রজাতির কাক দেখা যায়। তবে বাংলাদেশে সাধারণত বেশিসংখ্যক পাতিকাক ও অল্পসংখ্যক দাঁড়কাক দেখা যায়। কাক নিয়ে বাংলা ভাষায় জনপ্রিয় অনেক বাগধারার প্রচলন আছে। এই বাগধারার মাঝেই লুকিয়ে আছে কাকের স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য। কাকদের বাসার অগোছালো বৈশিষ্ট্যের জন্য ‘কাকের বাসা’ বাগধারাটির উদ্ভব হয়েছে। কাকদের বুদ্ধির কারণে ‘কাকের বুদ্ধি’ বাগধারাটির উদ্ভব হয়েছে। কাক অনেক ধৈর্যের অধিকারী, তাই ‘তীর্থের কাক’ বাগধারাটিও প্রচলিত আছে। বিপর্যস্ত অবস্থাকে বোঝাতে ‘ঝড়ো কাক’, পরিষ্কার স্বচ্ছ জল বোঝাতে ‘কাকচক্ষু’ ছাড়াও অত্যধিক চেষ্টা অর্থে কাকচেষ্টা এবং খুব প্রাতঃকাল বুঝাতে ‘কাকভোর’ বাগধারা ব্যবহার করা হয়। ‘ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না’ বা ‘কাক কাকই থাকে, কোকিল হয় না’, ‘কাক কাকের মাংস খায় না’ ইত্যাদি।
তার পরও এ কথা সত্যি যে একটা সময় মানুষের ঘুম ভাঙত কাকের ডাকে। শহরের আনাচকানাচে এই পাখির সংখ্যাও ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু নানা কারণে এখন আর ঢাকায় আগের মতো কাক চোখে পড়ে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাসস্থান ও খাদ্যের সংকট, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং মোবাইল টাওয়ারের মতো প্রযুক্তিগত স্থাপনার আধিক্যের কারণে কাকসহ অনেক প্রাণীই ঢাকা শহর থেকে বিলুপ্তির দিকে যাচ্ছে। রাজধানীর ধানমন্ডি লেক, রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কাকের সংখ্যা একেবারেই হাতে গোনা। তবে রাস্তার পাশে কিংবা ময়লার ভাগাড়ের আশপাশে কাকের সংখ্যা কিছুটা বেশি। ঢাকা শহরে কাক কমে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে পরিবেশ ও প্রাণী বিশেষজ্ঞরা সবাই বলছেন, ১০ বছরে কাকের সংখ্যা যে কমেছে তা খালি চোখেই বোঝা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কাক ও কুকুর সুরক্ষায় কাজ করে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘সেভ দ্য নেচার’। এই সংগঠনটির অভিমত হচ্ছে- গত কয়েক বছরে কাকের সংখ্যা মারাত্মকভাবে কমে গেছে। আগে অহরহ উদ্যান বা ক্যাম্পাসের আনাচকানাচে প্রচুর কাক দেখা যেত, কিন্তু এখন সে রকম দেখাই যায় না। কারণ হিসেবে তারা মনে করেন যে হারে অপরিকল্পিত উন্নয়ন হচ্ছে এতে কাকের মতো পাখিরা বাসস্থান হারাচ্ছে। পর্যাপ্ত খাবার থাকলেও মূলত বাসস্থান সংকটের কারণে ঢাকায় কাকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
রাজধানী ঢাকায় কাক কমে যাওয়ার কারণ সম্বন্ধে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম সম্প্রতি গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, কাক কমে যাওয়ার প্রধানত তিনটি কারণ হলো বাসস্থান ও খাদ্যের সংকট, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং মোবাইল টাওয়ারের মতো প্রযুক্তিগত স্থাপনার আধিক্য। এসবের কারণে কাক প্রাকৃতিক পরিবেশে তার যে সাপোর্ট প্রয়োজন হয় তা ঠিকভাবে পায় না।
প্রকৃতির নিজস্ব যে চক্র থাকে আমরা যেটাকে বাস্তুসংস্থান বলি, তাতে কাক একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই চক্রে অন্যান্য পাখি, পতঙ্গ, সরীসৃপ, স্তন্যপায়ী, বৃক্ষ সবই আছে। এই চক্র থেকে কোনো স্থান শূন্য হলে তার প্রভাব হবে ভীষণ ক্ষতিকর। বিশেষ করে ঢাকা শহরের মতো জনবহুল শহরে তা পরিবেশ বিপর্যয়ের পর্যায়ে যদি চলে যায়, তখন করার কিছুই থাকবে না। তাই কাকসহ বিভিন্ন পাখি, পতঙ্গ, প্রাণী সুরক্ষায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh