Logo
×

Follow Us

বাজেট ২০২১-২২

করোনার ক্ষতি পূরণে বরাদ্দ নেই

আবারও উপেক্ষিত শিক্ষা খাত

Icon

এম ডি হোসাইন

প্রকাশ: ১৩ জুন ২০২১, ০৮:৪৬

আবারও উপেক্ষিত শিক্ষা খাত

করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা খাত। ফাইল ছবি

জিডিপি অনুপাতে শিক্ষা খাতে স্বাভাবিকভাবেই বরাদ্দ বৃদ্ধির আশা করা হয়েছিল; কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে তা ব্যর্থ হয়েছে। এ খাতে জিডিপি অনুপাতে বরাদ্দের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম কম ব্যয়কারী দেশ এখন বাংলাদেশ। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা খাতে টাকার অঙ্কে বরাদ্দ কিছুটা বাড়লেও জিডিপিসহ সার্বিক হিসাবে তা কমেছে। 

করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা খাতের জন্য যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে, তা ক্ষতিপূরণের জন্য যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে ৩ জুন প্রস্তাবিত বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, পলিটেকনিক ও মেডিকেল কলেজগুলোর আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ দিকে ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতে ৩৭ হাজার ২৮১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা বিদায়ী অর্থবছরের চেয়ে ৩ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা বেশি। বিদায়ী অর্থবছরে এ খাতে ৩৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। এছাড়া কোভিড-১৯ হানা দেওয়ার পর দেশের অর্থনীতির জেরবার অবস্থা চললেও, সরকার তাদের অগ্রাধিকারমূলক ব্যয় থেকে সরে আসেনি। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে সর্বোচ্চ গতিতে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হয়েছেন। প্রায় দেড় বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে পারছে না সরকার। এতে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন শিক্ষার্থী। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির রেকর্ডসংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী পড়ালেখা থেকে ঝড়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, শিক্ষা কোনো ব্যবসা নয়। এটি সামাজিক সেবা। এ বাজেট যতখানি ব্যবসা সহায়ক, ততখানি শিক্ষা সহায়ক হয়নি। আমাদের দেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ এ সমস্ত খাতে আনুপাতিক হিসাবে বরাদ্দ এমনিতেই কম। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষা খাত যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাতে প্রচুর ব্যয় বাড়ানোর প্রয়োজন আছে। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেক শিক্ষার্থী পড়ালেখা ছেড়ে দিয়েছে ও দিচ্ছে। প্রযুক্তির অভাবে অনেক ছাত্র-ছাত্রী অনলাইনে ক্লাস করতে পারছে না। তাই শিক্ষা বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব বিভিন্ন মহল থেকে বাজেট ঘোষণার আগেও জানানো হয়েছিল। শিক্ষা খাতের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট ঠিক সমর্থনযোগ্য হয়নি।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, শিক্ষাব্যবস্থায় ‘পুনরুদ্ধার কার্যক্রম’ চালাতে যে বরাদ্দ প্রয়োজন ছিল, তা প্রস্তাবিত বাজেটে পাওয়া যায়নি। স্বাভাবিকভাবেই করোনা বিপর্যয়ের বিষয়টি মাথায় রেখে সরকার জীবন, জীবিকা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। শিক্ষায় গত দেড় বছরে যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে এবং চলেছে, সেই ক্ষতি থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারের মন্ত্রণালয়গুলোর পরিকল্পনা ছিল। সেই পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার জন্য যে বরাদ্দের প্রয়োজন, সেই প্রতিফলন এই বাজেটে হয়নি। শিক্ষা খাতের ক্ষতি পূরণে এই বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়নি। 

তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন খাতের জন্য বাজেটে নানা ধরনের কথা এসেছে। শিক্ষা ব্যবস্থা যে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে, তাতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান- এই চার দিক মাথায় রেখে প্রণোদনার ঘোষণা থাকা উচিত ছিল; কিন্তু সেটা হয়নি। এ বাজেটের ফলে জীবনও চলবে, জীবিকাও বাড়বে, কর্মসংস্থানও হবে; কিন্তু মানব সক্ষমতা বিনির্মাণে শিক্ষায় বিনিয়োগ যদি যথাযথ না হয়, তাহলে কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না। 

