Logo
×

Follow Us

বাজেট ২০২০-২১

স্বাস্থ্য বাজেটে দুর্নীতির সুযোগ থাকছে

Icon

হামিম উল কবির

প্রকাশ: ২০ জুন ২০২০, ০৯:৩১

স্বাস্থ্য বাজেটে দুর্নীতির সুযোগ থাকছে

ছবি: স্টার মেইল

স্বাস্থ্য খাতে ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ দিয়ে চমক দেখাতে চেষ্টা করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। কিন্তু ব্যয়ের খাত সুনির্দিষ্ট করে উল্লেখ না করায় দুর্নীতির সুযোগ থেকেই যাচ্ছে। 

এবার স্বাস্থ্য খাতে আগের বছরের তুলনায় চার হাজার কোটি টাকা বেশি ব্যয়ের প্রস্তাব করেছেন তিনি। 

করোনাভাইরাসের কারণে স্মরণকালের ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে দেশ। এ বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার জন্য উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজন পর্যাপ্ত বরাদ্দ। ‘প্রস্তাবিত স্বাস্থ্য বাজেট পর্যাপ্ত নয়’- বাজেট ঘোষণার পরপরই অর্থনীতিবিদরা এ কথা বলেছেন।

করোনাভাইরাস মোকাবেলায় প্রয়োজন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার উন্নত ব্যবস্থাপনা; কিন্তু এ মহামারি উন্মুক্ত করে দিয়েছে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার দৈন্যদশা। উপজেলা পর্যায়ে তো বটেই জেলা হাসপাতালেও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নেই। একটু ক্রিটিক্যাল রোগী হলেই রাজধানীতে চলে আসতে হচ্ছে মানুষকে। ঢাকায় এলেই যে চিকিৎসা মিলছে, তা নয়। কয়েক হাসপাতাল ঘুরে হয়রান হয়ে রাস্তাতেই অনেকের মৃত্যু হচ্ছে।  

এবার স্বাস্থ্য খাতে ২৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। আগের বছর এ খাতে ২৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। থোক বরাদ্দ ১০ হাজার কোটি টাকা ঘোষণা করা হলেও প্রকৃত পক্ষে আগামী অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে মাত্র চার হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৫ হাজার কোটি টাকার স্বাস্থ্য বাজেট ছিল। তার মানে আগামী অর্থবছরের জন্য স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় থাকবে মাত্র ১৯ হাজার কোটি টাকা। করোনাভাইরাসের ব্যয় বাদ দিলে চলতি বছরের জন্য স্বাস্থ্যের ব্যয় আরো কমে গেল। আবার আগের বছরের চেয়ে যে চার হাজার কোটি টাকা বেশি বরাদ্দের ঘোষণা করা হয়েছে তার অর্ধেক আসবে বিশ্ব ব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ঋণ থেকে। এই দুই ব্যাংক মিলে দেবে প্রায় দুই হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা। 

তবে ১০ হাজার কোটি টাকা কোথায়, কীভাবে ব্যয় হবে- অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় এ বিষয়টির উল্লেখ নেই। থোক বরাদ্দেই দুর্নীতি বেশি হয়ে থাকে বলে অতীত ইতিহাসে দেখা গেছে। 

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাংলাদেশে দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের সর্বোচ্চ আক্রান্তের পর্যায়টি (পিক) আসেনি। এটা কখন হবে তাও বলা সম্ভব হচ্ছে না। করোনাভাইরাস যদি আগামী দিনগুলোতে আরো বড় বিপর্যয় সৃষ্টি করে, তাহলে তা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খরচ আরো বেশি বেড়ে যতে পারে।

স্বাস্থ্য খাতে চার হাজার কোটি টাকা বেশি বরাদ্দের পরও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট অন্যবারের মতোই গতানুগতিক। গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) বলেছে, ‘এটি কভিড-১৯ মোকাবিলার মতো বাজেট হলো না।’ 

প্রস্তাবিত বাজেট সম্বন্ধে সানেম আরো বলেছে, ‘প্রস্তাবিত বাজেটে জনস্বাস্থ্যের দিকটি উপেক্ষা করা হয়েছে।’ এবার বাজেটে ১৪ শতাংশ বরাদ্দ বেশি দেয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও চলমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রস্তাবিত বরাদ্দ ‘একেবারেই অপ্রতুল’ বলে অভিহিত করেছেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান। 

তিনি বলেন, ‘কভিড-১৯ মোকাবেলায় ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও একে মূল স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ হিসেবে গণ্য করাও কঠিন, এটা থোক বরাদ্দ। থোক বরাদ্দের ব্যয় নিয়ে তো প্রশ্ন থাকেই। এ বরাদ্দের ব্যবস্থাপনাগত দিকের উন্নয়ন পরিকল্পনার কথাও উল্লেখ করা হয়নি। দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও ব্যয় করার দক্ষতার অভাব কীভাবে দূর করা হবে তা অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যে নেই।’

প্রস্তাবিত স্বাস্থ্য বাজেটে ১০০ কোটি টাকা গবেষণা খাতে বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে। গবেষণা খাতে যত বেশি ব্যয় বাড়বে স্বাস্থ্য খাতে তত উন্নয়ন হবে। বর্তমানের স্বাস্থ্য বিভাগে শুধু ব্যয় করার যে প্রবণতা, তাতে গবেষণায় সংশ্লিষ্টদের তেমন মনোযোগ নেই। 

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘আমলানির্ভর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গবেষণাকে সব সময় উপেক্ষার চোখেই দেখা হয়। তারপরও গবেষণায় ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা ভালো উদ্যোগ; কিন্তু এই টাকা কীভাবে ব্যয় করা হবে, এর কোনো দিক-নির্দেশনা নেই অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অদক্ষতা, দুর্নীতি ও অপচয় একটি আলোচিত বিষয়। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের চেয়ে এই মন্ত্রণালয় স্থাপনা নির্মাণ, দামি মেশিন কেনা ও প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশ ভ্রমণে অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করে। আবার প্রতি বছরই বরাদ্দকৃত বাজেট ব্যয় করতে না পারায় ফেরত যাওয়ার ঘটনাও লক্ষণীয়।’ 

থোক বরাদ্দ ছাড়াও করোনাভাইরাসের বাইরে আরো ৫২৯ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদানের কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু এ টাকা কীভাবে ব্যয় করা হবে তাও বলা হয়নি। এছাড়া করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুজনিত কারণে বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের ক্ষতিপূরণ প্রদান ও চিকিৎসায় নিয়োজিত ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সম্মানীবাবদ ৮৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।

অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় করোনাভাইরাস মোকাবেলায় চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে দুই হাজার ডাক্তার ও ছয় হাজার নার্স নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলে জানান। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে ৩৮৬ জন মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট, দুই হাজার ৬৫৪ জন ল্যাব অ্যাটেন্ডেন্টসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ করা হয়েছে। এছাড়া রাজস্ব খাতে এক হাজার ২০০ মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট, এক হাজার ৬৫০ মেডিক্যাল টেকনিশিয়ান ও ১৫০ কার্ডিওগ্রাফারসহ মোট তিন হাজার নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়েছে বলেও অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতায় জানান। করোনাভাইরাস সংক্রমণ যাচাইয়ের জন্য একটি স্ক্রিনিং অ্যাপ ও এ ভাইরাস কমিউনিটি সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও ঝুঁকি কমানোর লক্ষ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন জাতীয় কভিড-১৯ ডিজিটাল সারভেইল্যান্স সিস্টেম প্রস্তুত করা হয়েছে। 

প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী থোক বরাদ্দ কীভাবে, কোথায় খরচ করা হবে এর কোনো উল্লেখ না করলেও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক নির্দিষ্ট করে কিছু খাতের উল্লেখ করেছেন। 

তিনি বলেন, ‘এই বরাদ্দে ব্যয়ের খাত ঠিক করতে হবে আগে। এর পর কোনটা আগে বাস্তবায়ন করতে হবে, তাও ঠিক করে নিতে হবে শুরু থেকেই। এই টাকার পুরোটাই গ্রামের মানুষের জন্য খরচ করতে হবে, কারণ বেশির ভাগ মানুষ গ্রামে থাকেন। প্রতিটি উপজেলা হাসপাতালে এই টাকায় অক্সিজেন, অক্সিজেন মাস্ক, ন্যাসাল মাস্ক, মুমূর্ষু রোগীদের পরিবহনের জন্য অ্যাম্বুলেন্স কেনায় ব্যয় করতে হবে। আবার প্রতিটি জেলা হাসপাতালে এই টাকায় আইসিইউ, ভেন্টিলেটর, অক্সিজেন মাস্ক, ন্যাসাল মাস্ক ও অক্সিজেন স্টোরিং করতে হবে।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘এই টাকা থেকে গ্রামের মানুষের জন্য হেলথ কার্ড সিস্টেম করতে হবে; যেন তারা কার্ড দেখিয়ে চিকিৎসা পান। এই টাকায় কোনো ভবন নির্মাণে ব্যয় করা যাবে না, ঢাকায় যথেষ্ট স্থাপনা অথবা চিকিৎসার আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি আছে। ঢাকায় এখন আর স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করার প্রয়োজন নেই। গ্রামের মানুষের শুধু কভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয় করতে হবে। এটাই সুযোগ, এই সুযোগে গ্রামে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি স্থাপন করতে ফেলতে পারলে অনেকের আর শহরে আসার প্রয়োজন হবে না, চাপ কমে যাবে ঢাকার হাসপাতালগুলোর। ফলে ঢাকার হাসপাতালগুলোর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জটিল রোগের চিকিৎসা করতে পারবেন মনোযোগ দিয়ে ও তারা গবেষণায়ও মনোযোগ দিতে পারবেন।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