
বসুন্ধরা শপিংমলে জমে উঠেছে ঈদের কেনাকাটা। ছবি: সংগৃহীত
রাজধানীতে জমে উঠেছে ঈদের কেনাকাটা। গতকাল শুক্রবার (৭ এপ্রিল) ছুটির দিনে রাজধানীর বিভিন্ন শপিংমল ও নামি-দামি ব্র্যান্ডের ফ্যাশন হাউসগুলোতে ছিল মানুষের উপচে পড়া ভিড়। আর প্রতিবারের মতো এবারও নজরকাড়া ডিজাইনের পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারাও। তবে এবার পোশাকে দাম দ্বিগুণ হয়েছে বলে অভিযোগ ক্রেতাদের। এজন্য তাদের কাটছাঁট করে পোশাকে কিনতে হচ্ছে বলেও জানান তারা।
বিষয়টি স্বীকার করেছেন ব্যবসায়ীরাও। তারা বলছেন, ঈদকে সামনে রেখে বাজারে ক্রেতাদের আনাগোনা বাড়ছে। কিন্তু সেই তুলনায় বিক্রি কম হচ্ছে। কারণ দেশে কয়েক মাস ধরে মাছ-মাংস, চাল-ডালসহ সব ধরনের নিত্যপণের দাম বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে আমদানি করা কাপড় ও আনুষঙ্গিক কাঁচামালের দাম। তাই কোনোভাবেই মূল্যবৃদ্ধির চাপ সামাল দিতে পারছেন না তারা। এ মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে পোশাকের বাজারেও। তবে আরও কয়েক রোজা গেলে বিক্রি বাড়বে বলে প্রত্যাশা তাদের।
গতকাল শুক্রবার জুমার নামাজের পর থেকে রাজধানীর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেট, ওয়ারী, ইসলামপুরের কাপড়ের বাজার, নিউমার্কেট, চাঁদনী চক, গাউছিয়া, এলিফ্যান্ট রোড ও ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটের সামনের ফুটপাথ থেকে শুরু করে মূল দোকানের ভেতরে কোথাও যেন পা ফেলার জায়গা ছিল না। সবখানেই মানুষ আর মানুষ। প্রতিটি মার্কেটেই ক্রেতার উপস্থিতি ছিল দেখার মতো।
শুক্রবার সরেজমিন দেখা যায়-ক্রেতা আসছে, থরে থরে সাজানো বাহারি সব ড্রেস দেখছে, কিনছে। তবে তাদের প্রায় সবার মুখেই একটি কথা- এবার পোশাকের দাম অনেক বেশি।
যেহেতু বৈশাখ মাসে হচ্ছে এবারের ঈদ, আবহাওয়া থাকবে বেশ গরম আর বৃষ্টিময়। তাই শিশুদের জন্য ঈদের বাজারে উঠেছে বৈচিত্র্যময় পোশাক। বড়দের মতোই ছোটদের পোশাকের নকশায় প্রাধান্য পাচ্ছে কারচুপি, এমব্রয়ডারিসহ হাতের কাজ।
মেয়েশিশুদের জন্য ঘের দেওয়া লম্বা কামিজ যেমন চলছে, তেমনি ছেলেশিশুদের লাইনকাটের পাঞ্জাবির বিক্রি বেশি দেখা গেছে। একাধিক শিশুর পরিবার জানিয়েছে, ঈদে যেহেতু শিশুরা সারা দিন জমকালো পোশাক পরে থাকতে পারে না, সেজন্য সুতি, ডেনিম বা জিনসের প্যান্ট, খাটো হাতার শার্ট ও ফতুয়া তাদের পছন্দ। আর মেয়েশিশুদের জন্য পার্টি ফ্রক, ঘাগড়া চোলি ও লেগিংসের চাহিদা বেশি দেখা যাচ্ছে। এছাড়া সুতির কাপড়ের পাশাপাশি সালোয়ার-কামিজও রয়েছে।