জানা যায়, শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯৪ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের ২১ শতাংশের বেশি। গেল অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ৮৫ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও, সংশোধনে তা ৭৮ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকায় নেমে আসে। আগামী অর্থবছরের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ২৬ হাজার ৩১১ কোটি টাকা, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগকে ৩৬ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগকে ৯ হাজার ১৫৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। আর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ২১ হাজার ২০৪ কোটি টাকা এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে ১৭২০ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। সব মিলিয়ে শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে বরাদ্দের অংক দাঁড়াচ্ছে মোট বাজেটের ১৫.৭ শতাংশের মতো, যা গত অর্থবছরের মূল বাজেটে ১৫.১ শতাংশ ছিল। অর্থাৎ, মোট বাজেটের অনুপাতে বরাদ্দ সেভাবে বাড়েনি। শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে যে বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, তা জিডিপির ২.৭৫ শতাংশ।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের শিক্ষা খাত জিডিপির ৬ শতাংশ বা বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ পেলে তা আদর্শ ধরা হয়। প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মোট পরিচালন ব্যয় ও উন্নয়নের জন্য ৩৭ হাজার ২৮১ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। প্রতিরক্ষা খাতের এ ব্যয় হবে এবারের মোট বাজেট বরাদ্দের ৬ দশমিক ২৪ শতাংশ। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিরক্ষা সার্ভিস পরিচালনের জন্য ৩৩ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা, উন্নয়নের জন্য ১ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা, অন্যান্য সার্ভিস পরিচালনের জন্য ১ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা এবং সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ পরিচালনের জন্য ৪৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে নতুন বাজেটে।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সারাবিশ্বেই প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট বেশি রাখা হয়। এটি বৈশ্বিক পরিবর্তনের একটি প্রতিচ্ছবি এবং রাষ্ট্র বনাম রাষ্ট্রের যে প্রতিযোগিতা তারই ফল। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ পরিমাণগতভাবে কিছুটা বেড়েছে। এটাও দেখার বিষয় যে, বাজেটের একটি বড় অংশ চলে যায় শিক্ষকদের বেতনের পেছনে। দেশের নতুন নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকের সংখ্যাও বেড়েছে। সুতরাং অতিরিক্ত যে বরাদ্দটা দেওয়া হলো, তা গুণগত কোনো কাজে আসবে না। এর ওপরে মুদ্রাস্ফীতির মতো বিষয় আছে। এভাবে দেখলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে বরাদ্দ কমেছে। বছরের পর বছর শিক্ষা খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ রাখার ফলাফলও আমরা দেখছি। জ্ঞান সূচকে ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২তম। আমাদের ওপরে নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, ভারত, পাকিস্তান সবাই। উচ্চ শিক্ষা খাত কিংবা প্রাথমিক শিক্ষার দিক থেকেও আমাদের অবস্থান আরও নিচে। বছরের পর বছর এই খাতে বরাদ্দ কম রেখে একটা বোকা জাতি বানানো হচ্ছে।

করোনার ক্ষতি পূরণে বরাদ্দ নেই 

শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দের কথা বলা হলেও, প্রস্তাবিত বাজেটে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের ক্ষতিপূরণে নির্দিষ্ট কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। ফলে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীরা হতাশা ব্যক্ত করেছেন। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা নিশ্চিত করা ও দক্ষ বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা প্রসারে নজর দেওয়ার কথা জানিয়েছেন। বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেন, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার শিক্ষা খাতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে প্রাধান্য দেব ও গুরুত্ব অনুযায়ী প্রয়োজনীয় বরাদ্দও রাখছি। পাশাপাশি ব্যয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও তা পরিবীক্ষণের দিকেও আমরা গুরুত্ব দেবো। 

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী, স্কুলের প্রতি শিক্ষার্থীকে বছরের শুরুতে কিট অ্যালাউন্স (ড্রেস, জুতা ও ব্যাগ) বাবদ প্রাথমিকভাবে ১ হাজার টাকা এবং উপবৃত্তির মাসিক হার ১০০ টাকার পরিবর্তে ১৫০ টাকা প্রদান করতে এবার বাড়তি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ জন্য বর্তমান অর্থবছরে ৩ হাজার ৭১২ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছি আমরা, যার মধ্যে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা কিট অ্যালাউন্স বাবদ এবং অবশিষ্ট টাকা উপবৃত্তি বাবদ ব্যয় হচ্ছে। 

অর্থমন্ত্রী আরও জানান, পর্যায়ক্রমে দেশের সব উপজেলার সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চালু করার লক্ষ্যে জাতীয় স্কুল মিল নীতিমালা অনুযায়ী আগামী জুলাই থেকে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদে ‘প্রাইমারি স্কুল মিল প্রকল্প’ শীর্ষক নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।

বাজেট বক্তৃতায় আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, শিক্ষা ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বৈষম্য কমিয়ে আনার অংশ হিসেবে হাওর এলাকায় নির্ধারিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলতি অর্থবছরে শুরু করা হয়েছে, যা আগামী অর্থবছরেও অব্যাহত থাকবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা নিশ্চিতে ২০২১-২২ অর্থবছরে ২.১০ লাখ শিক্ষককে এবং আইসিটি বিষয়ে ২.৭৫ লাখ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ প্রদান করবে সরকার। 

মন্ত্রী বলেন, নির্ধারিত বেসরকারি কলেজগুলোর উন্নয়ন আরও ১৬০টি উপজেলায় আইসিটি ট্রেনিং ও রিসোর্স সেন্টার স্থাপন এবং সমন্বিত শিক্ষা তথ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি প্রণয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। সরকারি কলেজে বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণে প্রকল্প ও সারাদেশে ৩২৩টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সক্ষমতা ও শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধির লক্ষ্যে কার্যক্রমের বাস্তবায়ন চলমান রয়েছে। এতে কলেজ পর্যায়ে অতিরিক্ত প্রায় ২ লাখ ও মাধ্যমিক পর্যায়ে অতিরিক্ত ৩.২৯ লাখ শিক্ষার্থীর ভর্তির সুযোগ সৃষ্টি হবে। 

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী জয়নুল ইসলাম বলেন, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের ক্ষতিপূরণে কোনো ধরনের প্রণোদনা ও ঋণের ব্যবস্থা রাখা হয়নি প্রস্তাবিত বাজেটে। এতে হতাশ হয়েছেন তারা।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