আওয়ামী লীগ শাসনামলে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির সদরদপ্তর পিলখানায় বিদ্রোহে হত্যার পুনঃতদন্তের প্রতিবেদন আগামী জুনের মধ্যে চূড়ান্ত করা হবে বলে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে বলেছে এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিশন।
বুধবার বিকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানান কমিশন সদস্যরা। এ সময় তারা এ কথা বলেন।
কমিশন প্রধান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এ এল এম ফজলুর রহমান বলেন, “আমরা বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। যেহেতু ১৬ বছর আগের ঘটনা তাই অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে গিয়ে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে।
“অভিযুক্ত অনেকেই দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে তাদের বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছি।”
২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি সে সময় বিডিআরের সদরদপ্তরে এক বিদ্রোহে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হয়।
সেই বিদ্রোহের পর সীমান্ত রক্ষা বাহিনী বিডিআরের নাম বদলে যায়, পরিবর্তন আসে পোশাকেও। এ বাহিনীর নাম এখন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা বিজিবি।
বিদ্রোহের বিচার বিজিবির আদালতে হলেও হত্যাকাণ্ডের মামলা বিচারের জন্য আসে প্রচলিত আদালতে। এই ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। হত্যা মামলায় খালাস বা সাজাভোগ শেষে বিস্ফোরক মামলার কারণে মুক্তি আটকে আছেন ৪৬৮ বিডিআর সদস্যের।
হত্যা মামলায় ৮৫০ জনের বিচার শেষ হয় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর। তাতে ১৫২ জনের ফাঁসি, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন ও ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। খালাস পান ২৭৮ জন।
২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর সেই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের রায়ও হয়ে যায় হাইকোর্টে। তাতে ১৩৯ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয় ১৮৫ জনকে। আরো ২২৮ জনকে দেওয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদে সাজা। খালাস পান ২৮৩ জন।
হাইকোর্টের রায়ের আগে ১৫ জনসহ সব মিলিয়ে ৫৪ জন আসামি মারা গেছেন। হত্যা মামলায় হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে ২২৬ জন আসামি আপিল ও লিভ টু আপিল করেছেন। অন্যদিকে হাইকোর্টে ৮৩ জন আসামির খালাস এবং সাজা কমানোর রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এসব আপিল ও লিভ টু আপিল এখন শুনানির অপেক্ষায়।
অন্যদিকে বিস্ফোরক আইনের মামলায় ৮৩৪ জন আসামির বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে। কিন্তু মাঝপথে বিস্ফোরক মামলার কার্যক্রম এক প্রকার স্থগিত রেখে কেবল হত্যা মামলার সাক্ষ্য উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ। এ কারণে এই মামলার বিচার ঝুলে যায়।
ক্ষমতার পালাবদলে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা পুনঃতদন্তের দাবি জোরাল হয়।
এরপর গত ২৪ ডিসেম্বর সাত সদস্যের একটি কমিশন গঠন করে তাদেরকে ৯০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলে সরকার।
বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক এ এল এম ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে কমিশনে আছেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাইদুর রহমান, অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব মুন্সি আলাউদ্দিন আল আজাদ, পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত ডিআইজি এম আকবর আলী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. শরিফুল ইসলাম, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহনেওয়াজ খান চন্দন।
কমিশনের কার্যপরিধি তুলে ধরে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর সদর দপ্তরে সংঘটিত ঘটনার প্রকৃতি ও স্বরূপ উদ্ঘাটন করা, হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য অপরাধে জড়িত, সহায়তাকারী, ষড়যন্ত্রকারী, আলমত ধ্বংসকারী, ইন্ধনদাতাদের চিহ্নিত করবে কমিশন। এছাড়া অন্য সব বিষয়সহ ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত দেশি-বিদেশি ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, বিভাগ, সংগঠনকেও কমিশন চিহ্নিত করবে।
বিডিআর সদরদপ্তরে হত্যার সময় ও হত্যাকাণ্ডের আগে বা পরে হওয়া অন্যান্য অপরাধের স্বরূপ উদঘাটন, দায়ী ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, বিভাগ, সংগঠন চিহ্নিত করার কাজ করবে কমিশন।
ঘটনাটিকে ভিন্ন খাতে নিয়ে যাওয়া বা ঘটনায় সহায়তাকারী অন্যান্য দেশি বিদেশি ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, বিভাগ ও সংগঠনের সম্পৃক্ততা ও দোষীদেরও কমিশন চিহ্নিত করবে।
হত্যাসহ অন্যান্য অপরাধ ঠেকানোর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থতার জন্য দায়ী ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, বিভাগ ও সংগঠনও শনাক্ত করবে তদন্ত কমিশন।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, হত্যাকাণ্ডসহ অন্যান্য অপরাধে ইতোমধ্যে করা মামলা, ওই মামলায় অভিযুক্তদের দায় ও অপরাধ অক্ষুণ্ন রাখার পাশাপাশি যারা মামলা থেকে বাদ পড়েছে সেই সব আসল অপরাধীদের তদন্ত প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
কমিশনের সদস্য জাহাঙ্গীর কবির তালুকদার বলেন, “এমন জঘন্য হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় একজন কর্মকর্তা/কর্মচারীকেও সরানো হয়নি। কাউকে দায়ী করা হয়নি। এটি গোয়েন্দা সংস্থা, সামরিক বাহিনী এবং রাজনৈতিক ব্যর্থতা।”
তদন্ত কমিশনকে সরকারের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা হবে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “নৃশংসভাবে নিজেদের অফিসারদেরই তারা মেরেছিল। মসৃণভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে।”
পুরো জাতি তদন্ত কমিশনের দিকে তাকিয়ে আছে উল্লেখ করে ইউনূস বলেন, “আমরা সবাই উত্তর খুঁজছি। কমিশনকে এ ঘটনা তদন্তে সফল হতেই হবে। এ রহস্য উদঘাটন করতেই হবে।”
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh