খেলাপি ঋণ যেভাবে সাধারণ মানুষকে ভোগায়

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৩ অক্টোবর ২০২৩, ১৭:৪২

মোট বিতরণকৃত ঋণের ১০.১১ শতাংশই এখন খেলাপি। ছবি- সংগৃহীত
নানা ধরনের ছাড় দিয়েও খেলাপি ঋণ কমাতে সফল হয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। গত এপ্রিল-জুন সময়ে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৪ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। ফলে জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ-সংক্রান্ত হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বর্তমানে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ ঋণের ১০.১১ শতাংশই এখন খেলাপি।
বাংলাদেশের অর্থনীতি তথা ব্যাংকিং খাতের অবনতির মূল কারণ হিসেবে খেলাপি ঋণকেই চিহ্নিত করছেন অর্থনীতিবিদরা। যার ভুক্তভোগী হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। তারা বলছেন, দেউলিয়া আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নজরদারির মাধ্যমে খেলাপি ঋণের রাশ টেনে ধরা সম্ভব ।
অর্থনীতির ওপর আঘাত
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, খেলাপি ঋণ থাকা মানে, ব্যাংক ওই বিনিয়োগ থেকে কোন লভ্যাংশ পায় না, ব্যাংকের মুনাফা কমে যায়।
ব্যাংকে টাকার পরিমাণ কমে গেলে তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়। ফলে ব্যাংকের নতুন করে ঋণ দেয়ার ক্ষমতা কমে যায়। এতে নতুন করে বিনিয়োগ কমে যায়, কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে। ফলে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
অর্থনীতিবিদ এবং বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্য ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, ব্যাংকের টাকা অর্থনীতিতে ‘জ্বালানির মতো’ কাজ করে। এই খাতের বড় অংকের টাকা ব্যবস্থাপনার বাইরে চলে গেলে গোটা অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে।
তিনি জানান, ব্যাংকের মুনাফার ওপর যদি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, তাহলে স্বাভাবিকভাবে সরকার ব্যাংকের থেকে কম কর পায়। আর সরকার কম কর পেলে শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় খাতে ব্যয় কমে যাবে। যা এটি চক্রাকারে উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করবে।
এছাড়া অবকাঠামো উন্নয়নেও সরকার ব্যাংক থেকে বিনিয়োগ করতে পারবে না, বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভর করতে হবে।
সেইসাথে যে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা শেয়ার কিনছেন তাদের শেয়ারের দাম কমে যাচ্ছে। যার প্রভাব ব্যাংকিং খাতে এসে পড়ছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা।
মুদ্রাস্ফীতির হার বাড়ে
অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশের মতে খেলাপি ঋণ মানুষের জীবনে প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ দুইভাবেই প্রভাব ফেলে। উৎপাদনের উদ্দেশ্যে ব্যাংক ঋণ দিলেও এই ঋণের অর্থ উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহার না হওয়ায় তা সরাসরি মুদ্রাস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে।
তিনি জানান, যতো বেশি ঋণ খেলাপি হবে, ততোই সরকারের বাজেটে ঘাটতি হবে। খেলাপিদের চাপে ব্যাংক সরকারকে ঋণ দিতে পারবে না। সুতরাং ব্যাংক সরকারকে ঋণ দিতে বেশি টাকা ছাপাবে। তখন সেটাও পরোক্ষভাবে মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়ে দেবে।
তার মতে, ঋণের অর্থ যদি উৎপাদনশীল খাতে ব্যবহার হতো তাহলে টাকার বিপরীতে পণ্য বাজারে থাকতো। এতে মুদ্রাস্ফীতি হতো না।
নতুন ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা কমে
ঋণগ্রহীতারা ঋণ শোধ করতে না পারায় পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কারণ তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংকগুলোর ঋণ দেয়ার সক্ষমতা কমে যাচ্ছে।
এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা। শিল্প ও এসএমই খাতে ঋণের প্রবাহ সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। এতে ভালো ঋণগ্রহীতারা ঋণ পাচ্ছেন না।
এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ এমএম আকাশ বলেন, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বা কৃষকরা তাদের প্রয়োজনীয় ঋণ পাচ্ছে না। তারা মূলধন না পাওয়ার কারণে উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে সরবরাহ ব্যবস্থায় টান পড়ায় দ্রব্যমূল্যের ওপর চাপ তৈরি হচ্ছে।
অর্থাৎ বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সেটার প্রভাব গিয়ে পড়ছে পণ্য মূল্যের ওপর। এ কারণে সাধারণ মানুষকে বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে।
ক্ষতিগ্রস্ত হন আমানতকারীরা
খেলাপি ঋণের প্রভাবে ব্যাংকের সাধারণ আমানতকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তারা ব্যাংকে টাকা রাখলে লাভ পাচ্ছেন কম, ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ পোষাতে আমানতকারীদের লাভের হার কমিয়ে দিচ্ছেন।
অপরদিকে ভালো ব্যবসায়ীরাও ঋণ পেতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছেন। তাদের ওপর বেশি সুদ চাপানো হচ্ছে। অথচ এই ব্যবসায়ী যদি ঋণ পেলে দেশের উৎপাদন বাড়ত বলে জানাচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সাধারণ ব্যবসায়ীকে ঋণ দিতে গিয়ে ওই খেলাপি ঘাটতি পূরণের জন্য তাদের কাছে বেশি সুদ চাইছে ব্যাংক। এতে ভালো ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
এই বাড়তি সুদ পোষাতে পণ্যের দাম বেশি রাখতে বাধ্য হচ্ছেন বিক্রেতারা। অর্থাৎ ঘুরে ফিরে সাধারণ মানুষকে সেই বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে। এমনকি ব্যাংকের ক্ষুদ্র শেয়ারহোল্ডাররাও প্রাপ্ত লভ্যাংশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
এমএম আকাশের মতে, ভালো ব্যবসায়ীরা ঋণ পাচ্ছে না। সুদের হারটাও সরকার বাড়িয়ে দিচ্ছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা।
এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলছেন, যদি খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেশি থাকে তাহলে স্বাভাবিকভাবে ব্যাংক নাগরিকদের কাছে থেকে যে আমানত বা জমা নিচ্ছে তাদেরকে সেই জমা বাবদ আগের চাইতে কম হারে সুদ দেবে।
করের বোঝা বাড়ে
খেলাপি ঋণ সরকারের কর ব্যবস্থাপনাকেও প্রভাবিত করে।
অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশের মতে, খেলাপি ঋণের ফলে সরকারের বাজেটে যে ঘাটতি হবে, তখন ভারসাম্য করার জন্য সরকারের কর বৃদ্ধি করা ছাড়া আর উপায় থাকবে না। সেটিও হবে পরোক্ষ কর যা সব শ্রেণী পেশার মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
আকাশ বলেন, যদি প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে ওই খেলাপিদের থেকে কিছু টাকা আদায় করা যেতো তাহলে লাভ হতো। কিন্তু সরকার নিচ্ছে পরোক্ষ কর বা ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স। তার মানে এক জনের দোষের বোঝা বহন করবে নির্দোষ সাধারণ মানুষ। সরকার তার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এই মানুষগুলোর ওপর ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে।
এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য জানান, যদি সরকারের ব্যয় করার বা বিনিয়োগের চাহিদা থাকে এবং যেখানে ন্যায্য কর পাওয়ার কথা সেখান থেকে কর না পায় তাহলে স্বাভাবিকভাবে সরকার অন্য খাতে করের পরিমাণ বাড়িয়ে দেবে।
তখন প্রত্যক্ষ করের চেয়ে পরোক্ষ করের ওপর বোঝা বাড়াবে।
বৈদেশিক মুদ্রায় টান
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, খেলাপি ঋণ বা মন্দ ঋণের সাথে টাকা পাচারের গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
তার মতে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই টাকাগুলোর একটা বিরাট অংশ বৈদেশিক মুদ্রায় বদলে নিয়ে বিদেশে পাচার হয়ে যায়। ফলে তা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও চাপ তৈরি করছে।
অর্থাৎ সাধারণ মানুষের আমানতের ওই টাকা দেশের কোন উপকারে আসে না।
এক কথায় এই খেলাপি ঋণের প্রভাবে উৎপাদন হচ্ছে, ব্যাংক টাকাও ফেরত পাচ্ছে না। উপরন্তু টাকা বিদেশ পাচার হয়ে যাচ্ছে, যা অর্থনীতিকে চক্রাকারে আঘাত করছে।