কমার্স ব্যাংকের ৩১৯ কর্মকর্তার পদোন্নতি বাতিল

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৪:৫২
বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। ছবি: সংগৃহীত
এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক (বিসিবি) থেকে নামে-বেনামে ঋণ নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এক পর্যায়ে তারল্য সংকটে দেখা দেয় ব্যাংকটিতে। আর্থিক দুরাবস্থায় পড়ে ব্যাংকটি। এর পেছনে পরিচালনা পর্ষদ ছাড়াও এস আলমের নিয়োগ দেওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও জড়িত ছিলেন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর কমার্স ব্যাংকের পর্ষদ পুনঃগঠনের আগে তড়িঘড়ি করে ৩১৯ কর্মকর্তার পদোন্নতি দেওয়ার আদেশ জারি করে তৎকালীন পর্ষদ। এসব পদোন্নতি বাতিলের জন্য সুপারিশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ ছাড়া এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণের সময়ে নিয়োগ ও পদোন্নতির ওপর অডিট করারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তারল্য সংকটে পড়া ব্যাংকটির জন্য বিশেষ অর্থ হিসেবে ১ হাজার কোটি টাকা সহায়তা দিতেও সায় দেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ৩৯৩তম সভায় এমন সব সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে কমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখার দুই গ্রাহক স্মাইল এ্যাপারেলস লিমিটেড এবং স্মাইল আউটফিট লিমিটেডের এলসি লিমিট ৩৯.৫০ কোটি টাকা এবং ওডি লিমিট ৩.৯০ কোটি টাকা নবায়নের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে। বিষয়টি তদারকির তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
২০২৪ সালের মধ্যে ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ১৫ শতাংশ এবং খেলাপির বিপরীতে ২০০ কোটি টাকা নগদ আদায়ের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। কিন্তু গত জুনে খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ৫৫ দশমিক ৯৯ শতাংশ এবং খেলাপি থেকে নগদ আদায় হয়েছে মাত্র ২১ দশমিক ৯৩ কোটি টাকা। যা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতার শর্ত পূরণ করতে সক্ষম হবে না বলে সংশয় রয়েছে।
গত ৩০ জুন পর্যন্ত ব্যাংকের আমানতের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৫১৭ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমানত ছিল ৪ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা। একই সময়ে খেলাপি ঋণের হার ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ব্যাংকটির বৃহদাংক ঋণের পরিমাণ ৯৫৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকা, যা মোট ঋণ ও অগ্রিমের (২ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা) ৪০ দশমিক ২৮ শতাংশ। ফলে ব্যাংকটির ঋণ কেন্দ্রীকরণ ঝুঁকি পরিলক্ষিত হয়।
২০২৩ সালে নতুনভাবে ৬৪০ কোটি ৬১ লাখ টাকার ঋণ খেলাপি হয়েছে। যার বিপরীতে নগদ আদায় মাত্র ৮১ কোটি টাকা। একইসঙ্গে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। যে কারণে খেলাপি ঋণের কোনো উন্নতি হয়নি। এছাড়া, ঋণ পুনঃতফসিলের কিস্তি পরিশোধ না করায় ফের খেলাপি হয়েছে সুবিধাভোগীরা। যার কারণে ব্যাংকটির তারল্য ও মূলধনসহ প্রধান আর্থিক সূচকগুলোর উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
গত ৩০ জুন পর্যন্ত সময়ে ব্যাংকটির ১১৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। এরপর থেকে চলতি হিসাব ঋণাত্নক হওয়ায় ব্যাংকের স্বাভাবিক দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা করতে ব্যাংক ব্যর্থ হচ্ছে।
ব্যাংকটির তারল্য ঝুঁকি বিবেচনায় এরইমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার পরও গৃহীত রেপো সুবিধার শর্ত মোতাবেক অর্থ পরিশোধ করার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সিএসআর, এসএলআর সংরক্ষণ করতে ব্যাংক ব্যর্থ হচ্ছে। এ ধরনের তীব্র তারল্য সংকটাপন্ন অবস্থায় নতুন করে আরও ১ হাজার কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা দিলে ঋণের অর্থ সময় মতো পরিশোধ করতে পুনরায় ব্যর্থ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
২০২১, ২০২২ ও ২০২৩ সালে ব্যাংকের নিট ক্ষতির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ১৫৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা, ২০০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ও ২৫২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে নিট ক্ষতির পরিমাণ ১১৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকা।
ব্যাংকের লাভ-ক্ষতি হিসাব বিশ্লেষণে দেখা যায়, সুদ ব্যয়ের পর ব্যাংকের সিংহভাগ অর্থ ব্যয় হচ্ছে বেতন-ভাতা ও অবচয় ব্যয় নির্বাহে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতার শর্ত অনুযায়ী ব্যাংকের ব্যয় হ্রাস ও আয় বৃদ্ধিতে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। অথচ বিভিন্ন সময়ে আমানত হিসেবে প্রাপ্ত অর্থ এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রাধীন বিভিন্ন ব্যাংকে স্বল্পমেয়াদি বিনিয়োগের নামে স্থানান্তরের প্রমাণ পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে, ব্যাংকের আর্থিক দুরবস্থার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের দায় নির্ধারণ, প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নতুন যোগ্য ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ নিয়োগের দৃশ্যমান ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তারল্য সহায়তা চাওয়ার যৌক্তিকতা নেই।
অন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রক্ষিত অর্থ ফেরত আনা, ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্ক উন্নয়ন, ঋণ আদায় বিভাগ শক্তিশালীকরণ ও করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে তারল্য ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করার প্রতি কমার্স ব্যাংকের জোর দিতে হবে। এমন পেক্ষাপটে ব্যাংকের মুখ্য আর্থিক প্রধান সূচকের অবনমন রোধ করা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতার শর্ত পরিপালন করতে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
এদিকে, চলতি বছর ১৯ মার্চ ব্যাংকের বিভিন্ন পদে ৩৪২ নির্বাহী/কর্মকর্তা পদোন্নতি দেওয়া হয়। পরবর্তীতে গত ১৮ আগস্ট বিভিন্ন পদে ১১৮ জন এবং ২৫ আগস্ট বিভিন্ন পদে ২০১ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
ব্যাংকিং দুর্বল ব্যবস্থাপনা কাঠামো ও ভঙ্গুর আর্থিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আগস্ট মাসে তড়িঘড়ি করে দেওয়া পদোন্নতির অফিস আদেশ প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে । এ পদোন্নতির আদেশ স্থগিত করার জন্য পর্ষদকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে এ ব্যাংকে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগ সময়ে সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে দাখিল হয়েছে। কাজেই ব্যাংকে মানবসম্পদের সুব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হলে এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটিকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়া পর থেকে ব্যাংকের মানবসম্পদ নিয়োগ ও পদোন্নতির বিষয়ে একটি ফাংশনাল অডিট সম্পন্ন করা জরুরি। বিষয়টি জরুরি ভিত্তিতে বিবেচনার জন্য পর্ষদকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদ এবং এর কমিটিগুলো পুনর্গঠন করা হয়। ব্যাংকের দুর্বল ব্যবস্থাপনা কাঠামো, ভঙ্গুর আর্থিক পরিস্থিতি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন রেগুলেটরি পদক্ষেপ গ্রহণ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।