দেশের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত আছি

দেশপ্রেমিক কৃষক বাবুল হোসেন

আঁকাবাঁকা রাস্তা, সবুজ পাতার উঁকিঝুঁকি দিয়ে ঘেরা শিবগঞ্জ উপজেলার বিনোদপুর ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী কালীগঞ্জ গ্রাম। এরই মাঝে বেড়ে ওঠা এলাকার শান্তিপ্রিয় মানুষ হিসেবে পরিচিত কৃষক বাবুল হোসেন। জীবনের পরোয়া না করে দেশের স্বার্থে তিনি সব কিছু করতে প্রস্তুত, সম্প্রতি তারই প্রমাণ দিয়ে নিজের গ্রাম তথা দেশের মানুষের কাছে হয়েছেন শ্রদ্ধার পাত্র।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের চৌকা সীমান্ত এলাকায় শূন্যরেখা বরাবর কাঁটাতারের বেড়া স্থাপনের জেরে সম্প্রতি বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। সে সময় সীমান্তে বিজিবির সঙ্গে হাতে হাঁসুয়া নিয়ে বাঙ্কারে অবস্থান নেওয়া এক কৃষকের ছবি নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয়। ৮ জানুয়ারি রাত থেকে ওই কৃষককে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে আলোচনা। দেশপ্রেমের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে ছবিটি শেয়ার করেছেন অনেকেই। বিএসএফের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে হাঁসুয়া হাতে ওই ব্যক্তির অবস্থান ঠিক যেন বাঁশের কেল্লার তিতুমীরের মতোই।

বাংলাদেশি এই কৃষকের নাম বাবুল হোসেন। তিনি শিবগঞ্জ উপজেলার বিনোদপুর ইউনিয়নের কালীগঞ্জ গ্রামের মৃত কায়েস উদ্দিনের ছোট ছেলে। 

সোমবার দুপুরে কথা হয় বাবুল হোসেনের সঙ্গে। জানান, তার ইচ্ছা ছিল একজন আদর্শ কৃষক হওয়ার। সেই ছোট থেকে বাবার হাত ধরে চাষবাস করেন, সময় পেলে মাঝে মাঝে হলুদের ব্যবসা করেন। সেদিনের কথা বলতে গিয়ে বললেন, ‘আমি হলুদ পরিষ্কারের কাজ করছিলাম। মানুষের কাছ থেকে শুনতে পাই ভারত সীমান্তে কাঁটাতার দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে চলে যাই। দেখি, কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের জন্য ভারতের বিএসএফ মাটি খুঁড়ছে। এ সময় বিজিবির পক্ষ থেকে বাধা দেওয়া হয়। ফলে দুই দেশের সীমান্তের কাছে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। গ্রামের মানুষ বিজিবিকে সহযোগিতা করার জন্য পাশে এসে দাঁড়ায়। আমি সাহস নিয়ে বিজিবির পাশে বসে ছিলাম। তখন আমার হাতে হাঁসুয়া ছিল। এই সময় কেউ ছবি তুলে তা নেটে ছেড়ে দেয়।’

তিনি আরো বলেন, ‘চৌকা সীমান্তে উত্তেজনার কারণে এলাকার অনেক কৃষকের ফসল নষ্ট হয়েছে। বিশেষ করে সরিষার ক্ষতি হয়েছে অনেক। আমরা তাতে কিছু মনে করিনি। কারণ আগে দেশ বাঁচানো প্রয়োজন। দেশের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত আছি, তবুও এক ইঞ্চি মাটি কারো হাতে তুলে দেব না। ভবিষ্যতেও যদি তারা সীমান্তে বেড়া দেওয়ার চেষ্টা করে, আমরা বিজিবির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তা প্রতিহত করব।’

বাবুলের স্ত্রী মাস্তারা বেগম বলেন, ‘গণ্ডগোল দেখে আমার স্বামী বর্ডারে গিয়ে বিজিবির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। বলেছিলেন, যদি তারা (ভারত) হুমকি দেয় তাহলে আমরাও হুমকি দেব। বিজিবির পাশে গিয়ে দাঁড়াব, তাদের সহযোগিতা করব এবং দেশকে রক্ষা করব।’

বাবুল আলীর প্রতিবেশী ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘আমরা সবাই বিজিবির পাশে ছিলাম। কিন্তু বিজিবির এত কাছাকাছি যেতে পারিনি। বাবুল আলী সবার আগে বিজিবির পাশে গিয়েছে। এমনকি বিজিবির পাশে বসে থাকা একটি ছবি ভাইরাল হয়েছে। বাবুল আলীকে দেখতে অনেক মানুষ ভিড় জমাচ্ছে বাড়িতে।’

বিজিবির পাশে বসে থাকা বাবুল আলীর ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে তানজিল হাসান নামের একজন ফেসবুকার লিখেছেন, ‘ছবির দা হাতে লোকটি কি কৃষক? জানি না। তবে এরই মধ্যে নেটিজেনরা তাকে কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই লোকের পরিচয় জানতে খুব ইচ্ছা করে। কিন্তু পরিচয় না জানাই শ্রেয়। কারণ ওনার একটাই পরিচয় হোক, উনি বাংলাদেশি। বাংলাদেশের কোনো ভারী অস্ত্র নাই, যুদ্ধজাহাজ, পারমাণবিক অস্ত্র নাই, কিন্তু বাংলার আছে সংশপ্তক মানসিকতার জনগণ। এই জনতার নানা চারিত্রিক ত্রুটি আছে, হীনম্মন্যতা, হিংসা, জিঘাংসা, মূর্খতা, সীমাবদ্ধতা আছে, আবেগ আছে। আর বুকভরা ভালোবাসা আছে।’


প্রতিবেশী মো. কামাল হোসেন বলেন, কৃষক বাবুল হোসেন এর আগেও ২০০৩ সালে সীমান্ত রক্ষার জন্য এমনই ভূমিকা পালন করেছিলেন।

চৌকা সীমান্ত এলাকার বিনোদপুর ইউনিয়ন পরিষদ  ইউপি সদস্য মো. বাদশা বলেন, ‘সীমান্তের পরিস্থিতি থমথমে। সীমান্তের দুই পারে বিএসএফ ও বিজিবির সতর্ক অবস্থান দেখে চিন্তায় পড়েছে স্থানীয়রা। সীমান্ত এলাকায় উত্তেজনায় ক্ষেত-খামারে কাজ বন্ধ রেখেছেন তারা।’ তিনি বলেন, ‘একসময় পাতিয়া ছিল খরস্রোতা নদী। এ নদীর মাছের সুমিষ্টতার সুনাম ছিল। স্বাধীনতার পরেও বর্ষা-বন্যায় পানিতে ভরে উঠত নদী। কিন্তু কালক্রমে ভারত থেকে বাংলাদেশে আসা এই নদীটি মরে গেছে। নদীর ওপর ভারতীয় অংশে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া ছিল না। উন্মুক্ত এই স্থানে নতুন করে সীমান্ত ঘেঁষে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার চেষ্টা করে ভারতীয় বিএসএফ। জানতে পেরে বাধা দেয় বিজিবি। তবে আমাদের কৃষক বাবুল হোসেন যে দেশপ্রেমের পরিচয় দেখিয়েছেন, তার জন্য আমরা সবাই গর্বিত, সময়ের সাহসী সন্তান তিনি।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৫৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম কিবরিয়া বলেন, এটা একটি দুঃসাহসিক কাজ। কিন্তু কোনো রকম নিরাপত্তাব্যবস্থা বিশেষ করে হেলমেট, বুলেট প্রুফ জ্যাকেট ছাড়া এভাবে ফ্রন্টলাইনে অথবা শূন্য লাইনের কাছাকাছি এগিয়ে আসা বিপজ্জনক। দেশের জনগণ ও আমরা উভয়েই দেশকে ভালোবাসি। কিন্তু বিজিবি ফেইল না করা পর্যন্ত সাধারণ মানুষের এ রকম ফ্রন্টলাইনে এগিয়ে আসা উচিত নয়। তিনি আরো বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় জনগণ আমাদের পাশে থেকে সমর্থন দিয়েছে। এ জন্য বিজিবি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। স্থানীয় লোকদের আমরা ধন্যবাদ জানাই।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh