বিজয়ের দিনেও বিজয় আসেনি শিরোমণির

১৬ ডিসেম্বর রাত ৯টা, রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ করা হয়ে গেছে, ততক্ষণে ঢাকায় চলছে বিজয়োল্লাস। সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র খুলনার শিরোমণিতে; ভয়াবহ এক সম্মুখ সমরের সাক্ষী হলো শিরোমণি। ৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ১০৭ ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার হায়াৎ খান যশোর ক্যান্টনমেন্টের শক্তিশালী অবস্থান ছেড়ে পিছু হটে খুলনার শিরোমণি এলাকায় এসে প্রায় দুর্ভেদ্য ঘাঁটি গড়ে তোলেন। বরিশাল, পটুয়াখালী, ফরিদপুর ও কুষ্টিয়া থেকে সব ফোর্স এসে যুক্ত হলো হায়াৎ খানের সঙ্গে। বাংকার, ট্রেঞ্জসহ  শিরোমণির প্রতিটি পাকা স্থাপনায় ডিফেন্সিভ অবস্থান নেয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী- ৩২টি ট্যাংক ও অসংখ্য আর্টিলারি তো ছিলই। নদীবেষ্টিত শিরোমণির ভৌগোলিক সুবিধার কথা মাথায় রেখেই পাকিস্তানি বাহিনী এ জায়গায় ঘাঁটি গাড়ে। তাদের আশা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর শিরোমণি নৌপথে এসে তাদের উদ্ধার করবে। 

৬ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে বহু প্রাণহানি ঘটে গেছে শিরোমণিতে। টানা দুই দিন ধরে ভারতীয় বিমানবাহিনী গোলাবর্ষণ করলেও পাকিস্তান আর্মি তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছিল না। তাদের শক্তি ক্ষয় হয়েছে ধারণা করে ১৪ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী নিষেধ উপেক্ষা করে মেজর মাহেন্দ্র সিং ও মেজর গনির কমান্ডে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি দল কেবল ফ্যাক্টরিতে অবস্থিত পাকিস্তান আর্মির হেড কোয়ার্টারের দিকে যাত্রা শুরু করে। ভারতীয় বাহিনীর ২৮টি গাড়ির বহর বাদাম তলায় প্রবেশ করতেই পাকিস্তান আর্মির অ্যামবুশে পড়ে, ২৮টির মধ্যে ২৬টি গাড়িই ধ্বংস হয়ে যায়। নিহত হয় ২৫০ থেকে ৩০০ জন সেনা, মেজর মাহেন্দ্র সিং পালিয়ে আসেন। 

এরপর ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর এম এ মঞ্জুর অপারেশন শিরোমণির কমান্ড হাতে তুলে নেন। মেজর মঞ্জুর ত্বরিতগতিতে কমান্ড গ্রহণের দৃশ্যটি দেখেছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ওয়ার করসপনডেন্ট মুসা সাদিক। ‘মুক্তিযুদ্ধ হৃদয়ে মম’ গ্রন্থে তিনি দৃশ্যটির বর্ণনা করেছেন এভাবে- “শিরোমণি থেকে মঞ্জুর-হুদার জিপ ফুল স্পিডে ঢুকল যশোর ক্যান্টনমেন্টে। ট্যাংক ব্যাটল শুরু হওয়ার পর এই প্রথম তাদের দেখলাম। বিচলিত মনে হলো। আমার মনে প্রশ্ন জাগল ব্রিগেডিয়ার হায়াৎ খানের কাছে কি তিনি শেষ ব্যাটেলে পরাজিত হতে চলেছেন? তারা এসে ঢুকলেন মিত্রবাহিনীর কমান্ডারের রুমে। ঠিক ১০ মিনিট পরে বেরিয়ে এলেন তারা। 

দুজনেই ছুটছেন জিপের দিকে। আমরা তিনজন দৌড়ে ধরলাম মেজর হুদাকে। জানতে চাইলাম। জিপে উঠতে উঠতে মঞ্জুর সাহেবকে ইঙ্গিতে দেখিয়ে শুধু বললেন, ‘হি হ্যাজ টেকেন ফুল কমান্ড অল ফোর্সেস, নাউ অ্যাট হিজ ডিসপোজাল।’ তাদের জিপ ছুটে বেরিয়ে গেল শিরোমণির দিকে।” 

মেজর মঞ্জুর যখন শিরোমণির দিকে ছুটে যাচ্ছিলেন, তখন পথিমধ্যে পরিবারের উদ্দেশে একটি চিরকুট লিখলেন। স্ত্রী রানা ইয়াসমিন ও ছেলেমেয়েদের উদ্দেশে তিনি লিখলেন, ‘পবিত্র কোরআন শরিফে শহীদের মর্যাদা সর্বোচ্চ। আমার মর্যাদার জন্য তুমি ও সন্তানরা গৌরবানি¦ত হবে ও সব সময় গর্ব করবে।’ বিশ্বস্ত বার্তা বাহকের কাছে চিরকুটটি দিয়ে আবারও মঞ্জুর ছুটলেন শিরোমণির দিকে।  

শিরোমণিতে মেজর মঞ্জুরের কমান্ডে চূড়ান্ত যুদ্ধের বিবরণ পাওয়া যায় মুসা সাদিকের ‘মুক্তিযুদ্ধ হৃদয়ে মম’ গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন, ‘১৬ ডিসেম্বর রাত ৪টায় শিরোমণির ট্যাংক ব্যাটলের পুরো কমান্ডে আসেন মেজর মঞ্জুর। শিরোমণির ডাইনের এফএফ কলামটাকে ফ্রন্টলাইনের পেছনে সেকেন্ড ডিফেন্সে আনেন। কমান্ড দেন মেজর হুদাকে। ফ্রন্টলাইনের অ্যালাইড ফোর্সকে শিরোমণির ডাইনের ডিফেন্সে পাঠান। বাঁ দিকের দুটি ও পেছনের কমান্ডো কলাম তিনটিকে ফ্রন্টলাইনের ডিফেন্সে বসান। ডাইনে পেছনে সে স্থানে চলে যায় অ্যালাইড ফোর্স। মেইন রোডের নিচে ঘাপটি মেরে বসে থাকা মিত্রবাহিনীর ট্যাংকগুলোর  দুটিকে সংকেত অনুযায়ী শিরোমণি খুলনার মেইন রোডে ও অন্য ছয়টিকে ডানদিকের নিচু বেতগাছের পাশ দিয়ে হেবি ক্যাজুয়ালিটি মেনে নিয়েও দুর্ভেদ্য পাক ডিফেন্সের পেছনের পজিশনে ক্ষিপ্রগতিতে পৌঁছে যাওয়ার জন্য তীক্ষèভাবে প্রস্তুত করেন। প্রতিটি ট্যাংকের পেছনে জুড়ে দেন শহীদ হতে প্রস্তুত ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডোকে।

ভোর ৫টা ১৫-এর দিকে শিরোমণির বুকে মঞ্জুর তার কমান্ডোদের নিয়ে পাকিস্তানি ব্যূহের মধ্যে হারিয়ে গেলেন। তিনি ও তার কমান্ডোরা বেঁচে আছেন না শহীদ হলেন, কেউ জানে না! চরম বিপর্যয় ও  বিপদের এই মুহূর্তে মেজর হুদা সেকেন্ড লাইনকে তৎক্ষণাৎ ফ্রন্টলাইনে আগাতে বললেন। মিত্রবাহিনীর আর্টিলারির ছত্রছায়ায় হানাদারের গোলাগুলি বৃষ্টির মধ্যে ভারী অস্ত্রশস্ত্র তুলে যার শরীরে যত শক্তি ছিল তত বেগে দৌড়ে গেল ফ্রন্টলাইনের বাংকারে, পজিশনে। ডানদিক থেকে ঝড়ের বেগে ছুটে গেছে ট্যাংকসহ মিত্রবাহিনী। তিন মাইলজুড়ে দুই পক্ষের কামান ও ট্যাংকের গোলাবর্ষণে শিরোমণি তড়পাতে লাগল। আশপাশের গাছপালার ডাল, নারকেলগাছের মাথা ভেঙে পড়তে লাগল। 

হায়াৎ খানের কামানের গোলা, ট্যাংকের গর্জন আর মর্টার শেলিংয়ের ব্যূহের মধ্যে বজ্রের কড় কড় আওয়াজে উল্কার বেগে ঢুকে পড়েছেন মঞ্জুর তার স্যুইসাইডাল কমান্ডো স্কোয়াড নিয়ে। পাকিস্তানি কর্নেল-ব্রিগেডিয়ারদের বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতে চোখের নিমিষে গুঁড়া গুঁড়া হয়ে গেল হায়াৎ খানের ডিফেন্স, দুর্ভেদ্য বাংকার ভেঙে-ফেটে চৌচির। জ্বলন্ত শেরম্যান ট্যাংক থেকে ভীত বিহ্বল সব হানাদাররা বেরিয়ে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ছে। শিরোমণি পেছনে ফেলে হায়াৎ খানেরা পেছনে দৌড়াচ্ছেন। ভোর পৌনে ৬টায় এলো মিত্রবাহিনীর জঙ্গি বিমানের বহর। এই পরাজয়ের পর হায়াৎ খানের অধীন সেনাদের মনোবল শেষ হয়ে যায়। তারা প্রস্তুত হয় আত্মসমর্পণের জন্য। পাঁচ সহস্রাধিক সেনা, শত শত আহত ও ১৫৭টি মৃতদেহ রেখে ব্রিগেডিয়ার হায়াৎ খান শিরোমণির মাটিতে হাঁটু গেড়ে ভারতীয় নবম ডিভিশন এবং ব্রিগেড মেজর মঞ্জুরের কাছে ১৭ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টায় আত্মসমর্পণ করেন।’

শিরোমণির ট্যাংক ব্যাটল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। সামরিক শিক্ষার বইয়ের পাতায়ও স্থান করে নিয়েছে খুলনার শিরোমণি যুদ্ধ। ব্রিটেনের স্যান্ড হার্টস আর্মি একাডেমি, ভারতের দেরাদুন আর্মি একাডেমিসহ বিশে^র বহু দেশের আর্মি একাডেমিতে পড়ানো হয় ‘ট্যাংক ব্যাটেল অব শিরোমণি’।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh