টালমাটাল রাজনীতি আর রক্তক্ষয়ী গণ-অভ্যুত্থানের মতো বাংলাদেশের প্রকৃতিও ২০২৪ সালের প্রায় পুরো সময় বৈরী অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছে। বছরটা শুরু হয়েছিল তীব্র শৈত্যপ্রবাহ দিয়ে। এরপর বাংলাদেশের ইতিহাসে উষ্ণতা আর বন্যার রেকর্ডের সঙ্গে ছিল ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতও। এত সব দুর্যোগ ও বৈরী আবহাওয়ায় আক্রান্ত হয় কোটি কোটি মানুষ। বিপদের বড় শিকার দেশের কৃষি খাত। বিপুল ক্ষতি হয় অর্থনীতির। প্রাকৃতিক দুর্যোগের তীব্রতা এবং সংখ্যা বৃদ্ধিকে পরিবেশবিদরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের প্রতিফলন হিসেবে দেখছেন।
বছরজুড়েই ভুগেছে মানুষ
বছরের শুরুটা হয়েছিল তীব্র শৈত্যপ্রবাহ দিয়ে। গত জানুয়ারিতে দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৫ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমেছিল। এরপর ১৬ মার্চ থেকে শুরু হয় মৌসুমের প্রথম দাবদাহ। পরবর্তী সময়ে এপ্রিল মাসের পুরোটা সময়জুড়ে আরেক দফা টানা দাবদাহের কবলে পড়ে দেশ। এর আগে দেশের ইতিহাসে সবশেষ ১৯৪৮ সালে এত লম্বা সময় ধরে অব্যাহত ছিল তাপপ্রবাহ। এবার এপ্রিলে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ওঠানামা করে ৪২ থেকে ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। গরমের তীব্রতায় তৈরি হয় দুর্যোগকালীন পরিস্থিতি। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে সব স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করা হয় ২১ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত। ছকে বাঁধা জীবনের অনেক কিছুই ওলটপালট করে দেয় ‘আগ্রাসী’ এপ্রিল। দাবদাহে পোড়া মানুষ ‘অচেনা’ এই এপ্রিলকে মনে রাখবে বহুদিন।
এক মাসের প্রবল গরমে জীবন ও সম্পদের হয়ে গেছে বড় ক্ষতি। নিভে গেছে ৯৫ প্রাণ। বিপর্যয়ে পড়েছে কৃষি, নেমেছে পানির স্তর। বেঁকে গেছে রেলপথ, বিটুমিন উঠে এবড়োখেবড়ো সড়ক। অনেকটাই থমকে যায় ব্যবসা-বাণিজ্য। ৪ মের পর এক সপ্তাহ বিরতি দিয়ে ফের বাড়তে শুরু করে তাপমাত্রা, যা দফায় দফায় স্থায়ী ছিল জুলাই পর্যন্ত। মৌসুমি বৃষ্টিপাতের জেরে আগস্ট মাসে গরমের কষ্ট থেকে কিছুটা রক্ষা পায় দেশবাসী। তবে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এবং তৃতীয় সপ্তাহে ফের মৃদু দাবদাহ প্রবাহিত হয় দেশের বিভিন্ন জেলার ওপর দিয়ে।
মার্চ থেকে তাপপ্রবাহের সঙ্গে মাঝে ঝরেছে শিলাবৃষ্টি। মার্চের শেষে দেশের পূর্বাঞ্চলীয় বিভিন্ন জেলায় আঘাত হানে তীব্র শিলাবৃষ্টি। বৃষ্টির সঙ্গে ঝরে পড়া কোনো কোনো বরফখণ্ডের ওজন ছিল দুইশ গ্রামেরও বেশি।
মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু করে মাসজুড়েই দেশের বিভিন্ন স্থানে কালবৈশাখী ঝড় ও শিলাবৃষ্টি আঘাত হানে। জুন, জুলাই ও আগস্ট মাসেও বিক্ষিপ্তভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে আঘাত হানে কালবৈশাখী ঝড়। এসব ঝড়ে বিভিন্ন স্থানের ঘরবাড়ি ও ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়াও ঘটে হতাহতের ঘটনা।
বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় বছরজুড়েই বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানলেও ২০২৪ সালে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব ছিল অনেকটাই কম। ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে ছয় জেলায় প্রাণ হারায় ১০ জন। ঘূর্ণিঝড় রেমালের পর কয়েক মাসের বিরতিতে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে আরেকটি ঘূর্ণিঝড়। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ‘দানা’ নামে অভিহিত এই ঘূর্ণিঝড়টি মূলত ভারতের ওড়িশা অঞ্চল দিয়ে উপকূল অতিক্রম করলেও এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলাগুলোতেও। আগস্টে ঘূর্ণিঝড় ‘আসনা’ এলেও তেমন ক্ষতি হয়নি। বছরের শেষ দিকে ৩০ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় ফিনজাল সরাসরি বাংলাদেশে আঘাত না করলেও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হালকা ও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়।
