ঋণখেলাপি ও ব্যাংক মালিকদের দৌরাত্ম্য কমানোর চেষ্টা

এমএইচ রশিদ
প্রকাশ: ১৩ এপ্রিল ২০২৩, ১০:১৭

বাংলাদেশ ব্যাংক। ফাইল ছবি
ব্যাংক খাতের সংকট নিরসনে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন করা হচ্ছে। সংশোধিত আইনে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে খেলাপি ঋণ কমানো এবং মালিকদের একক প্রভাববলয়ের নাগপাশ থেকে ব্যাংককে মুক্ত করা। এজন্য ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে।
ব্যাংক পরিবারের প্রভাব কমাতে একক পরিবার থেকে পরিচালকের সংখ্যা ৪ জন থেকে কমিয়ে ৩ জন করা হচ্ছে। এছাড়া অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে দীর্ঘদিন ধরে দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার বিধান রাখা হচ্ছে নতুন আইনে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক খাতের সংস্কারের জন্য যতটুকু আইনি পরিবর্তন প্রয়োজন তার তুলনায় অতিসামান্য পরিবর্তন হচ্ছে। এছাড়া আগের আইনের যথাযথ প্রয়োগ হলেও অনেক সংকটের সমাধান করা সম্ভব হতো। কিন্তু অজানা কারণে আইন প্রয়োগ করা হয় না। তাই নতুন আইনের কার্যকারিতা বা প্রয়োগ নিয়েও সংশয় রয়েছে।
গত ২৮ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন, ২০২৩’-এর চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
১৯৯১ সালের ব্যাংক কোম্পানি আইনের ভিত্তিতে বর্তমানে দেশে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এটাকে আধুনিকায়ন ও যুগোপযোগী করার জন্য সংশোধনী প্রস্তাব নিয়ে কাজ করছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। সংশোধন প্রক্রিয়া চলাকালে সরকার আইএমএফের কাছে ঋণের আবেদন করে। এ অবস্থায় ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্ত হিসেবে আইএমএফ দ্রুত ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন বাস্তবায়নের তাগাদা দিয়েছে। একই সঙ্গে ২০২৬ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মন্দ ঋণ (নন-পারফর্মিং লোন বা এনপিএল) ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে বলেছে আন্তর্জাতিক সংস্থাটি। গত ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী, অগ্রণী, জনতা, রূপালী, বেসিক, বিডিবিএল-এই ছয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণের গড় হার ২৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আইএমএফের শর্ত মানতে গিয়ে শুধু সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ নয়, বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণও ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার।
বিভিন্ন সুবিধা দেওয়ার পর বর্তমানে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। গত ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৭৭ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা, এর মধ্যে খেলাপির পরিমাণ ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। এ ছাড়া ১৭ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। এর বাইরে আদালতের মাধ্যমে ১ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকার ঋণখেলাপি না করতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
বাংলাদেশে খেলাপিদের বিভিন্ন সুবিধা দেওয়ায় তা নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়ছে। যার প্রভাবে দেশের আর্থিক খাত শৃঙ্খলাহীন হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানিয়েছে আইএমএফসহ বিভিন্ন সংস্থা। এশিয়ার বেশ কিছু দেশ রয়েছে, যারা খেলাপি ঋণের অনুপাত আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে কিংবা এর কাছাকাছি নিয়ে আসতে কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছে। মালয়েশিয়াতে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ গ্রাহকরা দেশ ছেড়ে যাওয়ার অনুমতি পান না। থাইল্যান্ড সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি (এএমসি) গঠন করে খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারে সফলতা পেয়েছে। ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কা আরও বেশি রক্ষণশীল হয়ে উঠছে। প্রভিশন কাভারেজ বাড়িয়ে শ্রীলঙ্কায় ঋণ বিতরণ করা হয়, যা বর্তমানে ৬৩ শতাংশ। ১৯৯৯ সালে শ্রীলঙ্কায় খেলাপি ঋণের হার ছিল ঋণের ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ, যা ২০১৭ সাল শেষে ২ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসে।
তবে খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি কঠোর পদক্ষেপ নেয় চীন। দেশটিতে খেলাপিদের ওপর উড়োজাহাজ ও উচ্চগতির ট্রেনের টিকিট ক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। করপোরেট সংস্থার নির্বাহী কিংবা প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করতে পারেন না খেলাপিরা। এমনকি খেলাপিরা ব্যক্তিগত পরিচয়পত্র ব্যবহার করে কোনো হোটেল সুবিধা নিতে পারেন না, রিয়েল এস্টেট কিনতে পারেন না। চীনের কিছু প্রদেশে খেলাপিদের সামাজিকভাবে ও সর্বজনীনভাবে লজ্জা দেওয়া হয়। যেমন গত আগস্টে দক্ষিণ-পশ্চিম সিচুয়ান প্রদেশের একটি আদালত ২০ খেলাপি গ্রাহকের ফোনে রেকর্ড করা বার্তা ছেড়ে দেয়, যাতে কেউ ফোন দিলে ‘আপনি যাকে ফোন দিয়েছেন, দেনা পরিশোধ করতে না পারায় আদালত তাকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে’ এমন মেসেজ বেজে ওঠে।
