Logo
×

Follow Us

অর্থনীতি

আমানত কমছে বাড়ছে ঋণ

Icon

এমএইচ রশিদ

প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৯:২৮

আমানত কমছে বাড়ছে ঋণ

প্রতীকী ছবি

করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে মানুষের আয়-ব্যয়ে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আয় সঙ্কুচিত হলেও পণ্যমূল্যের ব্যাপক বৃদ্ধির কারণে মানুষের ব্যয় বেড়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ব্যাংকিং খাতে।

মানুষ যে হারে সঞ্চয় করেছেন তার চেয়ে দ্বিগুণ হারে ঋণ নিয়েছেন। তবে ব্যাংকিং খাতে আমানতের তুলনায় ঋণবৃদ্ধি হারের ব্যাপক তারতম্যে সম্পদ ব্যবস্থাপনায় অসামঞ্জস্যতা দেখা যাচ্ছে। ঋণের টাকা নয়-ছয় হওয়ার আশঙ্কা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সংকটময় পরিস্থিতিতে ব্যাংকের টাকার যথাযথ খাতে ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি। 

সংশ্লিষ্টরা জানান, সাধারণ নিয়মানুসারে ব্যাংকের ঋণ বাড়লে আমানতও বাড়ে। কারণ ঋণের টাকা সরাসরি নগদে দেওয়া হয় না, বরং সঞ্চয়ী হিসেবে প্রদান করা হয়। আবার ঋণ নিয়ে একজন অর্থ খরচ করলে আরেকজনের সেটি আয় হয়। আর মানুষের আয় বাড়লে সেও ব্যাংক সঞ্চয় বাড়ায়। এভাবে ঋণ-আমানত বৃদ্ধি পারস্পরিক চক্র হিসেবে কাজ করে। কিন্তু এই শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। যে হারে ঋণ বাড়ছে সেই হারে আমানত বাড়ছে না। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালের জুন শেষে ব্যাংকগুলোতে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৭১ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা। গত বছরের জুনে যা ছিল ১৩ লাখ ৫১ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে আমানত বেড়েছে মাত্র ৮ দশমিক ৯০ শতাংশ। ২০২০ সালের জুনে আমানত ছিল ১১ লাখ ৮১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। ২০২০ সালের তুলনায় ২১ সালে আমানত বাড়ে ১৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ। ২০২২ সালের জুনে আমানতের প্রবৃদ্ধির হার ২৯ শতাংশ কমে গেছে। 

অন্যদিকে ২০২২ সালের জুনে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৭১ হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা। আগের বছরের জুনে ছিল ১৪ লাখ ৩৯ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা। ২০২১ সালের জুনে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয় ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। আর ২০২২ সালের জুনে যা হয় ১৬ দশমিক ১০ শতাংশ। ঋণের প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে ৭৫ শতাংশেরও বেশি। 

এ বিষয়ে ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্সের উদ্যোক্তা অর্থনীতি বিভাগের সমন্বয় অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী বলেন, যদি অর্থপাচার না হয় তাহলে আমানত এবং ঋণের প্রবৃদ্ধির মধ্যে সামঞ্জস্য থাকবে। ঋণের টাকা যদি ব্যাংকিং খাত থেকে বাইরে চলে যায় এবং দেশের বাইরে চলে যায় তাহলে আমানত কমে যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত তদারকি বাড়ানো। ঋণের টাকা কোন খাতে যাচ্ছে- কারা নিচ্ছে। ধনিক শ্রেণিরা ঋণ নিয়ে তা বিলাসী খাত এবং পাচার করছে কিনা সেই বিষয়ে সক্রিয় হতে হবে। 

তিনি আরও বলেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা আসন্ন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অর্থনীতি টালমাটাল। এতে মানুষের আয় কমে গেছে। আয় কমে যাওয়ায় তাদের সঞ্চয়ের সক্ষমতাও কমছে। ফলে ব্যাংকের আমানত বৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। 

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টাকার জোগানের চেয়ে চাহিদা বেড়েছে। এতেই হয়েছে বিপত্তি। ব্যাংকিং খাতে বর্তমানে নগদ টাকার সংকট প্রকট। এতে একদিকে ব্যাংকগুলোর যেমন বিনিয়োগ সক্ষমতা কমছে, তেমনি নগদ টাকার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। প্রতিদিনই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করছে ব্যাংকগুলো। গত ২৯ আগস্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিভিন্ন উপকরণের মাধ্যমে ১০ হাজার ৩০ কোটি টাকার জোগান দেওয়া হয়েছে, যেখানে চাহিদা ছিল আরও অনেক বেশি। আর ৩০ আগস্ট ১১টি ব্যাংকের ৬ হাজার ৭২৩ কোটি টাকার জোগান দেওয়া হয়েছে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতির কারণে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। পণ্য উৎপাদন, পরিবহন থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যয় ৩০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। অর্থাৎ ব্যয় এক লাফে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ খেলাপি এবং বড় গ্রাহকদের সুবিধা দিতে নিয়মনীতি শিথিল করেছে। এতে ব্যাংকের নগদ আয় অনেক কমেছে। অন্যদিকে আবার নতুন ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বেড়েছে। এতে একদিকে প্রকৃত নগদ আদায় যেমন বাড়েনি, তেমনি কৃত্রিম মুনাফার মাধ্যমে ডিভিডেন্ড আকারে এসব মুনাফার একটি অংশ বের হয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ব্যাহত হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০২১-২২ পুরো অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর আমানত বেড়েছে টাকার অঙ্কে ১ লাখ ২০ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে তার আগের এক বছরের আমানত বাড়ে ১ লাখ ৬৯ হাজার ৭৫৭ কোটি টাকা। শেষে ব্যাংকের আমানত এসেছিল ১ লাখ ২০ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা। যেখানে আগের অর্থবছরে ছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার ৭৫৭ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে নতুন আমানত ৪৯ হাজার কোটি টাকা কম এসেছে। স্বাভাবিকভাবে এটি বাড়ার কথা। আমানত কমলে ঋণ কমবে এটাই নীতি। কিন্তু হয়েছে ঠিক তার উল্টো। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, সরকারি ও বেসরকারি মিলে বিদায়ী অর্থবছরে ঋণ দেওয়া হয়েছে ২ লাখ ৩১ হাজার ৮৪৯ কোটি টাকা। যেখানে আগের অর্থবছরে দেওয়া হয় ১ লাখ ৩২ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা। আর এ ঋণের মধ্যে বেসরকারি খাতের ঋণই ছিল ১ লাখ ৬২ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। যেখানে আগের অর্থবছরে বেসরকারি খাতে ঋণ ছিল ৯১ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকা। এ হিসাবে বেসরকারি খাতে ঋণ বেড়েছে ৭৭ দশমিক ৩০ শতাংশ।

ব্যাংকের এমডিদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক প্রেসিডেন্ট মো. নূরুল আমিন বলেন, ব্যাংকগুলোর আমানতের বাইরেও পরিশোধিত মূলধন, বিভিন্ন বন্ড, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সংরক্ষণ করা সিআরআরসহ মোট মূলধন থাকে। এ থেকে আমানতের বাইরেও আরও ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ঋণ দেওয়া যায়, কিন্তু ৭৫ শতাংশ ঋণের প্রবৃদ্ধি স্বাভাবিক নয়। তিনি বলেন, বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে তারল্যের চাপ রয়েছে। আর এ কারণেই ব্যাংকগুলোকে সতর্কতার সঙ্গে ঋণ বিতরণ করতে হবে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে গত দুই বছরে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল ঋণ পরিশোধ না করলেও খেলাপি করা যাবে না। পাশাপাশি রেয়াতি সুদে গত দুই বছরে দুই লাখ কোটি টাকার উপরে প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় চলতি মূলধন হিসেবে ব্যবসায়ীদের ঋণ দেওয়া হয়। অপর দিকে মাত্র দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণ নবায়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে এক দিকে ব্যবসায়ীরা ঋণ নিয়েছেন, তাদের বড় একটি অংশ ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করেননি। অপর দিকে প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় যেসব ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল তার একটি অংশ চলতি মূলধন হিসেবে ব্যবহার না করে পুরনো ঋণ পরিশোধ করে। আর এ কারণেই প্রকৃত ঋণ পরিশোধ না হলেও কৃত্রিমভাবে ঋণ পরিশোধ করা হয়। এর প্রভাবে ব্যাংকগুলোর নগদ আদায় কমলেও ঋণপ্রবাহ বেড়ে যায়।

অপর দিকে মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে পড়ে সাধারণ আমানতকারীরা নতুন আমানত রাখতে পারছেন না। বিপরীতে অনেকেই অভাবের তাড়নায় পুরনো আমানত ভেঙে ফেলছেন। এর প্রভাবে আমানত প্রবাহ কমে গেছে।

ফলে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ সক্ষমতা যেমন কমে যাচ্ছে, তেমনি নগদ আদায় কমে যাওয়ায় তহবিল সংকটে ভুগছে অনেক ব্যাংক। নগদ আদায়ের শিথিলতা দেওয়ায় ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায় না হলেও তুলনামূলকভাবে খেলাপি ঋণ বাড়েনি। আর এ কারণে বাড়তি প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়নি। এর প্রভাবে কৃত্রিম মুনাফা বেড়ে গেছে। আর এ কৃত্রিম মুনাফার উপর ভর করেই নগদ ডিভিডেন্ড দিচ্ছে অনেক ব্যাংক। এ দিকে ডলার সংকটের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নগদ টাকা দিয়ে ডলার কেনা হচ্ছে। গত অর্থবছরে এমন ৭৫০ কোটি ডলার কিনতে হয়েছে ব্যাংকগুলোকে। বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে নগদ অর্থ চলে গেছে প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ব্যাংকগুলোর নগদ অর্থের টান পড়েছে। আর এ নগদ অর্থের সংকটের কারণেই কিছু কিছু ব্যাংক প্রতিদিনই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে হাত পাতছে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, চলমান অবস্থায় আমানত বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। তবে অনেকেরই আমানত সংগ্রহ করতে ৮ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেঁধে দেওয়া ঋণের সুদ হার সর্বোচ্চ ধার্য করতে পারছে ৯ শতাংশ। এখানেই বিপত্তি দেখা দিচ্ছে। আর এ অবস্থা চলতে থাকলে চলতি অর্থবছর শেষে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত আয় কমে যাবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