সুইস ব্যাংকের সিন্দুকে নিরাপদে কালোটাকা

অর্থপাচারের উর্বর উৎসভূমিতে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। অর্থপাচারের বিষয়ে সরকারিভাবে কোনো তথ্য প্রকাশ করা না হলেও আন্তর্জাতিক সব তালিকায় বাংলাদেশের নাম রয়েছে। সর্বশেষ সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমানো অর্থের পরিমাণ প্রকাশ করা হয়েছে।

এতে দেখা যায়, গত বছরে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশির আমানতের পরিমাণ ৫৫ শতাংশ বেড়েছে। এর আগেও বিভিন্ন প্রতিবেদনে বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচারের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে; কিন্তু পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে প্রশাসনের দিক থেকে তেমন কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। উল্টো পাচারকারীদের অর্থ সহজে দেশে ফিরিয়ে এনে বৈধ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে।   

সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে কী পরিমাণ বিদেশের অর্থ জমানো আছে, তার একটি প্রতিবেদন প্রতিবছর প্রকাশ করে থাকে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি)। ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড-২০২২’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশিদের আমানত দাঁড়িয়েছে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ। প্রতি ফ্রাঁ বাংলাদেশি ৯৫ দশমিক ৭০ টাকা হিসেবে মোট টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৩৩৩ কোটি, যা এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ। গত  ২০২০ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ ছিল ৫৬ কোটি ৩০ লাখ সুইস ফ্রাঁ, টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ৫ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরে জমার পরিমাণ বেড়েছে ৫৪ দশমিক ৭২ শতাংশ।

এসএনবির এর আগের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৭ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ ছিল ৬৬ কোটি ১৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ, ২০১৮ সালের শেষে এই অর্থের পরিমাণ কমে হয় ৬২ কোটি সুইস ফ্রাঁ। ২০১৯ সালে এসে দাঁড়ায় ৬০ কোটি ৩০ লাখ ফ্রাঁতে।

বাংলাদেশের আইন অনুসারে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া কোনোভাবেই বিদেশের ব্যাংকে টাকা রাখার সুযোগ নেই। সুইজারল্যান্ডের বিনিয়োগ বা অন্য কারণে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অর্থ নিয়ে যাওয়ার অনুমোদন নেই। কোনো ব্যক্তির জমানো অর্থ যদি থাকে, তবে অবশ্যই তা অবৈধ; কিন্তু সুইজারল্যান্ডে বসবাসকারী বাংলাদেশি সেখান থেকে অর্জিত অর্থ সে দেশের ব্যাংকে রাখতেই পারেন। 

বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান মাসুদ  বিশ্বাস বলেন, যে কোনো মাধ্যম থেকে অর্থপাচার সংক্রান্ত তথ্য জানলে তা যাচাই-বাছাই করে বিএফআইইউ। সুইস ব্যাংকের প্রতিবেদনের বিষয়ে তাদের কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। 

এ দিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, বাংলাদেশ থেকে নানাভাবে অবৈধ উপায়ে পাচার হওয়া অর্থ যেমন সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে জমা হয়, তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিরাও দেশটিতে অর্থ জমা রাখেন। ফলে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে থাকা বাংলাদেশিদের মোট অর্থের মধ্যে বৈধ-অবৈধ সবই রয়েছে। সাধারণত সুইস ব্যাংক অর্থের উৎস গোপন রাখে। এ কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে অর্থ জমা রাখেন। দেশটির ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের টাকার পরিমাণ বলা হলেও, পাচার সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। এমনকি আমানত হিসেবে কার কত অর্থ আছে, তা-ও জানা যায়নি।