বাংলাদেশের নতুন আইন প্রসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) মাহমুদুল হোসাইন বলেন, এখানে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি কারা তার একটা সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয় উল্লেখ রয়েছে। আর্থিক সামর্থ্য থাকার পরও যদি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ঋণ পরিশোধ না করে তাহলে তা ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসেবে বিবেচিত হবে। এ ছাড়া কোনো ব্যাংক কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে জালিয়াতি বা মিথ্যা তথ্য দিয়ে নিজের বা পরিবারের সদস্যদের নামে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করলে, সেই ব্যক্তিকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি বলে গণ্য করা হবে। একই সঙ্গে যে উদ্দেশ্যে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ অগ্রিম নেওয়া হয়েছে, সেই উদ্দেশ্যে ব্যবহার না করলেও ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি ঋণ গ্রহীতা হিসেবে বিবেচিত হবে।
আইনে বলা হয়েছে, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের তালিকা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সরবরাহ করবে। এরপর তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে তালিকাভুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তালিকা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যে কোনো ব্যাংক কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হতে পারবেন না। কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে বিবেচিত হলে বাংলাদেশ ব্যাংক তার পরিচালক পদ শূন্য ঘোষণা করতে পারবে। নোটিস দেওয়ার দুই মাসের মধ্যে ঋণখেলাপি তার কাছে পাওনা টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হলে অর্থঋণ আদালতে মামলা করা যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা, তাদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্সের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও কোম্পানি নিবন্ধনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ব্যবস্থা করতে পারবে। কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান যদি ঋণখেলাপির তালিকা না পাঠায়, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫০ লাখ এবং সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা জরিমানা করতে পারবে। তার পরও যদি লঙ্ঘন অব্যাহত থাকে তাহলে প্রতিদিনের জন্য এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা যাবে।
অনুমোদিত খসড়া আইনের বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, এটা ভালো দিক। তাদের বিষয়ে আরও বেশি সুনির্দিষ্ট করতে পারলে ইচ্ছা করে খেলাপি হওয়ার প্রবণতা কমে আসবে। সংশোধিত আইনে ভালো কিছু বার্তা পাওয়া যাচ্ছে। এক পরিবার থেকে তিনজন পরিচালক রাখার বিষয়টিও ইতিবাচক। এ তিনজনের মধ্যে অবশ্য পরিবারের পাশাপাশি মনোনীত পরিচালকদের যুক্ত করতে পারলে আরও ভালো হয়। সব মিলিয়ে দরকার হচ্ছে ব্যাংক খাতে সুশাসন জোরদার করা।
ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের আগে আইএমএফ প্রতিনিধি দল এক পরিবার থেকে ৪ জন এবং টানা ৯ বছর ব্যাংকের পরিচালক থাকার সুযোগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। গত ৩২ বছরে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন হয়েছে ৭ বার। এর মধ্যে ব্যাংক মালিকদের চাপে এক পরিবার থেকে ৪ জন এবং টানা ৯ বছর ব্যাংকের পরিচালক থাকার সুযোগ দিয়ে সর্বশেষ আইন সংশোধন করা হয় ২০১৮ সালে। নতুন সংশোধনীতে এক পরিবার থেকে চার জনের পরিবর্তে ৩ জন পরিচালক থাকার সুযোগ দিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা আংশিক ইতিবাচক। ব্যাংক খাতে সংস্কার দরকার, আমরা বহু বছর ধরে বলে আসছি, ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের আগে আইএমএফও পরামর্শ দিয়ে গেছে। তবে আধা খেঁচড়া কাজ করে এ খাতের কোনো লাভ হবে না। এক পরিবার থেকে ব্যাংকের পরিচালক হতে পারেন বড়জোর দুই জন এবং তাদের জন্য তিন বছরের একটি মেয়াদ দেওয়া যেতে পারে। আরেকটু উদারভাবে বললে তারা ছয় বছর পর্যন্তও থাকুন। কিন্তু ৯ বছর কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
এছাড়া ব্যাংক কোম্পানি আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যাংক মনে করেন যে তার বিদ্যমান আর্থিক অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে বা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে, তাহলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাবে। আর্থিক অবস্থা খারাপ বলতে তারল্য, সম্পদের গুণগত মান ও মূলধন পরিস্থিতি খারাপ হওয়া এবং সুশাসন বজায় রেখে পরিচালনা সম্ভব না হওয়াকে বোঝানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তখন ব্যাংকটিকে পুনরুদ্ধারের ব্যবস্থা করবে। তার আগে একটি কর্মপরিকল্পনা বাংলাদেশ ব্যাংকে দাখিল করবে পরিচালনা পর্ষদ। বাংলাদেশ ব্যাংক দুই বছর সময় দিয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে কি না, তা দেখবে। পুনরুদ্ধার কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হলে অবসায়নই হবে ব্যাংকটির অনিবার্য পরিণতি। সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর দেউলিয়া ঘোষণা করার বিধানও রাখা হচ্ছে আইনে। তবে বাঁচানোর চেষ্টার অংশ হিসেবে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ, অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা, প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া ইত্যাদি সুযোগ রাখবে।