আর তরুণীদের মধ্যে ইন্ডিয়ান নায়রা, কটি ড্রেস, ‘গারারা’ ও ‘সারারা’ গাইন নায়রা, ঝিলিক, পানচুরের চাহিদা বেশি বলে জানান বিক্রেতারা। দেশীয় কাপড়ের পাশাপাশি ভারতীয় পোশাকের চাহিদা রয়েছে যথেষ্ট। আর পোশাকগুলোতে ব্যবহার করা হয়েছে ধুপিয়ান সিল্ক, জয় সিল্ক, তসর সিল্ক, সফট সিল্ক, কাতান। রঙের ব্যবহারে কন্ট্রাস্ট কালারের পাশাপাশি অফহোয়াইট, সাদা, লাল, মেরুন, রয়েল ব্লু, গ্রিন, গোল্ডেনসহ সব রঙেরই পরিমিতিবোধ লক্ষ করা গেছে সব পোশাকে। কাজের মাধ্যম হিসেবে প্রিন্টেই রয়েছে অনেক রকম কাজ। সঙ্গে এমব্রয়ডারি, জারদৌসি, কারচুপি, কাটওয়ার্ক, স্ক্রিন প্রিন্টসহ মিশ্র মাধ্যমের নিজস্ব বিভিন্ন কৌশল। রুচিসম্মত পণ্য কিনতে এক শপিংমল থেকে অন্য শপিংমলে ঘুরছেন অনেকেই।
তবে কেনা নিয়ে দোকানিদের মধ্যে দেখা গেছে মিশ্রপ্রতিক্রিয়া। কেউ কেউ বলেন, কেনাবেচা ভালো, কেউ কেউ বলেন ভালো না।
আজিজ সুপার মার্কেটে পরিবার নিয়ে ঈদের কেনাকাটা করতে এসেছিলেন সবুজ আহমেদ। তিনি বলেন, ঈদের তো আর বেশি দিন বাকি নেই। অনেক আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছি আজকে মার্কেটে আসব।
তিনি বলেন, ছেলের জন্য পায়জামা ও পাঞ্জাবি কিনেছি। দাম রেখেছে ১২০০ টাকা। অথচ অন্য সময়ের তুলনায় এর দাম ৬০০ থেকে ৭০০ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। একই ভাবে স্ত্রীর জন্য ৩ হাজার টাকা দিয়ে থ্রি-পিস কিনেছি। মনে হচ্ছে দাম অনেক বেশি রেখেছে।
একই মার্কেটের ইশরাত পাঞ্জাবি ফ্যাশন হাউসের স্বত্বাধিকারী শাহেদ হাওলাদার বলেন, পহেলা বৈশাখ ও শুক্রবার থাকায় ক্রেতাদের ভিড় অনেক বেশি। তবে বিক্রি কম। কারণ এবার অন্য বারের তুলনায় সবকিছুর মতো পোশাকের দাম বেড়েছে। তাই মানুষ দোকানে আসছে কিন্তু দাম শুনে চলে যাচ্ছে।
মার্কেটের ‘কাপড়-ই বাংলা’র কর্মচারী রুনা আক্তার বলেন, মার্কেটে মানুষ বেড়েছে কিন্তু বিক্রি বাড়েনি। কারণ নিত্যপণ্যসহ সব জিনিসের দাম বাড়তি। তাই এবার শিশু থেকে বড়দের সবার পোশাকের দামও বেড়েছে। এ জন্য অনেক ক্রেতা দাম শুনে চলে যাচ্ছেন।
তবে নিউ মার্কেটের মিতালী ফ্যাশন হাউসের মালিক রহমত উল্লাহ বলেন, আলহামদুলিল্লাহ, ভালো কেনাবেচা হচ্ছে। ক্রেতাদের রোজার শেষের দিকে সবসময় মার্কেট করতে দেখা যায়। কিন্তু এবার ভিন্ন মনে হচ্ছে। মাসের শুরুতেই কেনাকাটায় মনোযোগ দেখছি। গত ২-৩টা ঈদেও ভালো ব্যবসা করতে পেরেছি। আশা করছি, এবারও ভালো কিছু হবে।
তিনি বলেন, গতবার বাচ্চাদের যে পোশাক ১২০০ টাকা বিক্রি করেছি এবার তা ২ হাজার টাকা বিক্রি করতে হচ্ছে। কারণ বিদ্যুৎ বিল, কর্মচারীর বেতন, দোকান ভাড়া সবমিলে আমাদের চিন্তা করতে হয়। আর বাজারে সবকিছুর দাম বেড়েছে। তাই বিষয়টি আমাদের মাথায় রাখতে হচ্ছে।
কেনাকাটা করতে গিয়ে নিউ মার্কেট, গাউছিয়া ও চাঁদনী চক এলাকার বিভিন্ন দোকান ঘুরেছেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সাইদুর রহমান। স্ত্রীর জন্য শাড়ি, থ্রি-পিস ও দুই ছেলেমেয়ের জন্য অনেক ঘুরে কিছু প্রয়োজনীয় পোশাক কিনেছেন।
তিনি বলেন, আমার আয়ের ওপর পুরো পরিবার নির্ভরশীল। মাসের বেতন পেয়ে বাজারে এলে অর্ধেকের বেশি টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর বাসা ভাড়া থেকে শুরু করে ছেলেমেয়ের লেখাপড়াসহ অন্যান্য খরচ করার মতো টাকা থাকে না। বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেশি। এখন দেখি সব পোশাকেরই দাম বেশি। এমন পরিস্থিতিতে ঈদে কেনাকাটায় কাটছাঁট না করে উপায় নেই। প্রিয়জনদের খুশি করা মুশকিল হবে।
এমন পরিস্থিতিতে ফুটপাথের দোকান ভরসা অনেকের। এ এলাকার ফুটপাথগুলোর মতো নিউ মার্কেট কমপ্লেক্সের ভেতরে চক্রাকার চত্বরগুলোতেও বসেছে বাহারি রঙের পোশাকের পসরা। সেখানে মানুষের ভিড়ে পুরো এলাকা যেন এক হয়ে আছে। তাতে হাসি ফুটেছে বিক্রেতাদের মুখে।
রেন্টু নামে এক বিক্রয়কর্মী জানান, সকাল থেকেই কেনাকাটার জন্য ভিড় করেছে লোকজন। প্রতি বছর রমজানের মাঝামাঝি সময়ে ঈদের কেনাকাটা শুরু হলেও এবার রোজার শুরুতেই মার্কেট ও ফ্যাশন হাউসগুলোতে ক্রেতাদের ভিড় বেড়েছে।
ফুটপাথে পণ্য কিনতে আসা ইসমাইল হোসেন জানান, বড় দোকান থেকে আমার পক্ষে প্যান্ট কেনা সম্ভব নয়। ছেলের পছন্দমতো ৩০০ টাকা দিয়ে প্যান্ট কিনে দিলাম। তবে মেয়ের জন্য এখনও কিনতে পারিনি। কারণ ৫০০ টাকার নিচে কোন জামা পাচ্ছি না।
ঈদের কেনাকাটার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে গাউছিয়া মার্কেট দোকান মালিক সমিতির সভাপতি কামরুল হাসান বাবু সময়ের আলোকে বলেন, প্রতি বছর রমজানের মাঝামাঝি সময়ে ঈদের কেনাকাটা শুরু হলেও এবার রোজার শুরুতেই ক্রেতাদের ভিড় বেড়েছে। বিক্রিও ভালো হচ্ছে।
অন্যান্য বছরের তুলনায় দাম বেশি-ক্রেতাদের এমন অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, বাজারে সব জিনিসের দাম বেড়েছে। তাই পোশাকের দামও কিছুটা বেড়েছে। তবে খুব বেশি বাড়েনি।