
আ হ ম মুস্তফা কামাল
বাংলাদেশের সরকার নিজেদের মতো করে দেশকে এখন আর এনডিসি কান্ট্রি মনে করছেন না। তারা ‘উন্নয়নশীল’ বলছেন। কেউ কেউ ‘উন্নত দেশ’ বলেও পুলক পেতে চাইছেন। তা তারা চাইতেই পারেন; কিন্তু একটা দেশ কতটা উন্নতি করল তার মাপকাঠি কী? বাংলাদেশের সরকার বড় বড় ভবন, সেতু নির্মাণ আর ভিজিএফ কার্ডের মাধ্যমে কিছু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে অনুদান দেওয়াটাকেই উন্নয়নের মাপকাঠি ধরেন। ‘দেশে এখন আর কেউ না-খেয়ে মরছে না’! এটা যদি শাসকদের অর্জন ধরে নিতে হয়, তাহলে এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু নেই। একটা দরিদ্র দেশেও কেন মানুষ না-খেয়ে মরবে? তাই যদি হয় তাহলে তাদেরকে উন্নয়ন করতে কে বলে?
যাই হোক, এবারের জাতীয় বাজেটকে তারা যুগপোযোগী, দরিদ্রবান্ধব, অর্থনীতির গতি বৃদ্ধিকারী বলে অভিহিত করেছেন। কেন এই উচ্চাভিলাষ? কারণ বাজেট হোক আর যে কোনো গণবিরোধী সিদ্ধান্তই হোক, সংসদে এসবের কোনো চ্যালেঞ্জ নেই। সমালোচনা নেই। যে ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দল আছে, তারা মিউ মিউ করে বিরোধিতা জারি রাখার কারণে ক্যামেফ্লজ করে। সংসদে দাঁড়িয়ে বিরোধিতার নামে মিকিমাউস গেম খেলে।
যথারীতি অর্থমন্ত্রী বাজেট নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। যেটা সব আমলের অর্থমন্ত্রীরা করে থাকেন। মহামারির বাস্তবতার পাশাপাশি দক্ষতার সংকটের বিষয়গুলো তুলে ধরে নতুন অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে বিভিন্ন মহল সংশয় প্রকাশ করলেও, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আশাবাদী। তিনি যখন আশাবাদী, তখন দেশের আর কেউ তো নিরাশার কথা শোনাতে পারেন না! সেটা হবে ‘দ্রোহিতা’।
তিনি বলেছেন, ‘অতীতের ধারাবাহিকতায়’ অর্থনীতির শক্তিশালী সূচকগুলোতে ভর করে এবারও বাজেট ‘সফলভাবেই’ বাস্তবায়িত হবে বলে তার বিশ্বাস। অতীতের ধারাবাহিকতা কী? ব্যর্থতা। নির্ভেজাল ব্যর্থতা। অতীতে বরাবরই একটি বিষয়ে তারা ‘সফল’-বাজেট ঘাটতির টাকা পূরণ করবার জন্য হতদরিদ্র মানুষের ‘গলা কেটে’ হলেও কর আদায় করা। ভ্যাট আদায় করা। নিত্যনতুন করারোপ করা। ভ্যাটের হার বৃদ্ধি করা। করমুক্ত পণ্যের তালিকা ছোট করে আনা। সাধারণ মানুষের রুটি-রুজির ওপর প্রত্যক্ষ জুলুম করা। অবশ্যই দেশের বিজনেস টাইকুনদের, মাফিয়া বিজনেস গ্রুপগুলোকে নির্বিঘ্নে হাজার হাজার কোটি কালো টাকা ‘সাদা’ করার সুযোগ দেওয়া।
এই বাজেট বাস্তবায়ন করতে গেলে বরাদ্দের পুরো অর্থের এক-তৃতীয়াংশ সরকারকে ঋণ করতে হবে। মহামারির ধাক্কা সামলে অর্থনীতির চাকা পুরোপুরি সচল করা না গেলেও, অর্থমন্ত্রী ৭ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির আশা করছেন। এই যে এক-তৃতীয়াংশ ঋণ করতে হবে, সেটার সুদ কে দেবে? তস্য সুদ কে দেবে? সেই সাধারণ জনগণই তো দেবে। আর ওদিকে আমলাদের এক একজনের বেতন-ভাতা বেড়ে ৬ লাখ সাড়ে ৬ লাখ হয়ে যাবে।
এটা স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, এবারের বাজেটে দেশীয় শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য কিছু ভালো উদ্যোগের কথা বলা হলেও, মহামারি পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও সামাজিক সুরক্ষায় যে পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন ছিল, তা অনুপস্থিত। মহামারিকালের বাজেটে সংকট উত্তরণের দিশা নেই। একদিকে যখন মহামারি মোকাবেলার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট নেই, তখন মহামারির কারণে টানাটানির এই সময়ে ৭ দশমিক ২ জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা কি বাস্তবসম্মত? রেকর্ড ঘাটতির এই বাজেট কতটা বাস্তবায়নযোগ্য? অর্থমন্ত্রী রাজস্ব আহরণ ও ব্যয়ের ভারসাম্য কীভাবে করতে চান? এসবের উত্তরও সাধারণ মানুষের জানা আছে। এসব ক্ষেত্রে সরকারের ইনস্ট্যান্ট ব্যাখ্যা থাকে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
বাজেটে কর্মসংস্থান নিয়ে ‘স্পষ্ট বক্তব্য নেই’ বলে যে সমালোচনা হচ্ছে, তার জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এবারের বাজেটে ব্যবসায়ীদের জন্য, বিনিয়োগের জন্য ‘প্রচুর সুযোগ’ সৃষ্টি করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশে নতুন নতুন ব্যবসার সম্প্রসারণ হবে, তাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এই বক্তব্যের পর আমরা স্মরণ করতে পারি-গত এক বছরের প্যানডেমিকের কারণে দেশের প্রায় সব শিল্প প্রতিষ্ঠানের ৬০ থেকে ৭০ ভাগ শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়েছে। সাড়ে চার হাজার গার্মেন্টস কারখানা থেকে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ ভাগ শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে। আন্তর্জাতিক তথ্য মতে, এই প্যানডেমিকে বাংলাদেশেই প্রায় দেড় কোটি মানুষ বেকার হয়ে গেছে। তার পরও অর্থমন্ত্রী বা সরকারের মুখপাত্ররা উন্নয়নের জজবা দেখেন। বিনিয়োগের জন্য ‘প্রচুর সুযোগ’ দেখেন!
অথচ বাস্তবতা হচ্ছে- চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ৬ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কীভাবে অর্জিত হবে, সেই সম্পর্কে কোনো দিক-নির্দেশনা নেই বাজেটে। আবার ২০১৯-২০ অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়েনি এবং ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো প্রণোদনা পায়নি। রাজস্ব আহরণে দুর্বলতা রয়েছে। সরকারি ব্যয়ও কম এবার। আর স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বাস্তবায়ন ২৫ শতাংশ, যা একেবারেই আকাঙ্ক্ষিত নয়। যে বছরে ব্যয় বেশি হওয়া দরকার, সে বছরেই কিনা বাজেট সম্প্রসারণমূলক না হয়ে এর পরিবর্তে সংকোচনমূলক হয়েছে। এটা বিস্ময়কর!
গত বছর শুধু তৈরি পোশাক খাতের জন্য আলাদা করে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ঋণ প্রণোদনা দিয়েছিল সরকার। বৃহৎ শিল্পের জন্য মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৪০ হাজার কোটি টাকার। সরকারের প্রণোদনা আর রফতানিতে গতি ফিরেছে বলা হচ্ছে; কিন্তু এই স্বস্তি এখনো আসেনি। দরিদ্র ব্যবসায়ীদের ব্যবসায় গতি ফেরেনি। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা করোনাকালীন প্রণোদনার তালিকায় নেই। কুটির, ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প খাতের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও দরিদ্ররা তার নাগাল পাননি। অথচ হওয়া উচিত ছিল তৈরি পোশাক খাতের জন্য প্রণোদনা না দিয়ে এই দরিদ্র ক্ষুদে ব্যবসায়ীদের পায়ের ওপর দাঁড়াতে সাহায্য করা; কিন্তু ভুক্তভোগীরা বাজেটে আলাদা কিছু প্রত্যাশা করেন না। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সরকার কোনো প্রণোদনা দেবে, তেমন সম্ভাবনা নেই, তার অবকাঠামোও নেই; এমন বাস্তবতা। বৃহৎ, মাঝারি বা ক্ষুদ্র; নতুন বাজেটে কোনো ধরনের উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের প্রতি সরকারের বেশি মনোযোগ প্রয়োজন? বাজেটে তাদের জন্যই বেশি মনযোগ থাকা উচিত, যারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। এটা একটা সাধারণ বিষয়। ব্যবসার দিক থেকে দেখতে গেলে যারা বেশি ক্ষুদ্র তাদের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হয়েছে, ছাঁটাই করতে হয়েছে কর্মীদের, ব্যবসার আকার ছোট করতে হয়েছে। সুতরাং সে দিকেই মনোযোগটা দেওয়া উচিত। এটা বোঝার জন্য তো রকেট সায়েন্স পড়তে হয় না!