নিশ্চিত হয়ে যাই এ আন্দোলন শুধু ছাত্রদের নেই

শাবাব হোসেন মেহের
প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৩:৫০

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক শাবাব হোসেন মেহের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার এক বন্ধু থাকত সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে। একবার সে বলেছিল, শুধু হলে থাকার জন্যই সে ছাত্রলীগের রাজনীতি করে। দেখলাম জুলাইয়ে আন্দোলন শুরু হলে এই ছেলেটাও আন্দোলনে নেমে এলো- মার খেলো, আহতদের নিয়ে হাসপাতালে ছোটাছুটি করল- এটা আমাকে তাড়িত করল আন্দোলনে নামতে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সরকারি চাকরি পাওয়ার ইচ্ছা সাধারণত থাকে না। কিন্তু আমাদের যে সহপাঠী, ভাই, স্কুল-কলেজের বন্ধুরা নৈতিক ও ন্যায্য দাবির জন্য আন্দোলন করছিল, তাদের ওপর বাজেভাবে হামলা হচ্ছিল। এসব দেখে আমরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আর বসে থাকতে পারিনি। আন্দোলনে নেমেছি। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনের মূল বেগ এসেছিল ১৬ জুলাই। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেকদের এমন একটি গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম যারা ক্যাম্পাসের যেকোনো সমস্যায় এগিয়ে আসত। সেই গ্রুপ থেকে অন্যদের সঙ্গে আমাকেও শিক্ষার্থীদের ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপগুলোতে অ্যাড করা হলো। আমরা রাতে সেই গ্রুপগুলোতে আলোচনা এবং আলাদা করে মিটিং করলাম। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আমাদের থেকে প্রত্যাশা করছিল কর্মসূচির। এক পর্যায়ে সবার সিদ্ধান্তে আমি পোস্টার ডিজাইন করলাম- ঘোষণা দিলাম, ‘১৬ তারিখ ব্র্যাক বিশ^বিদ্যালয় ও ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জয়েন্ট ইভেন্ট হবে’- কর্মসূচির নাম ‘বাড্ডা ব্লকেড’। তখনো ইস্ট ওয়েস্টের কাউকেই চিনি না, কিন্তু যৌথ ব্যানার লিখেছি। কারণ যেন কেউ না ভাবে আমরা একা নামছি। আসলে মনে সাহস জোগানোর জন্য এটা লিখেছিলাম। আমরা নামার সঙ্গে সঙ্গে বাড্ডার প্রগতি সরণি ব্লকেড হয়ে যায় দুই পাশে। এরই মধ্যে পুলিশ এসে গেলে, আমাদের রেজিস্ট্রার স্যার বিশ^বিদ্যালয়ের গেটের সামনে এলেন, তিনি একজন বিদেশি, কিন্তু শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে তিনি গেটের সামনে দাঁড়ালেন, এটা সবার মধ্যে একটা বড় প্রভাব ফেলেছিল। সেদিন আমাদের ওপর কোনো হামলা বা লাঠিচার্জ হয়নি।
১৭ তারিখ রাতে আমরা মিটিংয়ে বসলাম। পরদিন বিশ্ববিদ্যালয় খোলা। যেহেতু অনলাইনেই মিটিং হতো, তাই মিটিংয়ের তথ্য যাতে ফাঁস না হয়, সে জন্য আমরা ছিলাম সতর্ক। কারণ আমরা খবর পাচ্ছিলাম, কারা কারা আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে, তার একটি লিস্ট তৈরি করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পুরোনো ছাত্রলীগ কমিটির লোকজন। এরই মধ্যে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়কদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। সিদ্ধান্ত হলো, আন্দোলনের সময় আমাদের ব্যাকআপ লাগলে ইস্ট ওয়েস্ট থেকে ব্র্যাকে আসবে আর ইস্ট ওয়েস্টের ব্যাকআপ লাগলে আমরা ওদিকে যাব। রাস্তায় নজরদারি, ভিডিও করা সব কিছুর সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল আমাদের। সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার শেল, লাঠিচার্জ, রাবার বুলেট, ছররা গুলি- সবই চালিয়েছে পুলিশ। কিন্তু সেদিন ব্র্যাকের কেউ মারা যায়নি। তবে প্রচুর শিক্ষার্থী আহত হয়েছিল।
ওষুধ কেনার জন্য কিছু টাকা চেয়ে আমি ফেসবুকে পোস্ট করলাম। খুব অল্প সময়ে বেশ কিছু টাকা এসে গেল। আমি ওষুধ আনতে ইস্ট ওয়েস্টের ওদিকে গেলাম, পুলিশ তখন কানাডিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে- ব্র্যাকের ওপর হামলার খবর পেয়ে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে এসেছে, তারা ইস্ট ওয়েস্ট পর্যন্ত চলে এসেছিল। আমি আফতাব নগরের দিকে ঢুকতেই ইস্ট ওয়েস্টের ওপর পুলিশ হামলা করে। যখন ওষুধ নিয়ে ফিরছিলাম তখন ইস্ট ওয়েস্টের সামনের জায়গাটি একটা ধ্বংস স্তূপে পরিণত হয়েছিল। পুরো জায়গায় আগুন জ্বলছিল।