মৌসুমি বৃষ্টিপাত এবং ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে মে মাস থেকে শুরু করে আগস্ট মাস পর্যন্ত দফায় দফায় বন্যায় আক্রান্ত হয় দেশের বিভিন্ন জেলা। ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় এক কোটি মানুষ। মে মাসের শেষ সপ্তাহ ও জুন মাসে কয়েক দফা আকস্মিক বন্যার সম্মুখীন হয় সিলেট। এই বন্যার রেশ কাটতে না কাটতেই জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে ফের বন্যার কবলে পড়ে দেশের ১৫ থেকে ২০টি জেলা। তবে ২০২৪ সালের সবচেয়ে প্রলয়ঙ্করী দুর্যোগ হিসেবে বিবেচিত হয় আগস্ট মাসের শেষ ১০ দিনে দেশের পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোতে হওয়া বন্যা। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা অক্সফামের দেওয়া তথ্য মতে, বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফেনী ও নোয়াখালীসহ ১১টি জেলা। এই জেলাগুলোর ৯০ শতাংশ মানুষ বন্যায় মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ে। ধ্বংস হয় ৪৮ শতাংশ বাড়িঘর। প্রলয়ঙ্করী এই বন্যায় প্রাণ হারায় প্রায় ৬০ জন মানুষ। বন্যায় ১৪ হাজার ৪২১ কোটি ৪৬ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতির কথা জানায় বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি। এরপর অক্টোবরে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের তিন জেলায় বন্যায় ১০ জন মারা গেছে।
কৃষিতে বড় ক্ষতি
আটটি আন্তর্জাতিক সংস্থার যৌথ উদ্যোগে গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত বিশ্ব ঝুঁকি প্রতিবেদনে দুর্যোগকবলিত দেশের তালিকায় নবম বাংলাদেশ। ২০২৪ সালে বাংলাদেশের ৪৬ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যাদের ৪৮ শতাংশের এ ধরনের পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর সামর্থ্য নেই। ওই জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগই গ্রামীণ এবং কৃষক। দুর্যোগে ধানের হেক্টরপ্রতি উৎপাদন আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। একের পর এক দুর্যোগ ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে বাংলাদেশে চালের উৎপাদন পূর্বাভাসের তুলনায় চার লাখ টন কম হতে পারে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএ। সবজি ও ফলের উৎপাদনের ওপরও এ বছর বৈরী আবহাওয়ার প্রভাব পড়ে। ২০২৪ সালে পাঁচ দফা বন্যার কারণে দুই লাখ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। কিন্তু দেশের যেসব এলাকায় বন্যা হয়নি, সেখানে উৎপাদন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়েছে। এ বছর আমনে প্রতি হেক্টর জমিতে প্রায় তিন টন চাল উৎপাদিত হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি। যে কারণে সামগ্রিকভাবে চালের উৎপাদন খুব বেশি কমেনি।
পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে যেসব দুর্যোগ বাড়ছে, তাতে কৃষি সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হবে, তা এ বছরের অভিজ্ঞতায় আমরা বুঝতে পারলাম। তবে একই সঙ্গে আমাদের কৃষি খাত এত দুর্যোগের পরও যে সফলতা দেখিয়েছে, তা আমাদের নতুন করে সাহস জুগিয়েছে। কিন্তু তার পরও আমরা দেখছি, দেশে খাদ্যপণ্যের দাম অনেক ক্ষেত্রে অযৌক্তিকভাবে বেড়েছে। জুলাই বিপ্লবের পরও কৃষি উপকরণ এবং খাদ্যপণ্যের বাজারে পুরোনো অলিগার্করা (লুটেরা গোষ্ঠী) রয়ে গেছে। এ ব্যাপারে আমাদের নীতিনির্ধারণী মহলের মনোযোগ দেওয়া উচিত।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : বছরজুড়ে দুর্যোগে বড় শিকার কৃষি জাহিদুর রহমান বৈরী আবহাওয়া গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh