
বাংলাদেশ ব্যাংক। ছবি: সংগৃহীত
নানা অজুহাতে বেশ কয়েক বছর ধরে প্রভাবশালী ও বড় অঙ্কের ঋণগ্রহীতারা ব্যাংকের ঋণের কিস্তি ফেরত দিচ্ছেন না। এর মধ্যে অর্থনীতিতে চলছে নানামুখী সংকট। এতে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ার কথা। কিন্তু গত বছরের শেষ তিন মাসে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১৪ হাজার কোটি টাকা কমে গেছে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আদায় ভালো হলে খেলাপি ঋণ কমার কথা। কিন্তু আদায়ও কম হয়েছে আবার খেলাপি ঋণও কমেছে। এর মূল কারণ নানামুখী ছাড় সুবিধা ভোগ করছেন ঋণগ্রহীতারা। এতে প্রকৃত খেলাপি ঋণের তথ্য সাময়িক সময়ের জন্য আড়াল করা যাচ্ছে। কিন্তু এই গোপন রাখার কৌশল ব্যাংকিং খাতকে দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি প্রান্তিকে ব্যাংকগুলোর ঋণ ও খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ করে। সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। আগের তিন মাস (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ৩০ সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র তিন মাসে খেলাপি ঋণ কমেছে ১৩ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, কয়েক বছর ধরে খেলাপি ঋণ আদায়ের তুলনায় ছাড় সুবিধা দিতে মনোযোগ বেশি দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। ফলে ঋণগ্রহীতারা তার সুযোগ নিচ্ছেন। এর ফলে খেলাপি ঋণের যে চিত্র ফুটে উঠছে এটা প্রকৃত চিত্র নয়। খেলাপি ঋণের সমস্যা দিন দিন প্রকট হচ্ছে। মূলত এটা একটা গাণিতিক হিসাব। শেষ প্রান্তিকে খেলাপি কমা মূলত ব্যালান্স শিট ভালো দেখানোর জন্য। এটা যদি সবসময় কমতে থাকে, তাহলে এ খাতের জন্যই ভালো।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডিসেম্বর-কেন্দ্রিক বাৎসরিক হিসাবে ব্যবসায়ীরা খেলাপি থাকতে চান না। বছরের শেষ প্রান্তিকে ব্যাংকগুলো ব্যালান্স শিট ভালো দেখাতে খেলাপি ঋণ আদায়ে জোর দেয়। ফলে প্রতিবছরের শেষ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ কমে যায়। তবে খেলাপি ঋণ কমার মূল কারণ আদায় নয়, নানা ছাড় সুবিধা। আগের ছাড় সুবিধা বছরের শুরুতে তুলে নেয়ার পর ধারাবাহিকভাবে খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকে।
গত বছর ঋণের কিস্তির ৭৫ শতাংশ অর্থ জমা দিলে খেলাপি মুক্তির সুযোগ ছিল। কিন্তু তাতেও খেলাপি ঋণ না কমায় পরে খেলাপিদের সুবিধা আরও বাড়িয়ে দেয়া হয়। এ সুবিধার ফলে ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে যারা ঋণের কিস্তির ৫০ শতাংশ অর্থ জমা দিয়েছেন; তারা কেউ খেলাপি হননি। এত সুবিধা গ্রহণের পরও বছরভিত্তিক হিসেবে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৭৮৮ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা; যা বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। অর্থাৎ উচ্চ খেলাপির ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ব্যাংক খাত। কারণ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, খেলাপি ঋণের হার সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ সহনীয় বলে ধরা হয়।
২০২১ সালে ব্যাংক খাতে ঋণস্থিতি ছিল ১৩ লাখ ১ হাজার ৭৯৭ কোটি ২৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয় ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৩ কোটি ৭৮ লাখ টাকা; যা বিতরণ করা ঋণের ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৭ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা।
২০১৮ থেকে ২০২২ সাল- এ পাঁচ বছরে সবচেয়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে গত বছর। ২০২২ সাল শেষে খেলাপির অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা; যা ২০২১ সালে ছিল ১ লাখ ৩ হাজার ২৭৪ কোটি টাকা। একইভাবে ২০২০ সালে খেলাপির অঙ্ক ছিল ৮৮ হাজার ৭৩৪ কোটি, ২০১৯ সালে খেলাপি ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি এবং ২০১৮ সালে খেলাপি ছিল ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণের বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংকগুলো ঋণগ্রহীতাদের বছরের শেষ প্রান্তিকে চাপ দেয়। ব্যালান্স শিট ভালো দেখানোর জন্য তাদের ঋণ শোধ করতে বলে। ফলে ব্যবসায়ীরা কিছু টাকা ফেরত দেন। এতে শেষ প্রান্তিকে খেলাপি কিছুটা কমে। তবে খেলাপি ঋণ বাড়ার যে প্রবণতা, সেটা এখনো খারাপ পর্যায়ে আছে। কারণ বছর বছর খেলাপি ঋণ বেড়েই চলছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ব্যাংক খাতের মোট খেলাপি ঋণের ৫৬ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকে। বেসরকারি ব্যাংকে ৫৬ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা, বিদেশি ব্যাংকে ৩ হাজার ৪৮ কোটি টাকা এবং বিশেষায়িত ব্যাংকে ৪ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা।
