Logo
×

Follow Us

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান

বেসরকারি ব্যাংকে বেতন কমাতে চান মালিকেরা, কর্মীরা ক্ষুব্ধ

Icon

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ১৬ জুন ২০২০, ০১:৫১

বেসরকারি ব্যাংকে বেতন কমাতে চান মালিকেরা, কর্মীরা ক্ষুব্ধ

করোনাভাইরাস উদ্ভূত অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে ব্যাংক কর্মকর্তাদের বেতন ভাতা কমিয়ে দেয়াসহ এক গুচ্ছ প্রস্তাবনা তৈরি করে তা সদস্যদের কাছে পাঠিয়েছে ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস বা বিএবি।

ওই প্রস্তাবনায় মালিকেরা ব্যাংক কর্মকর্তাদের প্রমোশন, ইনক্রিমেন্ট, ইনসেনটিভ বোনাস আগামী দেড় বছর বন্ধ রাখারও পরামর্শ দিয়েছে বিএবির সদস্য ব্যাংকগুলোকে। পাশাপাশি এ সময়ে ব্যাংকের চলমান নিয়োগসহ সব ধরণের নিয়োগ বন্ধ রাখার কথাও উল্লেখ করেছে তারা।

তবে ব্যাংক খাতে মালিকদের এসব সুপারিশের বিপক্ষে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মালিকদের সংগঠন হলো বিএবি। দেশে মোট ব্যাংকের সংখ্যা ৬২টি, আর এগুলোর মধ্যে বেসরকারি ব্যাংক ৪২টি। আর এসব বেসরকারি ব্যাংকে মোট কর্মীর সংখ্যা প্রায় এক লাখ ১০ হাজার।

বিএবি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, উদ্ভূত পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে তারা তাদের পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, যা ব্যাংকগুলো ইচ্ছে করলে বাস্তবায়ন করতে পারে।

তিনি বলেন, ব্যাংক যাতে সুন্দরভাবে চলে সেজন্য আমরা কিছু মতামত তুলে ধরেছি এবং এটা একটা খসড়া। আমরা আলোচনা করে আমাদের সদস্যদের দিয়েছি। আমরা ব্যাংককে ডিক্টেট করতে পারি না। তবে কোন ব্যাংক চাইলে এসব পরামর্শ অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে পারে।

সদস্যদের দেয়া এক চিঠিতে সংগঠনটির সেক্রেটারি জেনারেল জানিয়েছেন, কভিড-১৯ উদ্ভূত অর্থনৈতিক মন্দার প্রেক্ষাপটে কর্মী ছাটাই না করে ব্যাংককে সচল রাখার জন্য চলতি বছর পহেলা জুলাই থেকে আগামী বছর ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের জন্য এসব পদক্ষেপ ব্যাংকগুলো গ্রহণ করতে পারে।

চিঠিতে যেসব পরামর্শ দেয়া হয়েছে, সেগুলো হলো- নতুন শাখা, এজেন্ট ব্যাংকিং শাখা এবং সাব ব্রাঞ্চ খোলা বন্ধ রাখা, সম্পদ (ফিক্সড) ক্রয় বন্ধ রাখা, স্থানীয় ও বিদেশে ট্রেনিং বন্ধ রাখা, সব বিদেশ ট্যুর বন্ধ রাখা, সিএসআর, ডোনেশন ও চ্যারিটি বন্ধ রাখা, পত্রিকা ও টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন বন্ধ রাখা, সব কাস্টমার গেট-টুগেদার বন্ধ রাখা, কর্মকর্তাদের গেট টুগেদার বা ম্যানেজারদের কনফারেন্স বন্ধ করা। দরকার হলে ভার্চুয়ালি করা, আইটি সংশ্লিষ্ট সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার ক্রয় সীমিত রাখা, অন্য সব খরচ সীমিত রাখা।

বেতন কমানোর প্রস্তাবে যেসব কারণ দেখানো হচ্ছে তা হলো- ব্যাংকে বিনিয়োগ হ্রাস পাওয়া, বিনিয়োগের উপরে সুদের/মুনাফার হার কমে যাওয়া, রিকভারি প্রায় শূন্য, ওভারভিউ বেড়ে চলা, আমদানি রপ্তানি কমে যাওয়া, বিশ্বব্যাপী ফরেন ট্রেড কমে যাওয়া, রেমিটেন্স প্রবাহ কমে যাওয়া, ক্রেডিট কার্ডে রিকভারি কমে যাওয়া, এপ্রিল ও মে এই দু মাসে প্রাপ্য মুনাফা/সুদ এক বছরের জন্য ব্লক রাখা, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্দেশিত প্রণোদনা বাবদ দুই মাসে কভিড-১৯ ব্যাংকিং সেবা দেয়ায় বিপুল অংকের ব্যয় হওয়া, কভিড-১৯ প্রতিরোধে সেনিটাইজেশন ও অন্য স্বাস্থ্যবিধি পালনে বাড়তি খরচ, কভিড-১০ পজিটিভ/মৃত কর্মকর্তা কর্মচারিদের চিকিৎসা ব্যয় ও স্বাস্থ্য বীমা বাদা বিপুল অর্থ ব্যয়, আয় কমে যাওয়ায় নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হওয়া।

তবে এসব ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে এ ধরণের চিঠি এখনো পাননি। তবে কয়েকটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা এমডি নিজেদের চেয়ারম্যানের মাধ্যমে প্রস্তাবনাগুলো সংগ্রহ করেছেন। তাদের একজন বিএবির সিদ্ধান্তগুলোর একটি কপি দিয়েছেন।

