
রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ার পরও দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একটি বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে।
মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মার্চ ও এপ্রিল মাসের আমদানি বিল হিসেবে ১ দশমিক ৮৮৩ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে; এরপর দায়দেনা বাদ দিয়ে রিজার্ভ আবার ২০ বিলিয়ন ডলারে ঘরে নেমে এসেছে।
আকুর বিল পরিশোধের আগে সব দায়দেনা বাদ দিয়ে বিপিএম-৬ পদ্ধতির হিসাবে দেশের রিজার্ভ ছিল ২২ দশমিক ০৬১৯ বিলিয়ন ডলার। সেই হিসেবে এখন তা দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ১৭৮৯ বিলিয়ন ডলারে।
তুমুল গণ-আন্দোলনে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের ৯ মাসেও রিজার্ভ একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে, যদিও এই সময়ে প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স লাফ দিয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের আরেক প্রধান মাধ্যম রপ্তানিতেও গতি এসেছে।
আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দাবি করেছেন, দেশ থেকে অর্থপাচার ঠেকিয়ে দেওয়া গেছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের চারদিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করে। ওই হিসাব অনুযায়ী ৩০ জুলাই তা ছিল ২০ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার, ২১ আগস্টও ছিল তাই।
এই হিসাবে গত ৯ মাসেও অল্প হলেও ক্ষয় হয়েছে রিজার্ভে।
বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য রিজার্ভের বর্তমান স্থিতিতে সন্তুষ্ট। দেশের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, “আকুর বিল পরিশোধ করার পরেও রিজার্ভে বড় ধরনের কোনো চাপ পড়েনি।”
“এখন বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় ‘গ্রহণযোগ্য ও স্থিতিশীল’ অবস্থায় আছে। এর পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে প্রবাসীদের অব্যাহত রেমিট্যান্স পাঠানো এবং রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক প্রবণতা।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশের ইতিহাসে ২০২২ সালের আগস্টে রিজার্ভ উঠেছিল সর্বোচ্চ ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলারে। সে সময় বাংলাদেশ ৫০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলকের অপেক্ষায় ছিল।
কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারী শেষে বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্য ও শিল্পের কাঁচামালের দাম বাড়তে থাকায় এরপর থেকে রিজার্ভে দ্রুত ক্ষয় হতে থাকে। ২০২২ সালের শুরুতে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটায়। দ্রুত কমতে থাকে রিজার্ভ।
বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার ধরে রাখার চেষ্টা হিসেবে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রিজার্ভ থেকে ২৮ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি বিক্রি করা হয়। তবে অন্তর্বর্তী সরকার ডলার বিক্রি বন্ধ করে দেয়।
দেশের গ্রস রিজার্ভ অবশ্য আরেকটু বেশি। আকুর বিল পরিশোধের আগে তা ছিল ২৭ দশমিক ৪৪৩ বিলিয়ন ডলার, বিল পরিশোধের পর তা নেমে এসেছে ২৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলারে।
আকু কী?
আকু হলো- একটি আন্তঃদেশীয় লেনদেন নিষ্পত্তি ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মধ্যকার লেনদেনের দায় পরিশোধ করা হয়।
ইরানের রাজধানী তেহরানে আকুর সদর দপ্তর। এ ব্যবস্থায় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতি দুই মাস অন্তর আমদানির অর্থ পরিশোধ করে।
জাতিসংঘের এশিয়া অঞ্চলের অর্থনীতি ও সামাজিক কমিশনের (এসক্যাপ) ভৌগোলিক সীমারেখায় অবস্থিত সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর জন্য আকুর সদস্য পদ উন্মুক্ত।
ইতিবাচক ধারায় রপ্তানি ও রেমিটেন্স
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনসহ ও নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যেও দেশের পণ্য রপ্তানি ইতিবাচক ধারায় আছে। ২০২৪–২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই থেকে এপ্রিল) রপ্তানি আয় হয়েছে ৪ হাজার ২১ কোটি ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ বেশি।
প্রবাসী আয় বেড়েছে আরও বেশি পরিমাণে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে মোট রেমিটেন্স এসেছে ২৪ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার। আর আগের অর্থবছরের একই সময়ে প্রবাসীরা পাঠিয়েছিলেন ১৯ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার।
এ হিসাবে আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২৮ দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি রেমিটেন্স এসেছে।
সদ্য সমাপ্ত এপ্রিল মাসে দেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিটেন্স এসেছে, যা আগের বছরের একই মাসের চেয়ে ৩৪ দশমিক ৮০ শতাংশ বেশি।
ব্যাংকিং চ্যানেলে এই মাসে প্রবাসীরা পৌনে ৩ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন যা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে গত বছরের এপ্রিলে ছিল ২ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ সদ্য সমাপ্ত মাসে রেমিটেন্সের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৪ শতাংশের বেশি।