Logo
×

Follow Us

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান

নীতি সুদহার বাড়ানো হয় কেন

Icon

প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৩, ১৭:০৩

নীতি সুদহার বাড়ানো হয় কেন

নীতি সুদহার ৭৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ছবি- সংগৃহীত

নীতি সুদহার বা রেপো রেট একবারে দশমিক ৭৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন নীতি সুদহার ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ফলে নতুন নীতি সুদহার বা রেপো রেট হবে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচ্চপর্যায়ের সভায় গতকাল বুধবার এই সিদ্ধান্ত হয়।

এনিয়ে তিন মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বার, আর গত বছরের মে মাসের পর থেকে ষষ্ঠবারের মতো বাড়ানো হলো নীতি সুদহার। ২০২২ সালে মে মাসে ৬ শতাংশের নিচে ছিল মূল্যস্ফীতি, যা মে মাসে ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়।

প্রায় একই সময়ের মধ্যে, বা গেল বছরের মার্চ থেকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক- ফেডারেল রিজার্ভ প্রায় এক ডজন বার সুদহার বাড়িয়েছে। প্রতিবেশী ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও গত মে মাসে একেবারে ২৫০ শতাংশীয় পয়েন্টের মতো ব্যাপকভাবে সুদহার বাড়ায়। উল্লেখযোগ্যভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পরও এ দুটি অর্থনীতি তাদের সুদহার উচ্চ পর্যায়েই রেখেছে।

বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর নীতি সুদহার বাড়ানোর কারণ কী আর অর্থনীতিতে এর প্রভাবই বা কেমন?

মূল্যস্ফীতি হ্রাসের উপায়

মূল্যস্ফীতির ওপর নীতি সুদহার বৃদ্ধি কেমন প্রভাব ফেলে, তা নিয়ে মধ্য এশিয়ার কয়েকটি দেশের ওপর একটি গবেষণা করেছে আইএমএফ। এতে বলা হয়, নীতি সুদহার প্রতি এক শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ালে বিপরীতে প্রথম এক বছরে মূল্যস্ফীতি শূন্য দশমিক ৫ শতাংশীয় হারে কমে, এবং মুদ্রার বিনিময় হার ১ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়লে মূল্যস্ফীতি কমে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশীয় পয়েন্ট হারে।

কিন্তু, বেসরকারি বিনিয়োগ ও আমদানির খরচ বাড়ার কথা চিন্তা করে– বাংলাদেশ ব্যাংক এতদিন নীতি সুদহার বাড়ানোর বিষয়ে ধীরে চলার নীতিতেই অটল ছিল।

এদিকে, এদিকে বর্তমান মুদ্রানীতিতে প্রক্ষেপণ রয়েছে, ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ১১ শতাংশ লাগবে। কিন্তু, আগস্টে তার চেয়েও অনেকটাই কম বা ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেড়েছে বেসরকারি ঋণ, যা ২২ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এমন পরিস্থিতি নীতি সুদহার বাড়ানোয় ব্যাংকারদের আশঙ্কা, এতে ব্যাংক খাতের তারল্যের ওপর চাপ আরও বাড়বে।

এর আগে গত ১ জুলাই নীতি সুদহার ৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক; কিন্তু টাকা ছাপিয়ে অর্থ সরবরাহের মাধ্যমে ঋণের সুদহার নিম্ন পর্যায়ে রাখায়– এ সিদ্ধান্ত ঋণ চাহিদা কমাতে তেমন ভূমিকা রাখতে পারেনি। গত বছরের মে থেকে ছয় বারে নীতি সুদহার ২২৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে নীতি সুদহার সমন্বয় করে। তিনি বলেন,  রেপো রেট (নীতি সুদহার) বাড়ানোর ফলে মূল্যস্ফীতি নাও কমতে পারে, কারণ গ্রাহক পর্যায়ে ঋণের সুদহার স্মার্ট রেটের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়, যা অনেকটাই ফিক্সড বলা যায়।

বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদের মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত মুল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে — ট্রেজারি বিল ও বন্ডের রেট বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া। তখন মুল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে। কারণ বাজার চাহিদা অনুযায়ী ট্রেজারি বিলের সুদহার ৯ থেকে ১০ শতাংশ, কিন্তু বর্তমানে সেটা ৭ শতাংশের কিছুটা বেশি।  

ব্যাংকে আমানত বাড়ে

মূল্যস্ফীতি হ্রাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর বহুল ব্যবহৃত নীতিগত উপায় হলো সুদহার বাড়ানো। রেপো রেট হিসেবেও পরিচিত নীতি সুদহারের সাম্প্রতিক বৃদ্ধি – কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অর্থ ধারের খরচ বাড়াবে, এতে ঋণের সুদহারও বাড়বে। ঋণের সুদহার বাড়লে ভোক্তাদের জন্য ঋণ নেওয়ার খরচ বাড়বে, এতে ঋণ চাহিদা কমবে এবং শেষপর্যন্ত তা মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে ভূমিকা রাখবে।

বাণিজ্যিক ব্যাংক যখন ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ সুদহারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের থেকে ধার করবে, তখন তারা ট্রেজারি বিলের জন্যও উচ্চ দর হাঁকবে, যা ঋণের সুদহারের সাথে সংশ্লিষ্ট। নীতি সুদহার বাড়ানোয় আমানতের সুদহারও বাড়বে।  

মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য এত দিন মূলত ডলারের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করে আসছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সুদের হার বাড়লে মানুষ সাধারণত ব্যাংকে আমানত রাখতে উৎসাহিত হন।

ঋণ গ্রহণের প্রবণতা কমে

সরকারের ঘাটতি বাজেট অর্থায়নে গত আগস্ট থেকে ট্রেজারি বিল বিক্রির মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর থেকে টাকা সংগ্রহ করতে শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নিলামে ব্যাংকগুলো ট্রেজারি বিলের উচ্চ দর হাঁকে, এতে স্মার্ট রেট বেড়ে যায়।  

গত সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে এক বৈঠকে বিশ্বব্যাংকের সাবেক পরিচালক ও গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে টাকা ছাপিয়ে ঘাটতি বাজেটে অর্থায়ন বন্ধের পরামর্শ দেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি অর্থবছরের জন্য ৬ শতাংশ হারে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও, গেল সেপ্টেম্বর মাসে তা ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশে পৌঁছেছে। অবশ্য আগের মাসের চেয়ে এই হার সামান্য কমেছে।

শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকও চরম অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হয়, কিন্তু নীতি সুদহার বাড়ানোর মাধ্যমে ঋণকে আরও ব্যয়বহুল করে ২০ মাসব্যাপী চলমান দুই অঙ্কের মূল্যস্ফীতিকে এক অঙ্কের ঘরে নামিয়ে আনতে পেরেছে।

ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক– রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার গভর্নর শক্তিকান্ত দাস ছয় বার রেপো রেট বাড়িয়ে সফলভাবে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে এনেছেন। নীতি সুদহার বাড়ানোর মাধ্যমে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপেও মূল্যস্ফীতির তাণ্ডবকে শান্ত করা সম্ভব হয়েছে।

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী

নীতি সুদহার বাড়ানোর তাৎক্ষনিক প্রভাব হিসেবে ব্যক্তি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও সরকারের ঋণ গ্রহণের খরচ বেড়ে যায়। উচ্চ নীতি সুদহারের বোঝা ব্যাংকগুলো সাধারণত গ্রাহকদের ওপর চাপায়, এতে বন্ধকী, কার লোন, ব্যবসায়ীক ঋণসহ নানান রকম ঋণের সুদহার উচ্চতর হয়। টাকা ধার করার খরচ বাড়লে- বাড়ি বা গাড়ি কেনার মতো বড় বড় ব্যয়গুলো কমাতে পারেন ভোক্তারা। উচ্চ সুদহারের কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হতে পারে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের মূল বিনিয়োগ কমাতে পারে, বা পেছাতে পারে-এতে কর্মসংস্থান হ্রাস পেতে পারে। সরকারকে তার ঋণের জন্য উচ্চ সুদ দিতে হতে পারে, এতে সরকারি ব্যয় ও বাজেট ঘাটতি বাড়তে পারে। এছাড়াও চাহিদার পতনে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মন্থর হতে পারে।

অর্থনীতিবিদেরা কি বলছেন

বৈঠক সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সাথে বুধবারের বৈঠকে আইএমএফ মিশনের কর্মকর্তারা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য মুদ্রার বিনিময় দর বেঁধে দেওয়া এবং ঋণের নতুন সুদহারের ফর্মুলাকে দায়ী করেন, যা ঋণের সুদহারকে নিয়ন্ত্রিত করছে।

জুনে স্মার্ট সুদহার ছিল ৭ দশমিক ১০ শতাংশ, যা জুনে বেড়ে হয় ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ, এবং আগস্টে তা দাঁড়ায় ৭ দশমিক ২০ শতাংশে; কারণ সরকারের ঘাটতি অর্থায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টাকা ছাপিয়ে সরবরাহের নীতির কড়া সমালোচনা করেছিলেন অর্থনীতিবিদেরা। ফলে এ দুই মাস কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন টাকা ছাপানো বন্ধ রাখে।  

গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংক ৮০ হাজার কোটি টাকা ছাপায়। চলতি অর্থবছরের জুলাই মাসে ছাপায় ৯ হাজার কোটি টাকা। ট্রেজারি রেট নিম্ন রেখে, ঋণের সুদহার স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে একাজ করে। এ পদক্ষেপ মূল্যস্ফীতিকে আরও উস্কে দিয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক পলিসি রেট বাড়ার কারণে অর্থ সরবরাহ আরও সংকুচিত হয়ে যাবে, যার ফলে ব্যাংকগুলো ঋণ প্রবাহ আরও কমাবে।

তিনি বলেন, একদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রেট বেড়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, সরকার ঘাটতি বাজেট মেটাতে ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নিচ্ছে, যার ফলে মার্কেটে ড্রাই আপ শুরু হবে। ব্যাংকের তারল্য সংকট বাড়লে গ্রাহকদের থেকে তখন উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ করতে হবে।

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান আরও বলেন,  ব্যাংকগুলোর সমস্যা হলো– প্রতিনিয়ত আমানতের সুদহার বাড়ছে, তবে ঋণের সুদহার বাড়ছে না। কারণ ঋণের সুদহার কেবল প্রতি ছয় মাস পর পর সমন্বয় করা যায়। ট্রেজারি রেট বাড়লে, ঋণের সুদহার বাড়ে। তবে এটা যে পরিমাণে বাড়ছে, বাজারের চাহিদা তার চেয়েও বেশি। বাজার অনুযায়ী ট্রেজারি রেট বাড়ানো দরকার। শুধুমাত্র তাহলেই এটা মুল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