এতে দেখা যাচ্ছে যে বিএবির সেক্রেটারি জেনারেল স্বাক্ষরিত চিঠিটি সংগঠনের সব সদস্য ব্যাংককে উদ্দেশ্য করে লেখা হয়েছে।

সংগঠনের একজন কর্মকর্তা বলেন, তারা অনানুষ্ঠানিকভাবে বসে এসব মতামত দিয়েছেন, তবে এগুলো সদস্য ব্যাংকগুলোকে আনুষ্ঠানিকভাবে না দেয়া হলেও কোনোভাবে তা ফাঁস হয়ে গেছে। তবে প্রস্তাবনা আনুষ্ঠানিক দেয়া হোক আর না হোক, ইতোমধ্যেই কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক কর্মীদের বেতন কমানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে।


সিটি ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে তাদের বেতন-ভাতা কমানোর একটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে তারা জানতে পেরেছেন। ১৬ শতাংশ পর্যন্ত কমবে বলে শুনছি, যদিও এইচ আর থেকে কোন চিঠি আমরা এখনো পাইনি। জুনের বেতন পেলে বুঝতে পারবো, বলেন ওই কর্মকর্তা।

আর এক্সিম ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, আমাদের তো সাত বছর ধরেই বেতন কাঠামো রিভাইসই করেনি, আর কমাবে কোথা থেকে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ মনে করেন যে ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় মালিকদের এভাবে হস্তক্ষেপ অনৈতিক, এমনকি বেআইনিও বলা যেতে পারে।

তিনি বলেন, বিএবির তো এসব বিষয়ে কথা বলাই উচিত হয়নি। ব্যাংকের যে নিজস্ব বোর্ড আছে, এগুলো তাদের কাজ। ব্যাংকের যে টাকা সেটা মালিকদের নয়, আমানতকারীদের। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত হবে মালিকরা যেন ব্যাংকের বোর্ডের কাজ নিয়ে হস্তক্ষেপের সুযোগ না পায়।

ব্যাংকে কখনো মন্দা ছিলো না। তারা অসময়েও মুনাফা করেছে। এখন কম লাভ হলে তাতে কর্মচারিদের বেতন কেন কাটতে হবে। কোন ব্যাংক যদি মনে করে করবে সেটা তারা নিজেদের সিদ্ধান্তে, বিবেচনায় করবে।

ক্ষোভের কথা শোনা গেছে অন্যান্য কয়েকটি ব্যাংকের কর্মীদের কাছ থেকেও। মালিকদের এ ধরণের প্রস্তাবে ব্যাংক কর্মীরা ডিমোরালাইজড হবে উল্লেখ করেছেন ব্যাংক ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বা এবিবি চেয়ারম্যান ও ইবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার।

তিনি বলেন, মনে রাখতে হবে বিএবি কোনো রেগুলেটরি বোর্ড না এবং কোনো ব্যাংক তাদের কথায় সিদ্ধান্ত নেবে না। বিএবি হয়তো তাদের কিছু মতামত দিয়েছে। তবে এগুলো নির্ভর করবে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বা বোর্ডের ওপর। প্রত্যেকটা ব্যাংকের কৌশল, ব্যবসার ধরণ, শক্তি বা দুর্বলতার জায়গা আলাদা। এসব বিষয়ে ব্যাংকগুলো যার যার মতো করে অবস্থা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। বিএবির কথায় কিছু হবে না।

আর বিএবির উদ্যোগটি অদ্ভুত আখ্যায়িত করে এনআরবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মেহমুদ হোসেন বলেন, অনানুষ্ঠানিকভাবে বিএবির সুপারিশমালার একটি কপি পেয়েছি। আমি জানি না তাদের মূল কমিটিতে এসব সিদ্ধান্ত আদৌ হয়েছে কি-না।


তিনি বলেন, সব সেক্টরের মতো ব্যাংক কর্মীরাও আর্থিক ও স্বাস্থ্যগত দিক থেকে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন এবং এ সময়ে বরং তাদের জন্য মোটিভেশন জরুরি। আমি মনে করি এটা ভুল বার্তা দিতে পারে কর্মীদের। সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে ব্যাংক কর্মীদের জন্য মোটিভেশন আরো জরুরি। এমন সময়ে ঢালাও ভাবে এমন বার্তা কর্মীদের জন্য নেতিবাচক হবে। মাঠ পর্যায়ে কর্মীদের ডিমোটিভেশনের দিকে ঠেলে দিতে পারে।

মেহমুদ হোসেন- যিনি একই সঙ্গে এবিবির ভাইস চেয়ারম্যানও তিনি বলেন, বিএবি বিভিন্ন সময়ে পরামর্শ দিয়ে থাকে। তারা মন্দার কথা বলেছে। কিন্তু আমি জানি না মন্দা শুরু হয়েছে কি-না। এমন কিছু আমার গোচরে আসেনি।

তিনি বলেন, প্রত্যেক ব্যাংকের বোর্ড আছে। অনেক ব্যাংক বোর্ডেরই যথেষ্ট প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা আছে। মহামারি না হলেও নানা কারণে অনেক দুর্যোগ এসেছে অতীতে, যা বোর্ডগুলো মোকাবেলা করেছে। যার যার ব্যাংক পরিচালনার পারদর্শিতাও আছে।

তিনি আরো বলেন, যেসব বিষয় বিএবি উল্লেখ করেছে সেগুলো ব্যাংকগুলোর নিজস্ব বিষয়। তারা নিজেরাই এসব বিষয় যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে থাকে।-বিবিসি

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