‘সামনে ভর্তা-ভাত জুটবে কি না সেটা নিয়েই চিন্তা’

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১১ মার্চ ২০২৩, ১১:০২

আবর্জনার স্তূপে কুমিয়ে পাওয়া ডাবে পানি আছে কি না দেখছে এক শিশু। ছবি: সংগৃহীত
কয়েক বছর পেরিয়ে গেছে খাসির মাংস কেনেন না গনি মিয়া। ছয় মাস হলো গরুর মাংস কেনেন না। এখন থেকে মুরগির মাংস আর কেনা হবে না তার। কারণ সংসারের খরচ চালাতে খাবি খেতে হচ্ছে পেপার বিক্রেতা গনি মিয়াকে। দুই ছেলে, দুই মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে ছয়জনের সংসার তার। পেপার বিক্রি করে যে টাকা পান তা দিয়ে ২৬০ টাকা কেজি ধরে ব্রয়লার মুরগি কেনার চিন্তা করা আকাশ কুসুম চিন্তা।
এই প্রতিবেদকের কাছে এভাবেই নিজের আক্ষেপের কথা বলেন পেপার বিক্রেতা গনি মিয়া।
তিনি বলেন, পণ্যমূল্য বৃদ্ধির হার অস্বাভাবিক। এতো দাম দিয়ে নিত্যপণ্য কেনার সামর্থ্য দিনদিন কমে আসছে। এখন তো নসিব থেকে মুরগির মাংসও হারিয়ে গেছে। যেভাবে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে এই গতি অব্যাহত থাকলে মাছও নসিব থেকে উঠে যাবে। সামনে ভর্তা-ভাত জুটবে কি না সেটা নিয়ে চিন্তায় আছি।
তার স্ত্রী সুমাইয়া খাতুন বলেন, ৭৫০ টাকা দিয়ে গরুর মাংস, ২৬০ টাকা দিয়ে মুরগির মাংস কেনার সামর্থ্য আমগো নাই। সপ্তাহে ৫ দিন তিন সবজি, ডাল এবং আলুভর্তা দিয়ে চলে যায়। বাকি দুই দিনের একদিন পাঙাশ মাছ, অন্যদিন ব্রয়লার মুরগি রান্না করতাম। গত এক মাস ধরে পাঙাশ মাছ ও ব্রয়লার মুরগিও বন্ধ। জিনিসপত্রের দাম বাইরা গেছে অতিরিক্ত। না কুলাতে পারলে আর কি। নসিবে মাংস নাই। ঝোল দিয়াই স্বাদ মিটাই পোলাপানের।
গনি মিয়া বলেন, চার সন্তানের বড় দুজনকে বোঝানো গেলেও ছোট ছেলে ও মেয়ে মাংস খাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করে। এখন আর ব্রয়লার কেনারও সামর্থ্য নেই। তাই এখন মুরগির পা, গিলা কিনে আনি সপ্তাহে এক দিন। প্যাকেটে ভরার আগে দুই টুকরা মাংসের পিছ দিতে বলি দোকানিকে। ওগুলো রান্নার পর ছোট দুই ছেলে-মেয়েকে খেতে দেয় তাদের মা। অন্য দুই ছেলেমেয়েকে ভালো পিছ দেয় তাদের মা। স্ত্রী আর আমি ঝোল দিয়েই ভাত খেয়ে ফেলি।
তিনি বলেন, আমাদের মতো গরিব মানুষ খেয়ে-না খেয়ে এভাবেই বেঁচে আছে এখন। সবকিছুর খরচ অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। সংসারের ব্যয় দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু আয় তো উল্টো কমছে। আগে দিনে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা থাকতো। এখন ৫০০ টাকা টেকাতে হিমশিম খেতে হয়। বড় ছেলেকে গার্মেন্টসে ঢোকানোর কথা ভাবছে তাদের মা। এখন মাসে ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকার আয় হয় আমার। যে আয় তাতে বাড়িভাড়া এবং সন্তানের লেখাপড়া খরচেই প্রায় শেষ হয়ে যায়। খাবার খরচ টেনেটুনে সপ্তাহখানেক চলে। তাও ভাত, ডাল, সবজি এবং আলু ভর্তা দিয়ে খেয়ে চলতে হচ্ছে। তাতেও মাস পার করতে পারি না। যেভাবে সবকিছুর দাম বেড়েই চলেছে, তাতে আগামীতে শুধু ভর্তা-ভাত জুটবে কি না সেটিও বলতে পারছি না। আমাদের মতো গরিব মানুষের এখন বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে গেছে।
একজন গনি মিয়া নন, তার মতো স্বল্প আয়ের মানুষ, রিকশাচালক, ভ্যানচালকের মতো খেটে খাওয়া মানুষের এখন একই দশা। শুধু তাই নই, মাসিক আয়ের সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী পরিবারগুলোকেও এখন সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এসব পরিবারেও এখন মাছ-মাংস খাওয়া দুরূহ হয়ে পড়ছে।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলন করছেন এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মাচারীরা। স্বল্প বেতনের এই শিক্ষকসমাজ উচ্চমূল্যের এই বাজারে কীভাবে চলছে- জানতে চাওয়া হয় এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণপ্রত্যাশী মহাজোটের সদস্য সচিব জসিম উদ্দিন আহমেদের কাছে। শুক্রবার (১০ মার্চ) তিনি সাম্প্রতিক দেশকালকে এ বিষয়ে বলেন, শিক্ষকদের আয় খুবই সীমিত। অঙ্ক ও ইংরেজি ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ের শিক্ষকরা টিউশনি করতে পারেন না। শুধু বেতনের ওপর ভর করেই সংসার চালাতে হয়। এমপিওভুক্ত স্কুলের একজন সহকারী শিক্ষক মাসে বেতন পান সড়ে ১২ হাজার টাকা। এছাড়া বাড়িভাড়া বাবদ পান এক হাজার টাকা এবং চিকিৎসা ভাতা পান ৫০০ টাকা। এই হচ্ছে তার মাসিক আয়। এই আয় দিয়েই সংসার খরচ, সন্তানের লেখাপড়া, চিকিৎসা ব্যয়সহ সব প্রয়োজনই মেটাতে হয়। এখন এক কেজি চাল কিনতে দরকার ৬০ থেকে ৭০ টাকা, এক লিটার তেল কিনতে লাগে ২০০ টাকা, যেকোনো সবজি এক কেজি কিনতে গেলে ৬০ টাকার নিচে মেলে না। এক কেজি ব্রয়লার মুরগি ২৫০ থেকে ২৬০ টাকা, এক কেজি পাঙাশ মাছও ২০০ টাকার বেশি। গরুর মাংস এবং অন্যান্য দামি মাছের দিকে তো এখন শিক্ষকরা তাকাতেই পারেন না। কারণ এসব কেনার সামর্থ্য এখন তাদের নেই। অধিকাংশ শিক্ষক পরিবার এখন গরুর মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। বেতনের টাকায় মাসের ১০ দিনও পার করা যায় না। প্রতি মাসেই ধার-দেনা করে চলতে হয়। এ জন্য আমরা আন্দোলনে নেমেছি- দেশের এমপিওভুক্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হোক। এ দাবিতে আমরা ১৫ দিন ধরে আন্দোলন করছি। গত দুই দিন প্রতীকী অনশন করেছি। এরপর আমরা আমরণ অনশনে যাব।
স্বল্প আয়ের এসব মানুষের জীবন কঠিন করে তুলেছে মূলত দেশের বাজারে একসঙ্গে সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি। চাল, ডাল, তেল, চিনি, মাছ, মাংস, সবজির মতো খাদ্যপণ্যের দাম বাড়তে বাড়তে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। একই সঙ্গে খাদ্যবহির্ভূত পণ্য- সাবান, পাউডার, টুথপেস্টের মতো পণ্যের দামও বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। এভাবে একসঙ্গে সব পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণেই কষ্ট বেড়েছে সাধারণ মানুষের। সামনে আসছে রোজার মাস। তার আগে আরও কয়েক দফা দাম বাড়তে পারে বলে জানাচ্ছেন খোদ ব্যবসায়ীরাই। বাজারেও প্রতিদিন সে রকমই দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। সুতরাং পণ্যমূল্য আরও বাড়লে কীভাবে তিন বেলার আহার জোটাবেন সে চিন্তাতেই ব্যাকুল এসব স্বল্প আয়ের মানুষ।
এদিকে দেশের মানুষের, বিশেষ করে গরিবের আমিষের আধার বলা হয় ব্রয়লার মুরগি, পাঙাশ মাছ এবং তেলাপিয়া মাছকে। কারণ এই তিন পণ্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ছিল। এখন এগুলোও তাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। গরু-খাসির মাংস তো এখন তাদের কাছে ‘সোনার হরিণ।’ মাছ ও এসব মাংসের দাম কীভাবে বেড়েছে সেদিকে একটু চোখ বোলানো যাক। এক মাস আগেও গরুর মাংস ছিল ৬৮০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি। শবে বরাতের আগের দিন ৮০০ টাকায় ঠেকেছিল। এখন বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ টাকায়। খাসির মাংস ছিল ৯০০ টাকা, এখন হচ্ছে ১১৫০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা। ব্রয়লার মুরগির কেজি ছিল ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকা, এখন হচ্ছে ২৫০ থেকে ২৬০ টাকা। সোনালি মুরগির কেজি ছিল ২৭০ থেকে ২৮০ টাকা, এখন হচ্ছে ৩৬০ থেকে ৩৭০ টাকা। দেশি মুরগির কেজি ছিল ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা, এখন ৬০০ টাকা। একই ভাবে পাঙাশ মাছ মাসখানেক আগেও ছিল ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা, এখন ২০০ থেকে ২২০ টাকা, তেলাপিয়া মাছও ছিল ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা, এখন ২২০ থেকে ২৫০ টাকা।
এছাড়া অন্যান্য মাছের দামও একই হারে বেড়েছে। তবে ব্রয়লার মুরগি, পাঙাশ ও তেলাপিয়া মাছের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় গরিবে মানুষের কষ্ট বেড়েছে। তারা এখন এসব পণ্যও কিনতে পারছে না। আর ব্রয়লার ও পাঙাশ মাছ কিনতে না পারায় গরিব পরিবারের সদস্য, বিশেষ করে এসব পরিবারের শিশুরা পুষ্টিহীনতার মুখে পড়ছে।
আর কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসেন বলেন, ‘দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় গরিব পরিবারগুলো মাছ-মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। কারণ তারা যা আয় করছেন তা দিয়ে তারা মাছ-মাংস কিনতে পারছেন না। ডিমের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক পরিবার ডিম খাওয়াও বাদ দিয়েছে। তারা এখন ডাল-ভাত ও আলু ভর্তা খেয়ে জীবনধারণ করছে। এভাবে মাসের পর মাস চললে একদিকে বড়রা কর্মহীন হয়ে পড়বে, অন্যদিকে ছোট শিশুরা পুষ্টিহীনতায় পড়বে। ফলে আগামীতে আমরা পুষ্টিহীন জাতি পাব। এর প্রভাব এখনই হয়তো চোখে পড়বে না, এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ীরা অস্বাভাবিক মুনাফা করছে। এক কেজি ব্রয়লার মুরগি উৎপাদনে এখন ব্যয় হচ্ছে ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা। অথচ খামার থেকেই বিক্রি করা হচ্ছে ২০০ টাকা কেজিতে। পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীর হাত ঘুরে ভোক্তার কাছে আসতে সেটি হয়ে যাচ্ছে ২৫০ থেকে ২৬০ টাকা। তা হলে উৎপাদকরা কেজিতে লাভ করছেন ৭০ থেকে ৭৫ টাকা, আর পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা লাভ করছেন ৪০ থেকে ৫০ টাকা। অথচ কৃষি বিপণন আইন অনুযায়ী কেজিতে ১০ শতাংশ লাভ করার কথা। সে হিসেবে কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা লাভ করার কথা অথচ করছে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ। এভাবে তো চলতে পারে না। বৈশ্বিক সংকটের কারণে পণ্যমূল্য যা বাড়ছে, তার চেয়ে বেশি বাড়ছে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটে।’