আর ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর পরিমাণের দিক দিয়ে খেলাপি ঋণের শীর্ষ পাঁচ ব্যাংকের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকই চারটি। চার ব্যাংকের খেলাপি ৪৮ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে অগ্রণী ব্যাংকের ১৪ হাজার ৮১০ কোটি, জনতার ১৪ হাজার ৩৮৭ কোটি, সোনালীর ১২ হাজার ৫ কোটি এবং বেসিক ব্যাংকের ৭ হাজার ৬০৪ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ কমাতে অনেক দিন ধরে কাজ করছি। বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে ঋণ পরিশোধের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। গ্রাহকদের ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে নীতি সহায়তাও দেয়া হয়েছে। এসব নীতি সহায়তার কারণে খেলাপি ঋণ শেষ প্রান্তিকে কিছুটা কমেছে।
এদিকে খেলাপি ঋণ বেশি থাকা ব্যাংকগুলোতে আমানতকারীদের অর্থ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। কারণ ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় প্রভিশন রাখতে পারেনি। গত বছরের ডিসেম্বর প্রান্তিকে সরকারি-বেসরকারি আট ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৪৭ কোটি টাকা। তবে কয়েকটি ব্যাংক প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত প্রভিশন সংরক্ষণ করায় পুরো ব্যাংক খাতের ঘাটতি ১১ হাজার ৯ কোটি টাকা।
নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোর প্রদত্ত ঋণের গুণমান বিবেচনায় নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ প্রভিশন হিসেবে জমা রাখতে হয়। কোনো ঋণ শেষ পর্যন্ত মন্দ ঋণে পরিণত হলে তাতে যেন ব্যাংক আর্থিকভাবে ঝুঁকিতে না পড়ে, সেজন্য এ প্রভিশন সংরক্ষণের নিয়ম রাখা হয়েছে। ব্যাংকের নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। নিম্ন বা সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কু-ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়।
ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকে আমানতের নিরাপত্তা কম। কোনো কারণে ব্যাংক বন্ধ করতে বাধ্য হলে ওই ব্যাংক থেকে ঘাটতি থাকা টাকা আমানতকারীদের ফেরত দেওয়া সম্ভব নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত তিন ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ১১ হাজার ৭৭২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে বেসিক ব্যাংকে ঘাটতি ৪ হাজার ৫৩৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। সেপ্টেম্বরে এ ঘাটতি ছিল ৪ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা। অগ্রণী ব্যাংকের ঘাটতি ৪ হাজার ৪২২ কোটি ১৫ লাখ টাকা। সেপ্টেম্বরে ছিল ৩ হাজার ৫২১ কোটি টাকা। সরকারি ব্যাংকের মধ্যে তালিকায় তৃতীয় স্থানে রয়েছে রূপালী। দুই হাজার ৮১৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে ব্যাংকটি। সেপ্টেম্বরে রূপালীর ঘাটতি ছিল ৩ হাজার ১৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। ব্যাংকটির ঘাটতি কিছুটা কমেছে।
বেসরকারি চার ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি সাত হাজার ২৭২ কোটি টাকা। নানা সমস্যায় জর্জরিত ন্যাশনাল ব্যাংকের ঘাটতি সবচেয়ে বেশি। বেসরকারি খাতের এ ব্যাংকটির প্রভিশন ঘাটতির অঙ্ক ৬ হাজার ৬১৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা। আগের প্রান্তিকের তুলনায় ঘাটতি কিছুটা কমেছে। সেপ্টেম্বর এ ঘাটতি ছিল ৭ হাজার ৪৭৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ঘাটতি ৩৪৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা। সেপ্টেম্বরে ছিল ৩৪৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ঘাটতি ১৭১ কোটি ১৬ লাখ টাকা। সেপ্টেম্বরে ছিল ১৭১ কোটি ১৫ লাখ টাকা। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ১৩৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এ ব্যাংকের সেপ্টেম্বরে ৪৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ঘাটতি ছিল। এছাড়া বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের (বিকেবি) প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ তিন কোটি ৩৬ লাখ টাকা।
সামগ্রিকভাবে ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ৮৪ হাজার ১৫৭ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। কিন্তু সংরক্ষণ করা হয়েছে ৭৩ হাজার ১৪৮ কোটি টাকা। ফলে ব্যাংক খাতের সার্বিকভাবে নিরাপত্তা সঞ্চিতির ঘাটতির পরিমাণ ১১ হাজার ৯ কোটি টাকা।