প্রসঙ্গত, সারা বিশ্বের ধনীদের অর্থ গোপনে গচ্ছিত রাখার জন্য বহু দিনের খ্যাতি সুইজারল্যান্ডের। কঠোরভাবে গ্রাহকদের নাম-পরিচয় গোপন রাখে সুইস ব্যাংকগুলো। যে কারণে প্রচলিত বিশ্বাস অবৈধ আয় আর কর ফাঁকি দিয়ে টাকা জমা রাখা হয় সুইস ব্যাংকে। তবে শুধু সুইজারল্যান্ড নয় পাচারকারীদের জন্য করস্বর্গ আরও কিছু  দেশ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, হংকং ইত্যাদি।  

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশ থেকে প্রচুর অর্থ পাচার হয়। সুইস ব্যাংকগুলো গ্রাহকের অর্থের বিষয়ে যথেষ্ট গোপনীয়তা রক্ষা করে। সরকার ইচ্ছা করলে আনুষ্ঠানিকভাবে সে দেশের কাছে তথ্য চাইতে পারে। অনেক উন্নত দেশ এখন সম্পদের উৎস সম্পর্কে প্রশ্ন না করেই বিদেশিদের বিনিয়োগের সুযোগ দিচ্ছে। বাংলাদেশের বাজেটে বিদেশে থাকা সম্পদ থেকে কর আদায় করতে এবং নগদ অর্থ ফেরত আনতে যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তাতে সাড়া মিলবে বলে তিনি মনে করেন না। অর্থপাচারের বিষয়ে সরকারের কোনো গবেষণা বা তথ্য না থাকলেও অর্থপাচারের একটি উদাহরণ হচ্ছে পিকে হালদার। তিনি দেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে প্রধান থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে জমি, বাড়ি ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান কিনেছেন। কানাডাতে রয়েছে তার ৫টি বাড়ি। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ কোনোভাবে বিদেশে নিয়ে গেছেন। এছাড়া দেশের ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে অনেকে  বিদেশে পালিয়ে গেছেন।   

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত তিনটি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়।  এর মধ্যে রয়েছে- দুর্নীতি, সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নে অপচয়, বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকা, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও ব্যক্তির নিরাপত্তাহীনতা। রাজনৈতিক কারণে জাতীয় নির্বাচনের আগে অর্থপাচার বহুগুণ বেড়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থ রাখার ক্ষেত্রে বিত্তবানরা দেশকে নিরাপদ মনে করছেন না। তাই বিভিন্ন উপায়ে অর্থ পাচার হচ্ছে। পাচার রোধে বিভিন্ন কথা বলা হলেও বাস্তবে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই। পাচারের সঙ্গে অনেক প্রভাবশালী জড়িত। এ কারণে তাদের বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা আর সুশাসন বাস্তবায়ন করা জরুরি।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, কয়েক বছর ধরে টাকা পাচার বাড়ছে। অর্থ পাচারের বিষয়টি গভীর উদ্বেগজনক। এই অর্থপাচার রোধ করতে হলে দুর্নীতি কমিয়ে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার রিপোর্টে সুনির্দিষ্টভাবে তথ্য উঠে আসছে। আর অর্থপাচারের এ বিষয়টি সরকারও স্বীকার করেছে; কিন্তু পাচার রোধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা সামনে আসছে না।

এ দিকে আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থপাচারকারীদের বিশেষ সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। কেউ ৭ শতাংশ কর দিয়ে বিদেশে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে এনে বৈধ করতে পারবে। 

এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, আমরা পাচার হয়ে যাওয়া টাকা দেশে ফেরত আনতে সর্বাত্মক চেষ্টা করব। আশা করছি, টাকা ফেরত আসবে।

পাচারকারীদের এই সুযোগ দেওয়াকে অনৈতিক বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদরা। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও  নৈতিকভাবে এই সুযোগ অগ্রহণযোগ্য। পাচার হওয়া টাকা দেশে আনার বৈধতা দিলে যারা নিয়মিত কর দেন, তারা হতাশ হবেন। যারা সৎভাবে ব্যবসা করছেন, তারা কর দিতে নিরুৎসাহিত হবেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //