
রাজধানী মালিবাগের এক পাইকারি দোকান থেকে তোলা ছবি। ছবি: সংগৃহীত
কোনো মতেই ভোগ্যপণ্যের বাজারে স্বস্তি ফেরাতে পারছে না সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে যতই পণ্যমূল্য নির্ধারণ দেওয়া হোক না কেন আদৌতে তা বাস্তবায়িত হয় না। দফায় দফায় দাম বেড়ে চড়া মূল্যে দিশাহারা হয়ে পড়েছে দেশের সাধারণ মানুষ। পণ্যমূল্যের আগুনে পুড়ছে নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্তরা।
আজ শনিবার (১১ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর কয়েকটি বাজার সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করতে গেলে এই প্রতিবেদকের কাছে এভাবেই নিজেদের মত তুলে ধরেন সাধারণ মানুষ।
আজ সকালে রাজধানীর বাসাবোর কাঁচাবাজারে বাজার করতে আসা স্থানীয় মো. গোলাম মোস্তাফা বলেন, সপ্তাহ দুয়েক আগেও প্রতি কেজি ব্রয়লারের দাম ছিল ১৫৫-১৬০ টাকা, এখন দাম হয়েছে ২২০-২৩০ টাকা। অর্থাৎ মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে বেড়েছে ৬০-৭০ টাকা। একইভাবে সোনালি মুরগিতে দাম বেড়েছে কেজিতে ৫০-৬০ টাকা, দেশি মুরগিতে বেড়েছে ৮০-১০০ টাকা, আর ডিমের ডজনে বেড়েছে ২০-২৫ টাকা। শবেবরাত ও রোজা যতই এগিয়ে আসছে গরুর মাংসের দামও বাড়ছে লাফিয়ে। ইতিমধ্যে কেজিতে প্রায় ১০০ টাকা বেড়ে গেছে গরুর মাংসের দাম। এভাবে কোনো পণ্যের দাম বাড়লে মানুষ তো খেয়ে বাঁচতে পারবে না। খাওয়ার অভাবেই মানুষের মৃত্যু হবে। করোনা আর কত ভয়াবহ। ক্ষুধা তার চেয়ে বেশি ভয়াবহ।
তিনি আরও বলেন, মাংসের বাজারের মতোই এবার উত্তাপ লেগেছে মাছের বাজারেও। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে সব ধরনের মাছের দাম বেড়েছে ৫০-২০০ টাকা পর্যন্ত। গরিবের আমিষ খ্যাত পাঙ্গাশ মাছ, তেলাপিয়া মাছের কেজিও এখন ২০০ টাকা ছাড়িয়ে ২৫০ টাকায় ঠেকেছে। অন্যান্য মাছও এখন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে।
রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রধান খাদ্যপণ্য চালের দামও নতুন করে বেড়েছে কেজিতে ২-৩ টাকা। আটা-ময়দার বাজার আগের মতোই এখনও টালমাটাল। আদা-রসুনসহ গরম মসলার বাজারও এখন আগের চেয়ে অনেক গরম। বাজারে এখন টাকা দিয়েও চিনি মিলছে না। দফায় দফায় দাম বাড়িয়ে মিলমালিকরা নিজেরাই বাজারে চিনির সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন। এতে চিনির বাজারে এক রকম হুলুস্থুল কারবার চলছে। সয়াবিন তেলসহ ভোজ্য তেলের বাজারে যে যার মতো দাম হাঁকিয়ে ক্রেতার পকেট খালি করছে। এভাবে বাজারে প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়তে বাড়তে ইতিহাসের রেকর্ড মূল্যে পৌঁছেছে।
বিক্রেতারা চাষের মাছ আগের সপ্তাহের চেয়ে কেজিপ্রতি ২০-৫০ টাকা বেশি দরে বিক্রি করেছেন। ইলিশ বা অন্যান্য নদ-নদীর মাছের দাম কেজিতে ১০০ টাকা এবং কিছু ক্ষেত্রে তারও বেশি বেড়ে গেছে। স্বল্প আয়ের মানুষের ক্রয়তালিকার ফর্দে নিয়মিত জায়গা পাওয়া চাষের পাঙ্গাশের দাম ১৫০-১৬০ টাকা থেকে বেড়ে এখন ২০০ টাকা পর্যন্ত লাগছে। আগে ১৮০ টাকার মধ্যে থাকা তেলাপিয়া কিনতে লাগছে ২৫০ টাকা পর্যন্ত। চিংড়ি বিক্রি হচ্ছে প্রজাতি ভেদে ৬০০-১০০০ টাকা কেজি করে, যা দুই সপ্তাহ আগেও ছিল ৫০০-৮০০ টাকা। রুই, কাতলা, মৃগেলসহ কার্প জাতীয় মাছের দাম গত সপ্তাহের তুলনায় ৪০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে ৩৪০-৩৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে ৫০০ টাকার কমে মিলছে না দেশি টেংরা, শিং কিংবা বোয়াল মাছ। গত সপ্তাহে ৬৫০ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা এসব মাছের দাম উঠেছে ৮০০ টাকা পর্যন্ত।
বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, রোজা আসছে, এরপর ঈদ। কিন্তু ডলার সংকটে মসলা আমদানি বিঘ্নিত। ভবিষ্যৎ চাহিদা পূরণ নিয়ে অনিশ্চয়তা। এই অবস্থায় দাম ধীরে ধীরে বাড়ছেই। ৩৫০ টাকা কেজি পর্যন্ত উঠে যাওয়া আমদানি করা আদা এখন বাজারে পাওয়াই কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে দাম বাড়ছে দেশি আদার। ১৪০-১৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি হওয়া আদা এ সপ্তাহে ১৮০ টাকার কমে মিলছে না। আমদানি করা রসুন কিনতে গুনতে হচ্ছে ১৮০-২০০ টাকা পর্যন্ত। শুকনা মরিচের দাম আগের মতোই ৪০০-৫০০ টাকা কেজি।
শীতের বেশিরভাগ সবজির দাম জানুয়ারির মাঝামাঝিতে কিছুটা বাড়ার পর থেকে সেই দামেই স্থিতিশীল আছে। তবে বাজারে দাম বাড়তি গ্রীষ্মের আগাম সবজি পটোল, ঢেঁড়স ও করলার। মানভেদে কেজিপ্রতি ১০০-১৫০ টাকার নিচে সেগুলো পাল্লায় উঠছে না।
ফার্মের মুরগির ডিমের দাম ডজনপ্রতি ১৫০-১৫৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। পাড়া-মহল্লার দোকানগুলোতে বিক্রি হচ্ছে আরও ৫-১০ টাকা বেশি দামে। প্রতি হালি ডিম কোথাও কোথাও ৬০ টাকা দরে বিক্রি করতেও দেখা গেছে। হাঁসের ডিমের ডজন এখনও ২১০-২২০ টাকা।
বেড়েছে শীতের সবজির দাম। কয়েক দিন আগেও ৩০ টাকা পিস দরে বিক্রি হওয়া ফুলকপি ও বাঁধাকপি বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা হিসেবে। কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে শিম বিক্রি হচ্ছে ৪০-৫০ টাকা কেজি দরে। অপ্রত্যাশিত হারে বেড়েছে লাউয়ের দাম। মাঝারি আকারের একেকটি লাউ কিনতে ক্রেতাকে গুনতে হচ্ছে ৬০-৮০ টাকা পর্যন্ত। লাউ শাকের আঁটিও ৩০-৪০ টাকা। কাঁচা মরিচের কেজি ১২০ টাকা। একই দাম টমেটোর। শালগমের কেজি ৩০-৪০ টাকা। একই দামে বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজ পাতা, পেঁপে।
বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৬০-৭০ টাকা কেজি দরে, টমেটো ৫০-৬০ টাকা, শিম ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। চাল কুমড়ার পিস ৪০-৬০ টাকা, আকারভেদে লাউ বিক্রি হচ্ছে ৬০-৮০ টাকায়। এ ছাড়া চিচিঙ্গা, পটোল ও ঢেঁড়স বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা কেজি দরে। কচুর লতি কিনতে কেজিপ্রতি গুনতে হচ্ছে ৬০-৮০ টাকা। একই দর বরবটিরও। আলুর কেজি ২৫-৩০ টাকা। পেঁয়াজ ৪০-৫০ টাকা।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের ক্রেতা সজীব সরকার বলেন, শীতের এই সময় প্রতি বছর সবজির দাম কম থাকে। অথচ এবার চিত্র ঠিক তার উল্টো। ব্যবসায়ীরা সাধারণ মানুষের পকেট খালি করার জন্য যে যার ইচ্ছেমতো জিনিসপত্রের দাম বাড়াচ্ছে। অথচ যেন দেখার কেউ নেই।