এ লেখায় একজনের কথা বলা দরকার, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী অ্যাডভোকেট ওয়াশি আবির ভাই, ব্র্যাকসহ আশপাশের যত শিক্ষার্থীকে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা তুলে নিয়ে গিয়েছিল, তাদের মুক্ত করতে যত ধরনের আইনি সহায়তা লাগে তিনি তা করেছেন- এমনকি খুলনা থেকেও ব্র্যাকের এক শিক্ষার্থীকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছেন।
কারফিউ জারি হলে আমাদের দুটো কাজ ছিল, এক. ব্লক রেইড থেকে বাঁচার জন্য যা যা করণীয় তা করা। দুই. যারা আহত হয়েছে তাদের খোঁজখবর রাখা, যাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাদের ছাড়িয়ে আনার ব্যাপারে যোগাযোগ রক্ষা করা। আমাদের তখন মাঠের কর্মসূচি ছিল খুবই অল্প, যার যার অবস্থান থেকে কাজ করে গেছে। ২৬-২৭ তারিখ পর্যন্ত গণমানুষ সেভাবে যুক্ত হয়নি, তখন আন্দোলনটা ধরে রেখেছিল শিক্ষার্থীদের একটা অংশ। ৩০ জুলাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ফ্যাকাল্টি প্রধানকে রাজি করাতে পেরেছিলাম আন্দোলনে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াতে, তারা এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে দাঁড়ালেন, তারপর আমরা আবার জায়গা নিয়েছি। সেদিনও পুলিশ লাঠিপেটা করে আমাদের ওপর। ২ আগস্ট থেকে আমাদের শিক্ষকরা প্রাণপণে আমাদের সঙ্গে অবস্থান করতে শুরু করেন। ৩ আগস্ট বাড্ডা ইউটার্নে আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে দেখলাম, যত দূর চোখ যায় শুধু মানুষ। আমি তখন নিশ্চিত হয়ে যাই এ আন্দোলন শুধু ছাত্রদের নেই, এটা ছাত্র-জনতায় পরিণত।
৫ আগস্ট সকালে আমার ঘুম ভাঙে গুলি চালানোর শব্দে। উঠে দেখি আমার বাসা থেকে (বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই আমার বাসা) আনুমানিক ১০০ মিটার দূরে অবস্থান নিয়ে পুলিশ আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালাচ্ছে। তড়িঘড়ি তৈরি হয়ে দ্রুত বেরিয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মিশে গেলাম। পাশের একটি নির্মীয়মাণ ভবন থেকে কয়েকজন গিয়ে বাঁশের সঙ্গে কয়েকটা টিন যুক্ত করে ঢাল বানিয়ে নিয়ে এসেছিল, আমিও তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সামনে এগিয়ে যেতে থাকলাম। হঠাৎ পুলিশের সাঁজোয়া যান থেকে ভারী অস্ত্র থেকে গুলি চালানো শুরু করলে আমাদের ঢাল ফুটো হয়ে যেতে থাকে, তখন এটা ছেড়ে দিয়ে আমি দৌড়ে পালিয়ে যেতে থাকি, কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম আমার পেছন থেকে দুটো ছেলে এগিয়ে এসে ঢালটি ধরল, আমি তখন ভাবলাম ওরা যেহেতু এগিয়ে যাচ্ছে আমার কিসের ভয়! মরলে একসঙ্গে মরব, এগিয়ে যাই। ১টা ৩০ থেকে ২টা পর্যন্ত এ লড়াই চলে।
সেদিনের একটা দৃশ্য আমার চোখে এখনো ভাসছে, ‘পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার এক পর্যায়ে হাতিরঝিল ব্রিজের ওপর থেকে একটা সাঁজোয়া যান আসতে দেখলাম, আমি একদম মুখোমুখি ছিলাম, মুহূর্তে লাফিয়ে রাস্তার পাশে স্যুয়ারেজের রিংয়ের আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম, আমি বুঝতে পেরেছিলাম পুলিশ গুলি চালাবে। আমার থেকে সামান্য দূরে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল, সরার সময় পায়নি, সাঁজোয়া যান থেকে গুলি চালানো হলো, আমি শুধু দেখলাম শটগানের গুলি এসে পিঠ থেকে পা পর্যন্ত ঝুমঝুম শব্দে এসে লাগল, এক সেকেন্ডের মধ্যে পুরো গেঞ্জি তার লাল হয়ে গেল। মনে হলো রক্ত ফিনকি দিয়ে বেরোচ্ছে। সেদিন এমন অবস্থা ছিল আমাদের পেছানোর জায়গাই ছিল না, একদিক থেকে গুলি চলছে আর অন্যদিক থেকে টিয়ার শেল। পেছনে আর সামনে ব্লক, ফলে আমরা সামনে এগিয়ে যেতে থাকলাম। দুপুরের দিকে সেনাবাহিনী এসে পুলিশকে পিছু হটতে বলল, এবং কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ার পর পুলিশ পিছু হটে। যখন শুনেছিলাম সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন, নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত মনে হয়েছিল সেনাবাহিনী ক্ষমতায় বসবে। এটা আমি অন্তত চাইছিলাম না।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর আমরা হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। আমরা ভেবেছিলাম নতুন কিছু হবে, বিপ্লবী সরকারের মতো। তবে আমরা হাল ছেড়ে দিইনি। ১৬ বছরের সিস্টেম এক দিনে তো বদলে ফেলা সম্ভব নয়, আমি-আমরা আশাবাদী এখনো।