
বর্ষণতিথি; এবেলা আরো উষ্ণ হোক
তোমার রূপালি ব্যর্থতার সংহতি
স্তব্ধতার দীর্ঘশ্বাস
হাওয়ায় ভেসে ভেসে কিছু সময় বাড়াক
নিঙড়ে আনতে- শ্রমতপ্ত মানুষের ভেতরের
সুগন্ধ ও ভাপ! (বর্ষণতিথি / ১১)
যারা কায়িক শ্রমে দুনিয়া গড়েন তাদের আলাদা একটা সৌন্দর্য আছে তা কবির চোখে এভাবেই ধরা পড়ে ‘বর্ষণতিথি’ কবিতাটিতে। মোস্তফা মহসীন শূন্য দশকের কবি, তার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘মননের মধু’ এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে উৎস প্রকাশন থেকে। ৪১টি কবিতা দিয়ে গড়া বইটির মূল্য ১৫০ টাকা।
ব্যক্তি আমি বরাবরই কবিতার বই এর রিভিউইয়ের বিরোধী কিন্তু কবি পাঠ প্রতিক্রিয়া জানাতে এই দূরদেশে আমাকে তাগদা দিয়েছেন, বেশ কয়েকবার। মোস্তাফিজ কারিগরের নান্দনিক প্রচ্ছদে চোখ থমকে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই , কবিতা সম্পর্কে প্রকাশক কর্তৃক লিখিত বয়ানে অগ্রসর হই। সেখানে খোদাই আছে, ভাষার গভীরে, শব্দের গভীরে যেসব জারিজুরি সেগুলো মস্তিস্ক আর হৃদয়ের যৌথতায় উপলব্ধি মোস্তফা মহসীনের বেশি পছন্দ। কবিতাগুলো ছাঁকতে থাকি আর ভাবি, আসলে কি তাই?
স্থলপথ-জলপথ-উড়োপথ
গৃহ ও অরণ্য, জনারণ্য-রাজপথ
সম্ভাবনা-সম্ভাষণ ছেঁয়ে যায় বঙ্গীয় বিরহ
আহা সবেধন বিগত বছর!
তমসার তীর ধরে হেঁটে খুন হলো বিত্তের সৌরভ (উড্ডয়নকাক্সক্ষা / ২৭)
প্রতিবছরই কর্তাদের নানা উন্নয়ন ইচ্ছায় আম জনতার আদতে কোন উন্নতি হয়না। উন্নয়ন কিচ্ছার ভেতরেই কিন্তু শেয়ার বাজার লুট হয়ে যায়। স্বপ্ন খুন হয়ে যায়। ৩৩ লাখ নি:শ্ব ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর ঈদ আনন্দ মাটি করে দেয় লুটেরা-তস্কর। তীব্রভাবে হতাশার গ্লানি ওঠে এসেছে উপরোক্ত কবিতার ভাষ্যে। তেমনি গুটিকয়েক কবিতায় আবার ধরা দিয়েছে আধুনিক মানুষের অস্তি¡ত্বের সংকট; অনিবার্য নিয়তি। সমকাল, ঘটনা এবং মানুষ।
সকালের দুর্বিপাক
বিকেলের মধ্যস্থতা
রাতে কুকুরের তাড়া
গেল বছর মহাজনের ঋণে
হারিয়েছি খাসজমি সঙ্গে
দুলতে থাকা কচি ধানের মাথা (ত্রাতা/১৯)
আমলার ঠোঁটে আজ সরকারি ফরমান
শর্ষের ভেতর ভূত না তাড়ায়ে
বলছে এবার
উচ্ছেদ হবেই
ফুটপাতে চলতি হকার! (ফুটপাত/৩১)
কিছু কবিতা ছন্দ আর লিরিক মাধুর্যের মূর্ছনায় শুনতে তৃপ্তিকর। কিছু কবিতায় পাওয়া যায় রোমান্টিক সত্যের কাছে সমর্পিত হবার চূড়ান্ত আবেদন, যাকে বইয়ের ফ্ল্যাপে বলা হয়েছে হৃদয়বৃত্তি। যেমন :
২০ ভেজা বিষাদতাড়িত নীল (স্বপ্ন ভেজাতেই কি
জীবনের সব সুখ?) তাকিয়েই দেখো, দেখো না-তোমার জন্যে রৌদ্রডানা মেলে
দিয়েছে কি সুন্দর দিন! জীবনের প্রতিবিম্ব হাতে রঙিন পোশাকে দাঁড়িয়েছে এক
রাজপুত্র। মগড়বচৈতন্যের তলদেশ থেকে জেগেছে চাঞ্চল্য। চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে
রক্তে, রক্ত থেকে স্নায়ু ...অলৌকিক তরঙ্গধারায়...
(ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট / ৮)
ঝাঁ-ঝাঁ রোদ...
তাড়িয়ে রাজ্যির গুমোট হাওয়া... আর
বুড়োদের চিন্তা-আগ্রাসন;
এই গ্রীষ্মে নিজেকে জেতাতে চাই
যৌথ আলিঙ্গন! ( রহস্যতালুক / ১২)
কবি কখনো তার পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বা পেশাকে উপজীব্য করেও আঁকেন নানা ছবি। প্রথম কবিতায় কবি যখন বলেন-
বাহ্! পৃথিবীটা অদ্ভুত সুন্দর!
কমার্শিয়াল এরিয়ায় উপযুক্ত মোয়াক্কেল খুঁজে-
মোস্তফা মহসীনের বয়সটাও বাড়ছে বুঝি? (দন্ডিত পুরুষ/৭)
এমনতরো উচ্চারণ আর বই এর ফ্ল্যাপে লেখা কবির আইনজীবি পরিচয় তাকে কিভাবে দৈনন্দিন যাপনের জন্য বয়সী করে তুলে তা যেন আমার এক লহমায় বুঝা হয়ে যায়। কবিতার ভালো-মন্দ, টিকে থাকার দায়িত্ব শেষমেশ পাঠকের হাতে। তবু এই পাথর সময় ,যানজট আর যন্ত্রদানবের সাথে পাল্লা দিয়ে কেউ যদি কবিতার ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয়ে শিল্পসৃষ্টি করেন, কিংবা মোহ ছড়ান তার পাঠকের ভেতরে , তাতে কার কী ক্ষতি? আরোপিত দুর্বোধ্যতা নেই, কেউ যদি সাবলীলতার সড়ক মাড়িয়ে আধৃুনিক কবিতার রহস্যময়তা ছুঁয়ে ফেলতে তৎপর হন, তবে তার ঝাঁপিতে ধরা দেবে ‘মননের মধু’ র রস! আমি আশাবাদী। বইটির পাঠকপ্রিয়তা কামনা করি।
ফসানা কিশোয়ার, লেখক এবং এক্টিভিস্ট। মানুষের মনে বই পড়ার প্রতি আগ্রহ তৈরীর জন্য বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন পঠিত বই এর রিভিউ দিয়ে আসছেন। বর্তমানে কানাডা প্রবাসী।