কোথায় কী ‘সংস্কার’ হলো

৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে যে শব্দটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হচ্ছে, সেটি হলো ‘সংস্কার’। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় Reform। সংস্কারকে অনেক সময় পরিবর্তনের প্রতিশব্দ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু সংস্কার ও পরিবর্তন বা Reform ও Change-এর মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে।

সংস্কার হলো একটি বিদ্যমান ব্যবস্থা বা কাঠামোর মধ্যে থেকে উন্নতির প্রচেষ্টা। যেমন- পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের রেখেই তাদের গণমুখী ও দুর্নীতিমুক্ত করতে এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ, যা তাদের অধিকতর জবাবদিহির মধ্যে নিয়ে আসবে। এর মধ্য দিয়ে পুলিশ বাহিনীর নিয়োগ, বদলি, পদায়ন থেকে শুরু করে অপরাধের শাস্তি পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে একটি আমূল পরিবর্তন আসবে। অর্থাৎ একটি বড় ধরনের পরিবর্তন হতে পারে যদি সংস্কার কাজগুলো ঠিকঠাক করা যায়। কিন্তু সংস্কার ব্যর্থ হলে পরিবর্তন আসবে না। পরিবর্তনটা হচ্ছে চূড়ান্ত লক্ষ্য, যা অর্জনে সংস্কার হচ্ছে উপায়। সংস্কারের লক্ষ্য সমস্যাগুলো ঠিক করে বিদ্যমান ব্যবস্থাকে আরো কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য করে তোলা। এটি সাধারণত ধীরে ধীরে এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে ঘটে থাকে।

অন্যদিকে পরিবর্তন বা Change হলো কোনো একটি কাঠামো পুরোপুরি বদলে ফেলা। একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, কাঠামো বা পদ্ধতি প্রবর্তনের মাধ্যমে পরিবর্তন আসে। পরিবর্তন হুট করে হয় না। একজন মানুষ চাইলেই চট করে তার দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা ও দর্শন পরিবর্তন করে ফেলতে পারে না। এখানে অনেক ফ্যাক্ট কাজ করে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পরিবর্তন বলতে একটি বড় ধরনের উত্তরণকে বোঝায়। যেমন- রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে রূপান্তর। এটি চট করে হয় না। কখনো এর জন্য বড় আন্দোলন, অভ্যুত্থান এমনকি বিপ্লবেরও প্রয়োজন হতে পারে। পরিবর্তনের লক্ষ্য যেহেতু বড় এবং এর উদ্দেশ্য থাকে মৌলিক রূপান্তর ঘটানো, ফলে এটি রাতারাতি হয় না। এর জন্য অনেক উদ্যোগ নিতে হয়। তার প্রতিটি উদ্যোগই একেকটি সংস্কার।

দুই

সংস্কার ও পরিবর্তনের মধ্যে একটা বড় পার্থক্য হলো যেকোনো প্রশাসনিক, প্রাতিষ্ঠানিক বা রাষ্ট্রীয় সংস্কার করতে গিয়ে বড় ধরনের সংঘাত বা রক্তপাত নাও হতে পারে। যেমন- পুলিশ বাহিনী বা জনপ্রশাসনের নিয়োগ-বদলি-পদোন্নতি-পদায়ন এবং অপরাধের শাস্তির পদ্ধতি আধুনিক করার জন্য আইন সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হলো। কিছু নীতিমালা জারি করা হলো। পুরোনো আইন হালনাগাদ করা হলো। এর মধ্য দিয়ে কিছু ক্ষোভ-বিক্ষোভ হতে পারে। কিন্তু চূড়ান্তভাবে এটি সংঘাত বা রক্তপাতের জন্ম নাও দিতে পারে। কিন্তু কোনো একটি সিস্টেমকে পুরোপুরি বাতিল করে দিতে চাইলে, সরকারকে উৎখাত করতে চাইলে, সরকার পরিচালনার পদ্ধতি ও রাষ্ট্রকাঠামো বদলাতে চাইলে নানা পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে পারে।

গত আগস্টের পরে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের যে কথা বলা হচ্ছে এবং যে সংস্কার বাস্তবায়নের জন্য প্রায় ১৫টি কমিশন গঠন করা হয়েছে, তারা আসলে কী করছে বা শেষ পর্যন্ত কী করতে পারবে তা নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন ও সংশয় রয়েছে।

কমিশনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আছে সংবিধান সংস্কার ও নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। তবে হালে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনও বেশ আলোচনায় আছে। তার কারণ প্রশাসনে পদোন্নতিতে এতদিন ধরে প্রশাসন ক্যাডারের যে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল বা এখনো আছে, সেই মনোপলি ভাঙার জন্য এই কমিশন কিছু সুপারিশ করেছে বা সুপারিশ করবে বলে জানিয়েছে। কিন্তু তাতেই তেতে উঠেছেন প্রশাসন ক্যাডারের বর্তমান এমনকি সাবেক কর্মকর্তারাও। প্রশ্ন হলো, তারা কি সংস্কার চান না? তারা কি চান যে জনপ্রশাসনে তারাই রাজত্ব করবেন?

প্রশাসনে যে আন্ত ক্যাডার বৈষম্য, তার পেছনেও প্রধানত ভূমিকা রাখে প্রশাসন ক্যাডার। বলা হয়, তারা অন্য সকল ক্যাডারের ওপর ছড়ি ঘোরায় এবং পদোন্নতি ও পদায়ন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে সবচেয়ে বেশি। এ নিয়ে অন্য ক্যাডারের লোকজন তাদের প্রতি বেশ ঈর্ষান্বিতও থাকে। যে কারণে বিসিএস পরীক্ষায় চাকরিপ্রার্থীদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে থাকে প্রশাসন ক্যাডার। কেননা এই ক্যাডারের লোকজন যত দ্রুত পদোন্নতি পান, অন্য কোনো ক্যাডারে সেটি সম্ভব হয় না। কিন্তু কমিশন এই পদ্ধতি বদলানোর যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে বাধা আসছে ভেতর থেকেই। তাহলে সংস্কার বা পরিবর্তন হবে কী করে?

তিন

পুলিশ সংস্কারেও একটি কমিশন গঠিত হয়েছে। কিন্তু তাদের কাজ নিয়ে খুব বেশি কিছু শোনা যায় না। কেবল নবনিযুক্ত আইজিপি এবং ডিএমপি কমিশনার জুলাই অভ্যুত্থানে পুলিশের ভূমিকার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ৫ আগস্টের পরে গত চার মাসে পুলিশের আচরণ ও কর্মকাণ্ডে কি আদৌ কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে? দেশের আইনশৃঙ্খলা এবং রাস্তাঘাটে ট্রাফিক সিস্টেমের বিশৃঙ্খলা দেখে অনেক সময় মনেই হয় না দেশে পুলিশ বলে কোনো বাহিনী আছে।

বলা হচ্ছে, জুলাইয়ের ট্রমা তাদের কাটেনি। ট্রমা কাটতে কতদিন লাগবে? বিগত বছরগুলোয় পুলিশ যে সরকারের পেটোয়া বাহিনী তথা ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার মূল শক্তি হিসেবে কাজ করেছে, সেই জায়গাটির পরিবর্তন কী করে হবে? পুলিশ বাহিনীতে শুধু সংস্কার নয়, বরং আমূল পরিবর্তন লাগবে।

এখন কি থানায় সাধারণ মানুষ নির্বিঘ্নে, বিনা ঘুষ ও হয়রানি এবং সময়ক্ষেপণ ছাড়াই সেবা পাচ্ছে? পুলিশ কি দুর্নীতি বন্ধ করেছে? পুলিশ প্রশাসন সংস্কার কমিশন এই বাহিনীকে জনবান্ধব করার ক্ষেত্রে কী ধরনের সুপারিশ দেবে এবং সেই সুপারিশ কারা কতদিনে বাস্তবায়ন করবেন?

চার

রাষ্ট্রক্ষমতায় কারা আছেন, তাদের রাজনৈতিক পরিচয় কী, সাধারণ মানুষের কাছে তার চেয়ে বড় প্রশ্ন বাজারে গিয়ে সে স্বস্তি পাচ্ছে কি না। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা যে নাজুক, বিশেষ করে ব্যাংকিং খাত যে ধসে পড়েছে, সেটি অস্বীকারের কোনো সুযোগ নেই। বেশ কয়েকটি ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার পথে এবং তার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকেও অনেকে দায়ী করছেন। সুতরাং ব্যাংক ও আর্থিক খাত সংস্কারে সরকার কী করছে?

অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি প্রধান উপদেষ্টার কাছে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। এই প্রতিবেদনে উল্লিখিত সুপারিশের ওপর ভিত্তি করে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সংস্কারে কী কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং তার ফলাফল কী?

পাঁচ

বারবারই বলা হচ্ছে, এই সরকার অতীতের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো নয়। সংবিধান রক্ষার শপথ নিলেও সরকারের কোনো কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি বলছেন এটি সাংবিধানিক নয়, আবার বিপ্লবী সরকারও নয়। সরকারের নাম ও ধরন যাই হোক, মানুষ মূলত স্বস্তি চায়। সারা দেশের মানুষের মধ্যে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতার বোধ তৈরি হয়েছে। সেনাবাহিনী এখনো বিচারিক ক্ষমতাসহ মাঠে আছে। অথচ অপরাধ বাড়ছে বলে গণমাধ্যমে খবর আসছে। নানা ধরনের নাশকতামূলক ঘটনা ঘটছে। সুতরাং সংস্কার বা পরিবর্তন কোথায় কতটুকু হচ্ছে বা হবে এবং কোথায় আসলেই কতটুকু সংস্কার প্রয়োজন, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন সেই সংস্কার কারা করছেন?

দেশে হয়তো একজন মানুষও খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি একটা ইতিবাচক পরিবর্তন বা প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার চান না। কিন্তু সেই সংস্কার বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত লোকগুলো এই কাজের জন্য কতটা যোগ্য, তা নিয়ে সংশয় আছে। সরকারের অন্যতম প্রধান অংশীজনদের অনেকেরই কথাবার্তার ঢং, আচরণ, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ মানুষ পছন্দ করছে না। বাস্তবতা হলো উগ্রতা ও প্রতিহিংসা দিয়ে রাষ্ট্রে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার ও পরিবর্তন সম্ভব নয়।

পরিশেষে, ২০২৫ সাল শুধু অন্তর্বর্তী সরকার নয়, বরং সারা দেশের মানুষের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ধারণা করা যায়, রাজনৈতিকভাবে একটি ঘটনাবহুল বছর হবে এটি। বিএনপির দ্রুত নির্বাচন দাবি এবং সংস্কারের কথা বলে সরকার ও তাদের অংশীজনদের নির্বাচন বিলম্ব করতে চাওয়া সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি করবে কি না, তা এখনই বলা মুশকিল।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh